Thursday, May 24, 2018

নাস্তিকতা নিয়ে ধার্মিকদের মিথ্যাচার :
ধার্মিকদের জ্ঞান এতোই কম যে তারা নাস্তিকতা সম্পর্কেও ভালো করে জানে না। তারা এতো অলস যে হাতেই ফোন,ল্যাপটপ এবং ইন্টারনেট থাকা সত্তেও গুগোলে সার্চ দিয়েও সঠিকভাবে শিখতে চায় না। তারা মিথ্যাচার করে বলে, "নাস্তিকতারা নাকি বলে সৃষ্টিকর্তা নেই"। কতোটা মূর্খ হলে এমন কথা বলা যায় ভাবুন? কেউ যদি কোন কিছু দাবী করে তাহলে সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব শুধুই তার কারণ সেই বিষয়টি দাবী করেছে। এই সামান্য লজিকই তারা বুঝে না, তাদের সাথে আর কি তর্ক করবো?যেমন আমি যদি বলি,আমি প্রতি রাতে চাঁদে গিয়ে এক কাপ কফি খেয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পরি। এখন এটা নিশ্চয়ই কেউ বিশ্বাস করবে না এবং সবাই আমাকে বলবে, তুমি চাঁদে গিয়েছো তা প্রমাণ করে দেখাও কিন্তু আমি যদি উল্টো সবাইকে বলি, "আমি যে চাঁদে যাই নাই" এটা তোমরা প্রমাণ করে দেখাও। তাহলে আমার এই কথাটা হবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং মূর্খতাপূর্ণ। যেহেতু আমি নিজেই দাবী উত্থাপন করেছি তাই এইটা প্রমাণ করার সম্পূর্ণ দায়ভার আমার উপরেই বর্তায়। এখন আসি আসল পয়েন্টে, পৃথিবীতে সব ধর্মের মানুষরাই খুব জোড়ালোভাবে দাবী করে সৃষ্টিকর্তা আছে কিন্তু আমরা যখন সৃষ্টিকর্তা আছে তার প্রমাণ তাদের কাছে চেয়েছি তখন তারা প্রমাণ দিতে পারে না এবং মূর্খের মতো বলে এটা অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে হবে। আমরা যখন তাদের কথা মানতে না চাই তখন তারা আরো বেশি অযৌক্তিক এবং মূর্খতাপূর্ন কথা বলে, "তারা বলে 'সৃষ্টিকর্তা যে নাই' এটা তোমরা প্রমাণ করে দেখাও।" ব্যাপার টা যে কতোটা হাস্যকর একবার ভেবে দেখুন। মাঝে মাঝে তারা মূর্খের মতো আমাদের চেলেঞ্জ করে বলে, "তোমার সাহস থাকলে যক্তিতর্ক করো, "সৃষ্টিকর্তা নেই" এটা প্রমাণ করো।"
আমরা এতোটাই বোকা নয় যে এইসব জ্ঞানহীন মানুষের সাথে যুক্তিতর্ক করবো যারা কিনা মৌলিক যুক্তিবিদ্যাই বোঝে না। এমন কি তারা নিজেদের ধর্মগ্রন্থ অর্থসহকারে পড়েছে কিনা সন্দেহ আছে। কারো সাথে যুক্তিতর্ক করার আগে দেখতে হয় সে কতোটা জ্ঞানী এবং নিজের ধর্মগ্রন্থ কতোটা জানে। এরা হচ্ছে, "বিচার যাই হোক তাল গাছ আমার" এই যুক্তিতে ১০০% বিশ্বাসী।
এবার আসি নাস্তিকতার সঠিক আলোচনায়:
নাস্তিক্যবাদ (ইংরেজি ভাষায়: Atheism; অন্যান্য নাম: নিরীশ্বরবাদ, নাস্তিকতাবাদ) একটি দর্শনের নাম যাতে ঈশ্বর বা স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়না এবং সম্পূর্ণ ভৌত এবং প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেয়া হয়। আস্তিক্যবাদ এর বর্জনকেই নাস্তিক্যবাদ বলা যায়। নাস্তিক্যবাদ বিশ্বাস নয় বরং অবিশ্বাস এবং যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাসকে খণ্ডন নয় বরং বিশ্বাসের অনুপস্থিতিই এখানে মুখ্য।
নাস্তিক্যবাদ আসে যুক্তিবাদ থেকে। নাস্তিকতা কোন বিশ্বাস বা ধর্ম নয়, এটি যাবতীয় বিশ্বাস বা ধর্মতত্বকে যাচাই বাছাই এবং যুক্তিসঙ্গত উপায়ে বাতিলকরণ। নাস্তিক্যবাদ বলে না যে “ঈশ্বর নেই”; নাস্তিক্যবাদ বলে, “মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঈশ্বর আছে বা কোন অলৌকিক শক্তি আছে তার কোন উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ নেই”। এবং যেহেতু কোন প্রমাণ নেই, তাই ঈশ্বরের এই দাবীকে নাস্তিক্যবাদ বাতিল করে এবং ভ্রান্ত বলে মনে করে। তবে ঈশ্বরের কোন উপযুক্ত প্রমাণ ধার্মিকগণ দেখাতে সমর্থ হলে তা মেনে নিতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। যখনই পাওয়া যাবে, সেগুলো মেনে নেয়া হবে। তবে যুক্তিহীন বিশ্বাস যেহেতু যাচাই করবার কোন উপায় নেই, তাই একে খারাপ কাজে লাগাবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে- যেহেতু এটা যুক্তিপ্রমাণহীন একটি বিশ্বাসমাত্র। এবং সত্যিকার অর্থে ঘটেছেও তাই। এছাড়া ধর্মগ্রন্থে যেই ঈশ্বরের কথা বলা আছে, সেই ঈশ্বর শুধু নোংরাই নয়, সাম্প্রদায়িক, হিংস্র, তোষামদপ্রিয় এবং লোভী। সে প্রাচীন কালের রাজাদের চরিত্রের অধিকারী, যে শুধু নিজের উপাসনা আর তোষামোদ চায়, তা না পেলেই ভয় দেখায়।

Wednesday, May 23, 2018

মানুষ না হয়ে এভাবে মুসলমান হয়ে লাভ কী?


মানুষ না হয়ে এভাবে মুসলমান হয়ে লাভ কী?
সাইয়িদ রফিকুল হক
মাত্র কিছুদিন আগেও আমাদের বাংলাদেশে বেগুন ছিল ২৫-৩০ টাকা কেজি। আর এখন, রোজা শুরুর কয়দিন আগে থেকে তার দামবৃদ্ধি পেতে-পেতে সেই বেগুনের দাম হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেয়ে ৭০-৮০ টাকা কেজি হয়ে গিয়েছে! আর সামান্য শশা ছিল ২০ টাকা, আর খুব বেশি হলে তা ছিল ২৫-৩০ টাকা কেজি। কিন্তু সেই শশারও বেগুনের মতো হঠাৎ করে দামবৃদ্ধি পেয়ে তা হয়ে গিয়েছে ৬০-৭০ টাকা কেজি! একি ‘মগের মুল্লুক’ নাকি? হয়তো বা তা-ই। আসলে, দেশে হঠাৎ করে কোনোকিছুর দামবৃদ্ধি পায়নি। কারণ, মুসলমানদের মাহে রমজানের আগে থেকে পরিকল্পিতভাবে এভাবে দামবৃদ্ধি করছে এদেশেরই একশ্রেণীর মুসলমান-নামধারী কতকগুলো নরপশু।
বাংলাদেশে রোজার আগে সব জিনিসের দাম প্রায় স্থিতিশীল থাকলেও রোজার শুরুতে হঠাৎ করে তার দাম বাড়ানো হয়েছে। আর এই অপকর্মটি করে চলেছে এদেশেরই মুসলমান। এরা নাকি বড়-বড় ব্যবসায়ী। আর নামে একেকটা শিল্পপতি, সিআইপি, ভিআইপি, ভিভিআইপি! আরও কত কী! এরা দেশে কত মসজিদ-মাদ্রাসা বানিয়েছে!
চলতি বছরের রোজার শুরুতে বরাবরের মতো শুধু বেগুন-শশারই দাম বাড়েনি—দাম বেড়েছে অন্যান্য আরও কিছু দ্রব্যসামগ্রীর। রমজান-উপলক্ষে সাধারণ মানুষের গলাকেটে কাঁচাপয়সা-উপার্জনের নিমিত্তে একশ্রেণীর মুসলমান এখন ভয়ানকভাবে দিশেহারা আর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। মনে রাখবেন: এরা শুধুই মুসলমান। আর খুব সহজে এরা মুসলমান হয়ে গিয়েছে। এরা এখনও মানুষ হয়নি। আর এরা কখনও-কোনোদিন মানুষ হবে কিনা তা নিয়েও সবার মনে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে।
রমজানের কয়েকদিন আগে থেকে বেগুন-শশার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাম বেড়েছে টমেটো, লেবু, ধনিয়াপাতা, পুদিনাপাতা, খেজুর, পেঁপে, কলা, আম, লিচুসহ আরও অনেক কিছুর। এদেশের সাধারণ মুসলমানশ্রেণী যে-সব সামগ্রী প্রতিদিন তাদের ইফতারিতে ব্যবহার করে থাকে—ব্যবসায়ী নামক কসাই তথা নরপশুগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে সে-সব পণ্যেরই দাম বাড়িয়েছে। মনে রাখবেন: এরা কিন্তু মুসলমান!
এই তো কয়েকদিন আগে লেবুর হালি ছিল ১০-১৫ টাকা কিংবা আকৃতিতে একটু ভালো বা বড় হলে তা সর্বোচ্চ ২০ টাকা। আমাদের মুসলমানরা রোজার মর্যাদা রাখতে আজ সেই লেবুর হালি পর্যন্ত এখন নিয়ে ঠেকিয়েছে ৪০-৫০ টাকায়! একটা বড় লেবু কিনতে গেলে ১০-১৫ টাকা লাগে! অথচ, রোজার আগে তার দাম ছিল বড়জোর ৪-৫ টাকা। আজ এই রোজার মাসে সেই লেবুর হালি ৪০ টাকা! আর স্থানভেদে কিংবা অভিজাত-বিপণীগুলোতে এই একই লেবু ৫০-৬০ টাকা হালিতে পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে! এরা অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে মাছ-মাংসেরও দাম বাড়িয়েছে!
ছোলা, পেঁয়াজ, চিনি তথা ইফতারসামগ্রীতে ব্যবহৃত প্রায় সব জিনিসের দাম বাড়িয়েছে এদেশেরই ব্যবসায়ী নামক একটি বেজন্মা-গ্রুপ। এরা সবসময় তা-ই করে থাকে। এরা আবার জাতে মুসলমান। এদের অনেকে এখনও কত মসজিদ-মাদ্রাসার সভাপতি আর সেক্রেটারি! এরা আবার আজকের বাংলাদেশে উন্নতজাতের অতিমুসলমান! প্রায় সবাই মডারেট-মুসলমান।
রোজার মাসে পণ্যসামগ্রীর মূল্য-নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার (রোজার আগে) পর্যাপ্ত পরিমাণে পেঁয়াজ, ছোলা, ডাল, চিনি, তেল ইত্যাদিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আমদানি করেছে। এগুলোর সরবরাহ বেশি রাখার জন্য সরকার এই ব্যবস্থা করেছে। বাজারে এখনও পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে দ্রব্যসামগ্রী রয়েছে। মাত্র কয়দিন আগের ১৫ টাকার আলু (স্থানভেদে ১৮-২০ টাকার সেই গোলআলু) আজ ২৫ টাকা হয়ে গিয়েছে! এই না হলে বাংলার ঈমানদার-মুসলমান! দেশের সরকার রোজার মাসে সাধারণ মানুষের মধ্যে অবাধে পণ্যসরবরাহের জন্য বেশ কয়েকটি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক একেবারে তুলে দিয়েছে। এগুলো এখন শুল্কমুক্ত পণ্য। আরও কয়েকটি পণ্যের শুল্কের হার একেবারে কমিয়ে দিয়েছে। তবুও এই ব্যবসায়ী-নামক হায়েনাগুলো সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে নিজেদের স্বার্থে নিয়মিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে! বলুন তো, এরা কি মানুষ? না, নিশ্চয়ই না। এরা নিঃসন্দেহে অমানুষ। আর এই অমানুষগুলোই নাকি আজ মুসলমান!
এখানে, আজ কত সহজে মুসলমান হওয়া যায়। মাথায় একটা সাদা বা যেকোনো রঙের টুপি, মুখে কয়েকগোছা দাড়ি, আর পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি কিংবা লুঙ্গিসমেত পাঞ্জাবি পরলে সেও বিরাট একখান মুসলমান! রমজান-মাসে নিজেদের মুসলমানিত্ব জাহির করার জন্য একশ্রেণীর প্রাণি আদাজল খেয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেয়। আর সে কিন্তু এখনও একসেকেন্ডের জন্য মিথ্যা পরিত্যাগ করেনি! তবুও সে নিজেকে সমাজে-রাষ্ট্রে মুসলমান হিসাবে সাজাতে ও প্রকাশ করতে চায়! স্বার্থের জন্য সমাজে এখন অনেকেই মুসলমান সাজছে।
কারওয়ান-বাজার, চকবাজার, নিউমার্কেট, গাউছিয়াসহ দেশের অধিকাংশ বিপণীগুলোতে গিয়ে দেখুন একশ্রেণীর ছোট-বড় ব্যবসায়ী এই রমজান-মাসে নিজেকে মুসলমান হিসাবে জাহির করার জন্য কতরকমের কলাকৌশল অবলম্বন করে চলেছে। এদের কারও-কারও মাথায় দিবারাত্রির প্রায় ২৪ ঘণ্টা একখান টুপি আছে! আবার কারও-কারও মুখে ইঞ্চিখানেক দাড়ি (রোজার কিছুদিন আগে থেকে তার এই পরিকল্পনা ছিল)! আবার কেউ-কেউ মাথায় টুপি ও পাঞ্জাবি পরে বসে রয়েছে! কিন্তু এসবই ব্যবসা আরকি! আর ধান্দাবাজি সবারই সমান। এরা লোকের কাছে ফাঁকি দিয়ে খারাপ জিনিস বিক্রি করতে ভয়ানক ওস্তাদ। বেশি পণ্য বিক্রির স্বার্থে এরা ক্রেতাদের কাছে এভাবে মুসলমান সেজেছে।
রমজান-মাসেও এদেশের মুসলমান-ব্যবসায়ীরা প্রায় সমস্ত কাঁচামালে, ফলমূলে ও শাকসবজিতে দেদারসে বিষাক্ত ও নিষিদ্ধ কার্বাইড, ফরমালিন, ইথানল ইত্যাদি ব্যবহার করছে। ধর্মবিশ্বাসে এরা সবাই মুসলমান। মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যবিষয়ক ঝুঁকি নিয়ে আজ এদের মধ্যে ন্যূনতম দয়ামায়া নাই। এরা ভয়ানক অর্থলোভী। আর এরাই বুঝি মুসলমান?
অধিক মুনাফার লোভে এই মুসলমান-ব্যবসায়ীসমাজ আজ দেশবাসীকে নানারকম কষ্ট দিচ্ছে। এদের মধ্যে কবে একটুখানি মনুষ্যত্ব জাগবে? আর এরা মানুষ না হয়ে আর কতকাল এভাবে শুধু মুসলমান সেজে থাকবে?
আমাদের, আগে মানুষ হতে হবে। আর সবাইকে হতে হবে মানুষের মতো মানুষ। নামকাওয়াস্তে কোনো-এক মানুষ হলে চলবে না। আমাদের থাকতে হবে মানবিকসত্তা। আমাদের হতে হবে মানবিক। সবার আগে আমাদের মনে মানবিকতা জাগ্রত করতে হবে। আর একজন মানুষ হিসাবে অবশ্যই মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটাতে হবে। সমগ্র মানবজীবনে একমাত্র মনুষ্যত্বই শ্রেষ্ঠ অর্জন। আর পৃথিবীতে মানুষ না-হয়ে কিংবা অমানুষে পরিণত হয়ে ধর্মপালন করতে যাওয়াটা সম্পূর্ণ বোকামি। কারণ, পশুদের ধর্মপালনের কোনো প্রয়োজন নাই। তাই, সবার আগে এইসব মুনাফালোভী-কালোবাজারিচক্রকে আগে মানুষ হতে হবে। তারপর তাদের মুসলমান হওয়ার কথা ভাবতে হবে। আর চিরদিন মনে রাখতে হবে: নিজস্বার্থে মানুষের গলায় ছুরি চালিয়ে কখনও-কোনোদিন ধার্মিক হওয়া যায় না।
দেশের মুসলমান-ব্যবসায়ীরা রমজান-মাস উপলক্ষে রাতারাতি জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের গলাকেটে অবৈধ উপায়ে অর্থোপার্জন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করছে না। এদের মধ্যে মানবিকসত্তা একেবারে অনুপস্থিত। এদের কারও মধ্যে মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, ভ্রাতৃত্ববোধ কোনোকিছুই দেখতে পাই না। এরা চেনে শুধু টাকা। আজ এদের মনুষ্যত্ব নাই। আর এদের কারও মধ্যে কোনোদিন সামান্য মনুষ্যত্ব ছিল কিনা সন্দেহ। এই অমানুষগুলোই সমাজে-রাষ্ট্রে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য এখন নিজেদের মুসলমান বলে প্রচার করছে। এরা নামে ও জাতে আসলেই মুসলমান। কিন্তু এদের কাউকেই আজ মানুষ বলা যায় না। এইসব স্বার্থপর-অমানুষ শুধু মুসলমান হয়েছে কিন্তু মানুষ হয়নি। তাই, মানুষ না হয়ে এভাবে মুসলমান হয়ে লাভ কী? আর মানুষ না হয়ে এভাবে মুসলমান সেজে লাভ কী?
সাইয়িদ রফিকুল হক
১৮/০৫/২০১৮
(পহেলা রমজান, ১৪৩৯ হিজরী)

একজন সংশয়বাদীর প্রশ্নঃ এসব নির্দিষ্ট নিয়মে এবং নির্দিষ্ট গতিতে কি করে চলে? নাকি কেউ নিয়ন্ত্রণ করে?


শুরুতেই সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ স্পর্শকাতর ও অত্যাধিক অনুভূতি সম্পন্ন মানুষের এই লেখাটি এড়িয়ে যাওয়ায় ভালো। কারণ কারো ঈমান বা আমল নষ্ট করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
উপরের প্রশ্নের ব্যাখ্যা এরকম হবে, আমাদের এই মহাবিশ্ব, মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, কৃষ্ণগহ্বর, উল্কা, ধুমকেতু সহ মহাবিশ্ব বা ইউনিভার্স এর ভেতরে যত উপাদান মজুদ আছে এবং তারা যেভাবে তাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথে একই নিয়মে চলছে এবং মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রাকার একটি গ্যালাক্সির ক্ষুদ্রাকার একটি গ্রহ আমাদের এই পৃথিবী তার যে প্রাকৃতিক নিয়মে স্বাভাবিক ভাবে চলছে তা কি একা একাই চলছে না কেউ একজন এসব নিয়ন্ত্রণ করছে ? এখানে কেউ একজন বলতে এই সৃষ্টিবাদীরা সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বরকে ইঙ্গিত করছে। একটি বিষয় এখানে লক্ষনীয় যে এই প্রশ্নকর্তা এতোটুকু নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন এই পৃথিবীতে প্রচলিত হাজার হাজার ধর্মের কোটি কোটি সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বরের নাম প্রচলিত আছে তাই সে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের নির্দিষ্টি ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার নাম উল্লেখ করেনি তাই প্রশ্নকর্তাকে সংশয়বাদী বলা হচ্ছে।
প্রথমেই একটা বিষয় জানার চেষ্টা করি এমন প্রশ্ন কেনো মানব মস্তিষ্কে তৈরি হয়, এই সৃষ্টিবাদী বা ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষদের নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী শিশুকাল থেকেই শেখানো হয় এই পৃথিবীর সকল উপাদান, এই পৃথিবীর প্রানী জগৎ, প্রকৃতির বহমান নিয়ম ও মহাবিশ্বের সকল উপাদান ও নিয়মই তাদের নিজ নিজ ধর্মের সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টির পর থেকেই সেই সৃষ্টিকর্তা নিজেই এইসব নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এমন অনেক বিশ্বাসী মানুষ আছে তারা তাদের পূর্ণ জীবনে একবারের জন্য বিবর্তনবাদের নাম শুনে নাই। অনেকেই ফেসবুকের মতো বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া ও ব্লগ সাইটে এসে জীবনের প্রথম বিবর্তনবাদ সম্পর্কে জানতে পারছে। হঠাৎ করে এতো বড় পরিবর্তন বা এরকম একটা মতবাদও যে পৃথিবীতে প্রচলিত থাকতে পারে বা আছে এটা দেখে তাদের মস্তিষ্কের এই বিষয়ে আটক থাকা নিউরন গুলা সক্রিয় হয়ে পড়ে। এবং একটা পর্যায়ে তাদের এই জাতীয় প্রশ্নের সাগরে পড়ে যাবার মত অবস্থা তৈরি হয়। কারণ এতোদিন তারা জানতো এই পৃথিবী সহ মহাবিশ্বের সবকিছুই তাদের সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কিন্তু যখন তারা জানছে যে মহাবিশ্ব কোটি কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং এর ফলে সৃষ্ট এবং তারপর থেকে বর্তমানে প্রতিটি ছায়াপথ, গ্রহ, নক্ষত্র তাদের নিজ নিজ গতিতে নিজস্ব কক্ষপথে একা একাই চলছে এবং আমাদের পৃথিবীর সকল প্রাকৃতিক বিষয়ও একা একা ঘটছে যাতে কারও হাত নেই এসব শোনা ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেখার পরে তাদের মাথায় শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরতে থাকে “এসব নির্দিষ্ট নিয়মে এবং নির্দিষ্ট গতিতে কি করে চলে? নাকি কেউ নিয়ন্ত্রণ করে? অর্থাৎ এই জাতীয় প্রশ্ন তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ঘটনা।
আসুন সংক্ষিপ্তভাবে আমরা একটু আলোচনা করে দেখি এই প্রশ্নে যা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, এসব কিভাবে চলছে বা কেউ কি নিয়ন্ত্রণ করছে কিনা বিষয়টি। আমরা জানি মহাবিশ্ব সৃষ্টির একটি তত্ত্ব হচ্ছে বিগ ব্যাং। এই তত্ত্ব অনুসারে ১৩৫০ কোটি বৎসর আগের কোন এক সময় একটি বিশাল বস্তুপিণ্ডের বিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল যাতে কারো হাত ছিলো বা কেউ ঘটিয়েছে সেই বিস্ফোরণ এমন কোন প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পায়নি। ১৯২৭ সালে বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী জর্জ লেমিটর (Georges Lemaître) এই তত্ত্ব প্রথম প্রকাশ করেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে জর্জ লেমিটর এ তত্ত্ব প্রকাশ করলেও এই তত্ত্বকে বিস্তৃত করেন জর্জ গ্যামো। এখন লেমিটরের মতে সৃষ্টির আদিতে মহাবিশ্বের সকল বস্তু আন্তঃআকর্ষণে পুঞ্জীভূত হয় এবং একটি বৃহৎ পরমাণুতে পরিণত হয়। এই পরমাণুটি পরে বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়। এই মতবাদকে সমর্থন ও ব্যাখ্যা করেন এডুইন হাবল (Edwin Hubble)। হাবল পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণ পান যে, মহাকাশের গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমান্বয়ে নির্দিষ্ট গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। তাঁর মতে, আদিতে মহাবিস্ফোরণের ফলে গ্যালাক্সিগুলো সৃষ্টি হয়েছিল এবং এগুলোর দূরে সরে যাওয়ার আচরণ বিগ-ব্যাংকেই সমর্থন করে।
বিজ্ঞানীরা আমাদের পরিষ্কার ধারনা দিয়েছেন, বিগ ব্যাং এর ৩ সেকেণ্ড থেকে ১০০,০০০ বৎসরের মধ্যে সৃষ্ট কণাগুলো শীতল হয়ে উঠে। এই অবস্থায় বস্তুপুঞ্জে বিরাজমান ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন মিলিত হয়ে তৈরি হয় হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমাণু। এ ছাড়া এই দুটি পদার্থের সাথে ছিল প্রচুর ইলেক্ট্রন প্লাজমা। সব মিলিয়ে যে বিপুল বস্তুকণার সমাবেশ ঘটেছিল, সেগুলো প্রচণ্ড গতিতে বিগ ব্যাং-এর কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। এই সময় এই সকল কণিকাও ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত। ক্রমে ক্রমে এগুলো শীতল হতে থাকলো এবং এদের ভিতরের আন্তঃআকর্ষণের কারণে কাছাকাছি চলে এসেছিল। ফলে বিপুল পরিমাণ বস্তুপুঞ্জ পৃথক পৃথক দল গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। এই পৃথক দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পত্তন ঘটেছিল গ্যালাক্সি‘র (Galaxy)। আমাদের সৌরজগতও এরূপ একটি গ্যালাক্সির ভিতরে অবস্থান করছে। এই গ্যালাক্সির নাম ছায়াপথ (Milky Way) যার ভেতরের অনেক গ্রহ আর উপগ্রহের মধ্যে আমাদের এই পৃথিবী একটি। সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এই মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে তাতে কোন সৃষ্টিকর্তার কৃতিত্ব বিজ্ঞানীরা খুজে পায়নি যার অর্থ দাঁড়ায় এসব একা একা চলছে কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে না।

এই মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র একটি গ্যালাক্সি হচ্ছে আমাদের এই সৌরজগৎ যাতে অবস্থান করছে আমাদের বাসগৃহ পৃথিবী। এই পৃথিবীও তার কিছু নিজস্ব প্রকৃতি নিয়ে চলছে শুরু থেকে। একটা সময় এই পৃথিবীতে এক কোষী প্রাণের উৎপত্তি হয়। যাদের মধ্যে দুইটি ভাগ হয়। একটি চলমান হয়ে যায় এবং আরো কয়েকটি কোষের সাথে মিলে খাদ্য সংগ্রহ করতে থাকে। একটি কোষের গায়ে লেগে থাকা আরেকটি কোষ তার থেকে খাদ্য গ্রহন করে বেচে থাকার চেষ্টা করে। এরা ধীরে ধীরে একস্থান থেকে অন্য স্থানে গিয়ে খাবার সংগ্রহ করা শেখে। আজকের পৃথিবীর প্রানী জগৎ এর মধ্যে সমস্ত পশু, পাখি, পোকা-মাকড়, জীব-জন্তু সহ এই পর্যন্ত পৃথিবীতে আবিষ্কার হওয়া ৫৫ লক্ষ প্রাণের মধ্যে আমরা যাদের দেখতে পায় তারা হচ্ছে এই বহুকোষী গোত্র থেকে বিবর্তিত হয়েছিলো। আর সেই শুরুতে যে কোষগুলি একা একাই বেচেঁ থাকার জন্য যুদ্ধ করে গিয়েছিলো একই যায়গায় অবস্থান করে। যারা সূর্যের আলোর থেকে খাবার সংগ্রহ করা শিখেছিলো তারা কোটি কোটি বছরে বিবর্তিত হয়ে আজকের উদ্ভীদ জগৎ হয়েছে। অর্থাৎ আজকের পৃথিবীর সকল গাছ-পালা, লতাপাতা হচ্ছে তারা। বিবর্তনবাদের প্রাণের উৎস পড়লে এসব পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। এখানে শুধুই ধারণা দেবার চেষ্টা করেছি।
পৃথিবীতে সেই শুরু থেকে এই প্রাণের উৎপত্তিতে কোন সৃষ্টিকর্তার হাত আছে কিনা বা এখন যেভাবে বিবর্তনের চলমান ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে তাতে কারো হাত আছে কিনা সেটা কোন বিজ্ঞানী এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি। অর্থাৎ এসব প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মেই চলছে। এখন বর্তমানে কেউ যদি দাবী করে থাকে এসব কেউ একজন নিয়ন্ত্রণ করছে তাহলে সেই কেউ একজনের সৃষ্টি মানুষের মস্তিষ্কে কিভাবে হয়েছে বা এমন ধারণা তারা কেনো করছে তার একটু অনুসন্ধান করা যেতে পারে। সঠিক অনুসন্ধানে পাওয়া যাবে তার উওর। এই পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাবের কয়েকশো কোটি বছর পরে আজ থেকে প্রায় ৩ কোটি বছর আগে মানুষের পুর্বপুরুষ একজাতীয় প্রাইমেট এর অস্তিত্ব তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু পৃথিবীর কোন অঞ্চলে বা কোথায় আসলে এই প্রাইমেটরা প্রথম অবস্থান করছিলো তা নিশ্চিত ভাবে কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেনি। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো মিউজিয়াম অফ সায়েন্স-এর গবেষণা সহযোগী মাইকেল হেডস একটি গবেষণাপত্রে প্রাইমেটদের উৎপত্তির সময়কাল ও স্থান সম্পর্কে একটি নতুন ধারণা ব্যক্ত করেছেন।
এই প্রাইমেট বা একজাতীয় এপ থেকেই ৩ কোটি বছরের ব্যাবধানে বেশ কিছু গোত্র এসে যায় যেমন ধরুন ১০টি শাখার মধ্যে একটি হচ্ছে বানর, একটি ওরাং-ওটাং, একটি সিম্পাঞ্জী, একটি বনমানুষ বা গোরিলা, আর একটি হয়েছিল অস্ট্রালোপিথেকাস গোত্র। মানুষ বা মানব বলতে আমরা যা বুঝি তারা হচ্ছে “হোমো” গোত্রের মধ্যে পড়ছে আর এই হোমো গোত্র এসেছিলো এই অস্ট্রালোপিথেকাস গোত্র থেকে। প্রাইমেট বা এপ এর থেকে ২.৭৫ কোটি বছর পরে অর্থাৎ আজ থেকে আনুমানিক ২৩ লক্ষ থেকে ২৪ লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকাতে “হোমো” অস্ট্রালোপিথেকাস গণ থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল। হোমো গণের অনেক প্রজাতিরই উদ্ভব ঘটেছিল যদিও একমাত্র মানুষ ছাড়া তাদের সবাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হোমিনিড, হোমো-ইরেকটাস, হোমো-হ্যাবিলিশ, হোমো-নেয়ান্ডারথাল এ ধরণের বিলুপ্ত মানব প্রজাতি। এদের মধ্যে রয়েছে হোমো ইরেক্টাস যারা এশিয়ায় বাস করতো এবং হোমো নিয়ানডার্টালেনসিস যারা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। শুধু টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছিলো হোমোস্যাপিয়েন্সরা। আজকের আধুনিক মানুষ অর্থাৎ আমরা যারা নিজেদের মানুষ বলে পরিচয় দেয় এরা যে একরাতে ঘুম থেকে উঠেই দেখলো তারা মানুষের মতো হয়ে গিয়েছে বা তাদের কেউ কাদা মাটি দিয়ে তৈরি করে রোদে শুকিয়ে ফু দিয়ে প্রাণ দান করেছে তা কিন্তু না। সেই বাকী থাকা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে হোমোস্যাপিয়েন্সরা পৃথিবীর প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করেছে এবং টিকে থেকেছে যার কারণে আজকের আপনি আমি আজ এখানে। এই হোমোস্যাপিয়েন্সরা সভ্য হয়েছে খুব বেশিদিন আগে না। মানব সভ্যতার ইতিহাস আজ পর্যন্ত মানুষ যতটুকু আবিষ্কার করতে পেরেছে তা হচ্ছে ৪০ হাজার বছর আগের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া হোমো-নেয়ান্ডারথাল গোত্রের ইতিহাস। তারা সভ্য ছিলো কি ছিলো না এটার পক্ষে যতটুকু প্রমান পাওয়া যায় তা হচ্ছে এরাই প্রথম তাদের মৃত দেহ সমাধি করেছিলো। কিন্তু পরবর্তিতে তারা সবাই বিলুপ্ত হয়ে যায় টিকে থাকে শুধুই হোমোস্যাপিয়েন্স।
এই হোমোস্যাপিয়েন্সদের সভ্যতাকে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছিলেন আমাদের বোঝার সুবিধার্থে তা হচ্ছে, প্রাচীন যুগ, মেসোপটেমিয়া এবং সুমেরীয় জাতি, আধুনিক যুগ (প্রাথমিক পর্ব), আধুনিক যুগ (সাম্প্রতিক পর্ব), সমসাময়িক যুগ (বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ), সমসাময়িক যুগ (বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ), সমসাময়িক যুগ (একবিংশ শতাব্দী), এর মধ্যে প্রাচীন যুগেরও বেশ কিছু ভাগ আছে যেমন, প্রস্তরযুগ, লৌহ যুগ, তাম্র যুগ, কৃষি যুগ এসবই মানুষের সভ্য হবার ইতিহাস বলে আমাদের। কৃষি বিপ্লবের (খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০-খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ) এর মধ্যে সূচনা ঘটে। নব্যপ্রস্তর যুগের বিপ্লবে উদ্ভিদ ও পশুর গৃহপালন এবং নিয়মানুগ কৃষিপদ্ধতি রপ্ত করা মানব সভ্যতার একটি অনন্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটা হচ্ছে মানুষের যাযবর জীবন যাপণ ত্যাগ করে স্থায়ী বসবাসের কথা বলে। কৃষির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শস্য উৎপাদন ব্যবস্থারও বিকাশ ঘটে, যা সমাজে শ্রমবিভাগকে ত্বরান্বিত করে। শ্রমবিভাগের পথ ধরে সমাজে সুবিধাপ্রাপ্ত উচ্চশ্রেণীর উন্মেষ ঘটে ও শহরগুলো গড়ে উঠে যা মানব সভ্যতার প্রথম সভ্যতা বলে পরিচিত। সমাজে জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লিখন ও হিসাব পদ্ধতির ব্যবহার জরুরী হয়ে পড়ে। হ্রদ ও নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের মধ্যে অনেক শহর গড়ে উঠে। এদের মধ্যে উন্নতি ও উৎকর্ষতার দিক দিয়ে মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা, মিশরের নীল নদ তীরবর্তী সভ্যতা (প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা) ও সিন্ধু সভ্যতা উল্লেখ্যযোগ্য। একই ধরনের সভ্যতা সম্ভবত চিনের প্রধান নদীগুলোর তীরেও গড়ে উঠেছিল কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো থেকে এব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়নি।

যতদুর আমরা জানতে পারি তাতে বোঝা যায় এই হোমোস্যাপিয়েন্স বা মানব জাতি আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগে সভ্য জাতির পরিচয় পেয়েছে। তবে সভ্যতার শুরুতেই মানুষ এই ঈশ্বর নামক একটি কল্পিত চরিত্র তৈরি করেছিলো যা মানব সভ্যতার সমাজে ঢুকে গিয়েছিলো। এই যে আজকের দিনের একজন বিশ্বাসী বা সংশয়বাদী বা আজ্ঞেয়বাদীর এই প্রশ্ন, এরকম প্রশ্নের উত্তরেই তখনকার সময়ে এই কল্পিত ঈশ্বর চরিত্রটির সৃষ্টি করেছিলো মানুষেই। তথ্য প্রমাণের উপরে নির্ভর করে এটা কিন্তু বর্তমানে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব। সেই সময়ে মানুষের জ্ঞান যতটুকু বিকোশিত হয়েছিলো তারা যতটুকু পর্যবেক্ষন করে জানতে পেরেছিলো যার উত্তর দেবার মতো ক্ষমতা মানুষের ছিলো সেগুলো বাদে সকল প্রাকৃতিক ঘটনাই তারা ঈশ্বর করছে বা ঈশ্বরের নামের একটি চরিত্রের উপরে চাপিয়ে দিয়ে কিছুটা মুক্তি পাচ্ছে দেখে একজন কল্পিত ঈশ্বরের আগমন ঘটলো মানব সভ্যতায়। মানুষ একটা সময় জানতো না আকাশে বজ্রপাত বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমান বৃদ্ধি হবার কারণে হয় তাই তারা প্রচার করতে শুরু করলো এটা ঈশ্বর করে বা এটা ফেরেশতাদের শয়তানের উপরে তীর নিক্ষেপ। মানুষ একটা সময় জানতো না বৃষ্টি কেনো হয়, জানতো না রাত কেন হয়, দিন কেন হয়, মানুষের জন্ম কিভাবে হয়, মানুষ কিভাবে আসলো পৃথিবীতে, সুর্য কি, চাঁদ কি, সুমদ্র কিভাবে সৃষ্টি হলো, এসব একই নিয়মে কিভাবে চলছে ? এরকম নানান প্রশ্ন মানুষের মনে তৈরি হতে থাকে। মানুষ যতটুকু পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে জানতে সক্ষম হয় ততটুকু ব্যাখ্যা করে আর যতটুকু সে জানতে পারেনা যার কারণে সে লজ্জা, হতাশা আর না জানার অজ্ঞতা থেকেই তৈরি করে ফেলে ঈশ্বর নামের একটি চরিত্র। এবং প্রচার করতে থাকে ঈশ্বর এসবের স্রষ্টা তিনিই এইসব সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই এসব নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
আসলে কিন্তু বর্তমান যুগে বিজ্ঞান ব্যাবহার করে মানুষ এই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাকৃতিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম। সদ্য স্থাপন করা বাংলাদেশের যে স্যাটেলাইট সেই রকম স্যাটেলাইট দিয়ে পৃথিবীর আগাম আবহাওয়া বার্তা বা সতর্ক সংকেত মানুষ পাচ্ছে। কৃত্রিম মেঘ সৃষ্টি করে বৃষ্টিও ঝরাতে পারে মানুষ। বিজ্ঞানীরা এসব প্রাকৃতিক নিয়ম নিজেদের আয়ত্তে করতে গিয়ে এমন কারো সাথে সাক্ষাত করার সুযোগ পায়নি যে এসব সৃষ্টি করেছে বা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে দাবী করেছে। প্রকৃতিকে মানুষ নিয়ন্ত্রন করছে সেই প্রকৃতিকে ব্যাবহার করেই। আগে মানুষ প্রকৃতির আসল নিয়ম জানছে এবং পরে একই নিয়মে তা গঠন করছে এবং মানব সভ্যতার জন্য ব্যাবহার উপযোগী করে তুলছে। শুধু যে পৃথিবীর প্রকৃতি থেকে মানুষ উপকারিতা নিচ্ছে তা নয় সৌরশক্তির ব্যাবহারও মানুষ করছে। এসব করতে গিয়ে তারা কোন নিয়ন্ত্রক বা কেউ একজন এসব নিয়ন্ত্রণ করছে এমন কারো সন্ধান পাচ্ছে না। তাই বলা যায় এসব কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে না। সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই এসব পরিচালিত হয়ে আসছে।
মৃত কালপুরুষ
২৩/০৫/২০১৮

ঈশ্বর, জীবন এবং কিছু উপলব্ধি

সর্বপ্রথম যখন ঈশ্বরের অস্তিত্বে প্রশ্ন জাগে,তখন আমার বয়স ১৫ বছর।
যখন একদম শিশু, কেবল বুঝতে শিখেছি,তখন টিভি তে ফকির আলমগীরকে দেখে আল্লাহ ভেবেছিলাম। গায়কের গুরুগম্ভীর গলা, ঝাঁকড়া চুল আর অদ্ভুত দেহভঙ্গিমাকে শিশুমনে ঈশ্বর হিসাবে গগ্রহণ করেছিল। হুজুরের কাছে কোরান শিখতে গিয়ে সেই ভুল ভেঙে গেল। কোন প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না,বিশ্বাস করেছিলাম ঈশ্বরের কথা। যিনি আমার জন্ম, জীবন, মৃত্যু এবং পরকালের নির্ধারক।
বয়ঃসন্ধিকালের উন্মাতাল সময়গুলোতে কিছু প্রশ্ন তীব্র যন্ত্রণা দেয়া শুরু করল। প্রথম যে প্রশ্ন আমাকে ঈশ্বরের অস্তিত্বে উদাসীন করেছিল, তা হল-ঈশ্বর এত শক্তিমান, কিন্তু আমার মত করে ভাবেন কেন? তাকে না মানলে তার রাগ হয়,শাস্তি পেতে হয়। তাকে তুষ্ট করলে অনেক কিছু পাওয়া যায়। তার চাওয়া আর আমার চাওয়ার মাঝে তো তফাৎ নেই।
আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এরচেয়ে জটিল অনেক প্রশ্নই অনেক কিশোরের মাথায় ঘোরে,ঘুরবে। সমস্যা হল, এসব প্রশ্নের উত্তর কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় না। যায় না ভয়ে।শুরুতে ভয় পেলাম। ঈশ্বরের খেলা বোঝার বুদ্ধি তো আমার নেই। না জেনে অস্বীকার করার পাপে বেহেশত তো যাবেই,ইহকালটাও না নষ্ট হয়।
ভয় সর্বদাই কৌতুহলের চেয়ে দুর্বল অনুভূতি।ঈশ্বরকে জানা বা অস্বীকার করার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না।শুধু ভাল লাগে, এজন্য বই পড়তাম।পড়ার তালিকায় ছিল বিজ্ঞান,গণিত এবং সাহিত্য।দিন যত যাচ্ছিল,আমি ততই সাহসী হয়ে উঠছিলাম।এই সাহস দুঃসাহসে রূপ নিল ১৬ বছর বয়সে। অনেক কিছু না জেনেই ঈশ্বর বিশ্বাসে ঘাটতি চলে এল।
আমার মনোজগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই ছিল খুশবন্ত সিং এর উপন্যাস “দিল্লী”। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র,গণিতে দক্ষ ছিলাম। বিজ্ঞানের,বিশেষ করে পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র এবং পদার্থবিজ্ঞানীদের ঈশ্বর অনীহার সংস্কৃতিতে আমি মজেছিলাম। কিন্তু আমার জীবন আমূল বদলে যায় দিল্লী বইটি পড়তে গিয়ে।সেখানে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কিছু লেখা ছিল না। ধর্ম উপন্যাসের মূল বিষয় ছিল না।কিন্তু অধর্ম ছিল সেই উপন্যাসের আর্তনাদ। সেইসময় প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদকে একুশের বইমেলা প্রাঙ্গণে কোপানো হয়।সেই ঘটনার আগে পর্যন্ত প্রথাবিরোধী লেখকদের সম্পর্কে বেশী কিছু জানতাম না। হুমায়ুন আজাদের লেখা “পাক সার জমিন সাদ বাদ” পড়া শুরু করেছিলাম, ভাল লাগল না। আমি আগ্রহ হারাচ্ছিলাম। অনাগ্রহের কারণ, খুব সম্ভব মজ্জাগত সংস্কারের ধারা থেকে তখনও বোধহয় বের হতে পারি নি।
বিজ্ঞানের ছাত্র,যার নেশা সাহিত্য,মন রোমান্সে ভরপুর-এধরণের ছেলেরা জীবনের শুরুতে অনেক ভুল করে ফেলে। আমিও করলাম।জীবনের কষ্টকর মুহুর্তগুলোতে গভীরভাবে ঈশ্বরকে স্মরণ করলাম,শান্তি পাই নি। বরং অশান্তি পড়ার নেশাকে আক্রমণ করল। যেই লেখালেখি ছিল আনন্দের উৎস, সেই লেখার ইচ্ছাও হত না। মনের মাঝে তীব্র ভীতি, এর নাম ঈশ্বর ভীতি।ঈশ্বরকে অস্বীকার করে আমি কি পাপ করেছি-এধরণের ভাবনা মাথায় ঘুরতে থাকল।
আগেই বলেছি,সাহিত্য ছিল আমার নেশা।নেশা কেটে যায়,নেশার রেশ সহজে যায় না।আবারও সেই বুড়ো শিখ,যাকে আমি কোনদিন দেখি নি, আমাকে অন্ধকার থেকে টেনে তুললেন।খুশবন্ত সিংয়ের আত্মজীবনীগ্রন্থ “ট্রুথ,লাভ এন্ড লিটল ম্যালিস” এর শেষাংশ আমার হারানো কৈশোর ফিরিয়ে দিল।ঈশ্বরের ব্যাপারে আমি আবার চিন্তা করা শুরু করলাম। এবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলাম, শেষটা যেন দেখতে পারি।
বিজ্ঞান মানুষকে সর্বোত্তম শিক্ষা দিয়েছে।সেটা হল,প্রশ্ন করার শিক্ষা।উত্তর খোজার আকাঙ্ক্ষা এর স্বাভাবিক ফলাফল। সেই শিক্ষা পূর্ণ হতে শুরু করল। কিন্তু পানি ততদিনে অনেকদূর গড়িয়ে গেছে।
খোদ বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদ,অজ্ঞেয়বাদ,প্রচলিত ঈশ্বরে অবিশ্বাস প্রকাশ্যেই চর্চিত হচ্ছিল এবং বেশ জোরেসোরেই। ইন্টারনেট, ব্লগ, ফেসবুকের কল্যাণে খুব দ্রুত ধারণাগুলো ছড়াতে শুরু করল। ধর্মীয় প্রত্যাঘাতও শুরু হল। আমার কাছে এতদিন যা ছিল জ্ঞানের ক্ষেত্র, সেখানে ধর্মীয় আঘাত আসা শুরু হল।
ধর্মীয় প্রত্যাঘাত ঈশ্বরের প্রতি আমাকে আরও বিমুখ করেছে। ধর্মীয় উন্মাদনার শিকার ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলেছে। পৃথিবীর সকল অসহায়,নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদ আমাকে ঈশ্বরের অনস্তিত্ব সম্পর্কে দৃঢ়তা দিয়েছে। কোন সৃষ্টিকর্তা নিষ্পাপ শিশুর জীবন নিয়ে রক্তহোলী খেলতে পারেন না। রক্তের গন্ধ কখনোই ফুলের সুবাসের মত হতে পারে না।
ভারতবর্ষের ইতিহাস,পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের ইতিহাসের মতই।এখানে দেশী এবং বিদেশী বিভিন্ন ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাদের লোভকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য ধর্ম তৈরী এবং প্রচার করেছে। নিষ্ঠুরভাবে ধর্মকে ব্যবহার করতে তাদের একটুও বাধে নি। লক্ষ লক্ষ মানুষ জাতীয়তাবাদের উগ্রতায় একে অপরকে হত্যা করেছে। দেশের সীমারেখা আর ধর্মের সীমারেখা এক হয়ে গেছে। সেসব হিংস্রতা, বন্য জন্তুর হিংস্রতার চেয়ে সহস্রগুণে ভয়ংকর।
ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে,কাজ করতে গিয়ে অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে।এমনকি, যাদের কাছে ধর্ম শুধুমাত্র পরকালের আশা,সেইসব নিরীহ মানুষেরাই সবচেয়ে বেশীবার ধর্মের বলি হয়েছে। অথচ ঈশ্বরকে মেনে,ধর্মীয় আচার পালন করেও যেই ব্যাক্তি অবলীলায় খুন ধর্ষণ করেছে,তার বিচার খোদ সর্বশক্তিমানও করেন নি। আমি যৌক্তিক ভাবেই মনে করি না, যে হত্যাকারীর বিচার দোযখে হবে। দোযখের সহস্র বছরের আগুনও তাদের নিষ্ঠুরতার বিচার করতে অক্ষম।
আমি সেই মুহুর্তে সর্বশক্তিমানের অস্তিত্ব মেনে নিব, যখন তিনি পৃথিবীর সকল শিশুকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবেন। হোক সেটা বোমা হামলা কিংবা ক্যান্সারে। ক্যান্সার রোগীদের কষ্টগুলো উপলব্ধির বাইরে।সেটাতে শিক্ষণীয় কিছু থাকাকে আমি অবিশ্বাস করি। ধর্মীয় উন্মাদনা,জাত্যাভিমান আর ভোগের লোভে উন্মত্ত মানুষদের প্রতি আমি করুণা বোধ করি। সাদাত হোসেন মান্টোর লেখা “পাগল বিনিময়” গল্পের পাগলেরা পৃথিবীর ক্ষতি করে না। বরং ধর্মান্ধ উন্মাদের দলই পৃথিবীকে পাগলা গারদ বানাতে চায়।
এই উন্মাদনার শেষ আমি দেখতে চাই। এতে যদি আমি ভুল প্রমাণিত হই, যে ঈশ্বর বর্তমান,তাতেও আমার কোন খেদ নেই।আমার দন্দ্ব সর্বশক্তিমানের অস্তিত্বের চেয়ে ধর্মের সাথে লক্ষ কোটিগুণে বেশী। সৃষ্টিকর্তা বলে যদি কিছু থাকেনও, আমি নিশ্চিত জানি তিনি আমার মত পাগলদের সাথেই থাকবেন।
(সম্মান জানাই সেই সকল চিন্তাবীরদের,যাদের চিন্তার ব্যাপ্তি ঈশ্বরকে অতিক্রম করেছে।)
লেখকঃ কয়েস আলী
বোশেখ মাস, আকাশ পরিষ্কার, বায়ু স্তর। রাতটি ছিল অতি গরমের। বৈঠকঘরের বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি ; ঘুম আসে না গরমে। মনে হয় যেনো জাহাজে বয়লারের কাছে শুয়েছি অন্যত্র জায়গা না পেয়ে। মনটা ছোটাছুটি করছে তাপের লেজ ধরে কল্পনাজগতের নানা পথে। ভাবছি তাপ দুপ্রকার – কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক। কৃত্রিম তাপ কমানো যায়, বাড়ানো যায়, নতুবা তাপের উৎস থেকে দূরে সরে যাওয়া যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক তাপের বেলায় সবসময় তা পারা যায় না। আজকের এ তাপের উৎস হচ্ছে সূর্য। যার স্থানীয় তাপমাত্র ৬০০০ হাজার ডিগ্রী (সে) এবং দূরত্ব ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল। শোনা যায় যে, দোজখের আগুনের তাপ নাকি সে আগুনের চেয়ে ৭০ গুণ বেশী। অর্থাৎ ৪,২০,০০০ ডিগ্রী (সে) এবং তা হবে মানুষের কাছে দূরত্বহীন। কেননা সে আগুনের ভিতরেই নাকি থাকতে হবে তাবৎ বিধমী বা অধাৰ্মিক মানুষকে। তা-ও আবার দশ-বিশ বছর নয়, অনন্তকাল। মানুষের এহেন কষ্টভোগের কারণ নাকি একমাত্র শয়তান। তাই বিশ্বাসী মানুষ মাত্রেই শয়তানের উপর অত্যন্ত ক্ষ্যাপা।
শয়তান নাকি পূর্বে ছিলো ‘মকরম’ নামে একজন প্রথম শ্রেণীর ফেরেস্তা এবং অত্যন্ত মুছল্লি। সে নাকি এতই খোদাভক্ত ছিলো যে, জগতে এতটুকু স্থান বাকি নেই, যেখানে তার সেজদা পড়েনি। কিন্তু আল্লাহতালার হুকুম মোতাবেক নাকি বাবা আদমকে সেজদা না করায় তার ফেরেস্তার পদ ও মর্যাদা নষ্ট হয়। তাই সে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে বাবা আদম ও তার বংশাবলীকে দাগা অর্থাৎ অসৎকাজে প্ররোচনা দিয়ে নাকি দোজখী বানাচ্ছে। সামান্য পদমর্যাদা হানির বিনিময়ে গোটা আদম জাতির অগণিত মানুষের দোজখবাসের কারণ হয়ে থাকলে শয়তান তো মানুষের সাধারণ শক্র নয় – মহাশক্র, পরমশক্র, মহাপরমশক্রই বটে। শয়তানের স্বভাব-চরিত্র, কার্যকলাপ ও বাসস্থান সম্বন্ধে ভাবতে ভাবতে শেষরাত্রে গরমটা কিছু কমে যাওয়ায় আরাম বোধ করতে লাগলাম এবং মনের ভাবনাগুলোও স্তিমিত হলো। এ সময় শুনতে পেলাম, কে যেন কোমল কণ্ঠে মৃদুস্বরে আমাকে দরজা থেকে ডাকছে।
আমি দূর থেকে দেখতে পেলাম আগন্তুক আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সে এক সৌম্য মূর্তি। পরনে সাদা পাজামা, গায়ে সাদা জুব্বা, মাথায় (লেজওয়ালা) সাদা পাগড়ী এবং বুক ভরা সাদা দাড়ি, সুঠাম সুডৌল তেজোদীপ্ত চেহারা। তাঁর চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে আনন্দ ও বুদ্ধির জ্যোতি। জীবনে এমন মানুষ কখনো দেখিনি, কোনরূপ আবেগ উৎকণ্ঠ নেই, নতুন স্থান বলে নেই কোন কিছু নিরীক্ষণের প্রয়াস। এখানের পথঘাট, গাছপালা ও ঘরবাড়ি যেনো তার সবই চেনা। ভাবলাম, লোকটা আলেম তো হবেনই, মুছল্লিও বটেন। কিছু দূরে থাকতে তিনি আমাকে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানালেন, কাছে গেলে করমর্দন করলেন। আমি আমার বৈঠকঘরে প্রবেশ করে একখানা চেয়ার দেখিয়ে সসম্প্রমে তাঁকে বললাম – বসুন জনাব।
আগন্তুকটির পরিচয় জানার আগ্রহ নিয়ে আমি তার দিকে দৃষ্টিপাত করতে তিনি তা যেনো বুঝে ফেললেন এবং আমাকে বললেন, “আমার পরিচয় জানতে চান? আমার পরিচয় আপনি ভালো করেই জানেন। আর আপনি একাই নন, আমার পরিচয় সকল মানুষই জানে এবং ভালোভাবেই জানে। কিন্তু কেউ আজ পর্যন্ত আমাকে দেখেনি, দেখেননি আপনিও। পৃথিবীর জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সবখানে আমার অবাধ গতি। আমি সকল মানুষের সাথেই মেলামেশা করতে চাই, চাই ভালোবাসা করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার সাথে কেউ মেলামেশা করতে চায় না। আমার মাতাপিতা নেই ; ছিলোও না কোনোদিন। আমি আল্লাহতালার নূরে তৈরী, কুদরতে সৃষ্টি, জন্মসূত্রে আমার নাম ‘মকরম ফেরেস্তা, পরে ইবলিশ এবং হাল নাম শয়তান।”
আগন্তুকের নামটি শুনে আমি ভড়কে গেলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম যে, তার সাথে আমি কি কথা বলবো এবং কিভাবে বলবো। কোনো বিষয় কিছু ভাবতে সাহস হচ্ছে না। কেননা তিনি যেনো আমার মনের ভাবনাগুলোও দেখতে পাচ্ছেন। স্থির করলাম – কিছু ভাববো না, বলবো না কিছু নীরব-নিশ্চিন্তে শুনে যাব শুধু, যা বলবার তিনিই বলুন। এখন সমস্যা হলো যে আগন্তুককে সম্মান প্রদর্শন করবো কি করবো না। তবে বেশ-ভূষায় তো সম্মানের পাত্রই বটেন।
আমার মৌনভাব দেখে আগন্তুক যেনো আমার মনের কথা সমস্তই বুঝতে পারলেন এবং অনর্গল বলে যেতে লাগলেন, “যে কোন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে মুরব্বি বলা হয় এবং সভাসভ্য তাবৎ মানুষ জাতির মধ্যেই মুরব্বি ব্যক্তি সম্মানের পাত্র। মানুষের মধ্যে কারো কোনো মুরব্বি ব্যক্তির বয়সের জ্যেষ্ঠতা সচরাচর দশ-বিশ কিংবা পঞ্চাশ-ষাট বছর, কদাচিৎ একশ’। কিন্তু আপনাদের আদি পিতা আদম যখন সৃষ্ট হন, আমি তখন বেশ সেয়ানা এবং আজো বেঁচে আছি। সুতরাং বয়সের হিসাবে শুধু আপনারই নয়, আমি সমস্ত মানুষ জাতির মুরবিব।
“আল্লাহ সর্বাগ্রে ফেরেস্তা বানিয়েছেন, পরে জীন বানিয়েছেন এবং সর্বশেষে বানিয়েছেন আদমকে। ইসায়ীরা সৃষ্টিকর্তাকে ‘পিতা বলেই সম্বোধন করে থাকে। কাজেই একই ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে আদমকে আমার ভাইও বলতে পারি, তবে বয়সে কনিষ্ঠ। আপনাদের সমাজে বা মানব সমাজে কারো কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে প্রণাম (সেজদা) করবার রীতি আছে কি? হয়তো নেই। তা হলে আদমকে সেজদা না করে আমি নীতিবহির্ভূত কাজ করিনি, করেছি আল্লাহতালার আদেশ লঙ্ঘন। কিন্তু আদেশ যিনি করেছেন, তা লঙ্ঘন করার শক্তিও তিনিই দান করেছেন। জগতে কারো এমন কোনো শক্তি নেই, যার সে শক্তি দ্বারা আল্লাহর ইচ্ছাশক্তিকে পরাস্ত করে নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কার্যকরী করতে পারে। আল্লাহ জানতেন যে, আমি তাঁর হুকুমে আদমকে সেজদা করবো না, আদম তাঁর নিষেধ মেনে গন্ধম খাওয়া ত্যাগ করবে না এবং আদমের আওলাদরা তাঁর আদেশ-নিষেধ কেউ মানবে, কেউ মানবে না। তা না জানলে তিনি আদমকে সৃষ্টি করার পূর্বে, বিশেষত আমাকে শয়তান বানাবার পূর্বে বেহেস্ত-দোজখ নির্মাণ করলেন কি করে, কি জন্য ?
“আমি লাখো লাখো বছর আল্লাহকে সেজদা করে এসেছি, এখনো করি। আমি বেঁচে থাকতে আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করবো না, এ কথা তিনি জানেন এবং তিনি নিজেও বলেছেন, “আমাকে ভিন্ন অন্য কাউকে সেজদা করো না। আল্লাহর আসনে অন্য কাউকে বসালে তাতে তার গৌরব বাড়ে কি-না, তা তিনিই বোঝেন। তথাপি তিনি আদমকে সেজদা করার জন্য ফেরেস্তাদের হুকুম করার কারণ — এটা তার লীলা অর্থাৎ অন্তরের বাণী নয়।
“আল্লাহ সাতটি দোজখ বানিয়েছেন, সবগুলোতে মানুষ থাকার জন্য। তিনি কি চান যে, আমি আমার দাগাকাজ বন্ধ করি, আর তার দোজখগুলো খালি থাক? তা তিনি চান না, চাইতে পারেন না। চাইলে তাঁর দোজখ বানাবার সার্থকতা ক্ষুন্ন হয়। আল্লাহর ইচ্ছা যে, কিছুসংখ্যক মানুষ দোজখবাসী হোক। আর আমাকে বলেছেন তার সেই ইচ্ছা পূরণে সহায়তা করতে। এ কাজ আমার পক্ষে করা ফরজ, না করা হারাম।
“আমি আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারি না, কেউই পারে না। বহু চেষ্টা করেও কোনো নবী-আম্বিয়া, দরবেশকে আমি দোজখবাসী করতে পারিনি। কেননা তাঁরা দোজখবাসী হোন, তা আল্লাহর ইচ্ছা নয়। পক্ষান্তরে হজরত ইব্রাহিম নমরুদকে, হযরত মুসা ফেরাউনকে এবং শেষ নবী (দ:) আবু জেহেলকে হেদায়েত করে বেহেস্তের তালিকায় নাম লেখাতে পারেননি আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও। কেননা তা আল্লাহর ইচ্ছা নয়।
“আপনারা মনে করেন যে, আল্লাহর যতো সব রহমত মানুষের উপরই বর্ষিত হয়। বস্তুত তা নয়। আল্লাহর রহমত আমার উপর অনেক বেশী মানুষের তুলনায়। আদমকে সৃষ্টি করার কতো লাখ বছর পূর্বে আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তা তিনিই জানেন। অথচ আল্লাহর রহমতে আমি আজও বেঁচে আছি। কিন্তু মানুষ বেঁচে থাকে মাত্র ৬০, ৭০ কিংবা ১০০ বছর। তদুপরি শিশুমৃত্যু-অপমৃত্যু যথেষ্ট। আমার সুদীর্ঘ জীবনে আজ পর্যন্ত আমি কোনোরূপ রোগ, শোক বা অভাব ভোগ করিনি, আল্লাহর রহমতে। কিন্তু মানুষ অসংখ্য রোগ, শোক ও অভাবে জর্জরিত। ফেরেস্তারা আমাকে লক্ষ্য করে তীর ছেড়েন আবহমান কাল থেকে। অথচ আল্লাহর রহমতে আমি নিরাপদেই থাকি। কিন্তু তাতে (বজ্রপাতে) ধ্বংস হয় সবকিছু মরে মানুষ। পবিত্র মক্কায় গিয়ে হাজী সাহেবরা আবহমানকাল আমায় লক্ষ্য করে পাথর ছোড়েন। কিন্তু আল্লাহর রহমতে তা আজ পর্যন্ত আমার গায়ে পড়েনি একটিও। অথচ সমুদ্রে জাহাজ ডুবে অসংখ্য হজযাত্রী মারা যান, আল্লাহর রহমতে।
“আল্লাহর রহমতে আমি নিমেষে বিশ্বভ্রমণ করতে পারি, অদৃশ্যকে দেখতে, শ্ৰবণাতীতকে শুনতে, নিজে অদৃশ্য থেকে অন্যের মনের খবর জানতে। দুদিন অনিদ্রা-অনাহারে থাকলে মানুষ ঝিমিয়ে-নেতিয়ে পড়ে। আর আমি লাখ লাখ বছর ধরে অনিদ্রা-অনাহারেও সুস্থসবল আছি, সে তো আল্লাহর রহমতেই। বলা যাবে যে, মানুষ তো ওর অনেক কিছুই আয়ত্ত করে ফেলেছে। অণুবীক্ষণ, দূরবীক্ষণ, রেডিও, টেলিভিশন, রকেট ইত্যাদি যন্ত্র দিয়ে মানুষ এখন অদৃশ্যকে দেখছে, শ্রবণাতীতকে শুনছে, আকাশে-পাতালে ভ্রমণ করছে, অনাহারে বেঁচে থাকার গবেষণা চালানো হচ্ছে এবং কেউ তো অন্যের মনের ভাবও জেনে নিচ্ছে টেলিপ্যাথির সাহায্যে। এসব মানুষ আয়ত্ত করছে সত্য, হয়তো আরো অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করবে। কিন্তু সে সমস্ত যারা করেছেন ও করবেন, তাঁরা তো আমারই শিষ্য।”
“কোনো মানুষের অকল্যাণ আমার কাম্য নয় এবং তা করিও না। পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতে এমন কতোগুলো বিধি-নিষেধ রয়েছে, যা মানুষের অকল্যাণই করে এসেছে আবহমান কাল থেকে। তাই মানুষের কল্যাণ কামনায় সে সব বিধি-নিষেধ অমান্য করার জন্য আমি মানুষকে প্রেরণা ছি। কেননা সেসব বিধি-নিষেধ লঙ্ঘন করার জন্য মানুষকে প্রেরণা দেওয়াই আমার কাজ। আর তারই ফল আধুনিক জগতে মানব জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ক্রমোন্নতি। তথাকথিত ধর্মগ্রন্থগুলোতে আকাশতত্ত্ব, রসায়নতত্ত্ব, ভূ-তত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, প্রাণতত্ত্ব ইত্যাদি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য যাবতীয় তত্ত্বালোচনাই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, ঘোষিত হয়েছে স্বর্গ ও নরক-তত্ত্ব, বিশেষভাবে।
“মানুষ আজ সমুদ্রতলে বিচরণ করে, আকাশে পাড়ি জমায়, পরমাণুগর্ভে প্রবেশ করে এবং কতো অসাধ্য সাধন করে, কিন্তু এর কোনোটাই ধর্ম বা ধমীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে শিক্ষা দেয়নি, বরং নিষেধ করেছে বারে বারে। আমার কর্তব্য বিধায় ওসব আমিই শিক্ষার প্রেরণা দিয়েছি ও দিচ্ছি মানুষকে, আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু তাতে শুধু অধাৰ্মিকরাই লাভবান হয়নি, ধর্ষকরাও ভোগ করছেন তার সুযোগ-সুবিধাগুলো পুণ্যার্জনের জন্য। জল, স্থল ও হাওয়াই যানের সাহায্য ছাড়া শুধু পদব্রজে পবিত্র হজ্জব্রত পালনে হাজীদের সংখ্যা কতোজন হতো, তা হিসেব করে দেখেছেন কি? বর্তমানে ওয়াজে, আজানে, পবিত্র কোরান তেলাওয়াতে, জানাজার নামাজেও মাইক, রেডিও, টেলিভিশন ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে পুণ্যের মাত্রা নিশ্চয়ই বাড়ছে। সুতরাং শুধু পাপকর্মের দ্বারা দোজখে যাবার জন্যই নয়, পুণ্যকর্মের দ্বারা বেহেস্তে যাবার জন্যও আমি মানুষকে সহায়তা করছি না কি? এছাড়া আমি হামেশা আল্লাহকে স্মরণ করি, তার হুকুম পালন করি, তাঁর এবাদত করি, কিন্তু দোজখ থেকে পরিত্রাণ বা বেহেস্ত লাভের প্রত্যাশায় তা করি না। কেননা দোজখের শাস্তি ও বেহেস্তের সুখ আমার কাছে অকেজো। যেহেতু নূরের তৈয়ারী দেহ আমার আগুনে জ্বলবে না এবং আহার-বিহার নিদ্রা ইত্যাদি না থাকায় (বেহেস্তের) সুখাদ্য ফল, সুপেয় পানীয়, স্বর্ণপুরী, সুন্দরী ললনা (হুর-গেলমান) ইত্যাদি আমার কোনো কাজেই আসবে না। পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি জীবমাত্রেই আল্লাহর এবাদত করে থাকে। কিন্তু তারাও দোজখের ভয়ে বা বেহেস্তের লোভে তা করে না। অথচ মানুষ তা-ই করে থাকে। ধর্মের নিশানধারীদের মধ্যে হাজারে বা লাখে এমন একজন মানুষ মিলবে কি-না সন্দেহ, যিনি নিছক আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই পুণ্যকাজ করেন, যার সাথে বেহেস্তদোজখের সম্পর্ক নেই। যারা দোজখের ভয়ে বা বেহেস্তের লোভে পুণ্যকাজ করে, তারা আমার চেয়ে অধম, পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট।
“এ যুগের মানুষ আপনি, হয়তো কম্পাস দেখেছেন। ওর কাটার একটা প্রান্ত সর্বদা পৃথিবীর উত্তরে সুমেরুর দিকে এবং অপর প্রান্ত দক্ষিণে কুমেরুর দিকে স্থির হয়ে থাকে। কেউ ওর ব্যত্যয় ঘটাতে পারে না। নাড়াচাড়া বা জোরজুলুম করে সাময়িকভাবে ওর কিছু ব্যত্যয় ঘটালেও, ছাড়া পেলে কাঁটা স্থির হয় গিয়ে সাবেক বিন্দুতে। কোনো কম্পাসের কাঁটাদ্ধয়ের কোন প্রান্ত সুমেরু ও কোন প্রান্ত ‘কুমেরু মুখী থাকবে, তা নির্ধারিত হয় তার সৃষ্টিকর্তার (নির্মাতার) দ্বারা তখনই যখনই তিনি কাঁটটিকে সৃষ্টি করেন অর্থাৎ যখন কাঁটাটিকে ধন (পজিটিভ) ও ঋণ (নেগেটিভ) ধর্মী দুটি আলাদা জাতের বিদ্যুতের দ্বারা চুম্বকায়িত করেন। কোনো সাধারণ মানুষের সাধ্য নেই কম্পাসের কাঁটার দিকপাতনে ব্যত্যয় ঘটাবার, একমাত্র তার সৃষ্টিকর্তা (নির্মাতা) ছাড়া। অনুরূপভাবেই মানুষের মানসরাজ্যেরও ‘সু’ ও ‘কু দুটি মেরু আছে। তবে তাকে মেরু বলা হয় না, বলা হয় প্রবৃত্তি। অর্থাৎ সুপ্রবৃত্তি এবং কুপ্রবৃত্তি। সুপ্রবৃত্তি থাকে বেহেস্তমুখী এবং কুপ্রবৃত্তি থাকে দোজখমুখী হয়ে। মানবমনের এরূপ বৃত্তিবিভাগ করেছেন আল্লাহতা’লা মানবসৃষ্টির বহু পূর্বে। যে সময়টিতে আল্লাহ এ বিভাগ দুটি নির্ধারণ করেছেন, সে সময়টিকে বলা হয় ‘রোজে আজল বা ‘নিয়তি |
“রোজে আজল-এ নির্ধারিত ফলাফলের বিরুদ্ধে দাগ দিয়ে কোনো মানুষকে আমি দোজখী বানাতে পারি না এবং কোনো ধর্মপ্রচারকও হেদায়েত করে কোনো মানুষকে বেহেস্তবাসী করতে পারেন না। তবে সাময়িক মনের পরিবর্তন ঘটানো যায় মাত্র। কোনো কম্পাসের কাঁটাকে নেড়েচেড়ে বা জোর করে মেরুভ্রষ্ট করা হলে, ছুট পেলে পুনঃ যেমন সাবেক মেরুতে চলে যায়, মানুষের মানসকাঁটাও তদুপই সুমেরুমুখী কোনো মানুষকে দাগ দিয়ে তার দ্বারা আমি অসৎকাজ করাতে পারি, এমন কি তাকে ‘কাফের নামে আখ্যায়িত করাতেও পারি। কিন্তু পারি না তার জীবনসন্ধ্যায় তওবা পড়ে মোমেন হয়ে বেহেস্তে যাওয়া রোধ করতে। অনুরূপভাবেই কুমেরুমুখী কোনো মানুষকে হেদায়েত-নছিহত করে তার দ্বারা কোনো ধর্মপ্রচারক সৎকাজ করাতে পারেন এবং তাকে আখ্যায়িত করতে পারে মোমেন নামে। কিন্তু তিনি পারেন না তার অন্তিম মুহুর্তে ‘বেঈমান হয়ে দোজখে যাওয়া রোধ করতে। এভাবে অনেক সমাজী কাফের বেহেস্তে যাবে। যাবে ‘সমাজী মোমেন দোজখে।
“আল্লাহ র্যাকে দোজখবাসী করতে চান না, আমি শত চেষ্টা করেও তাঁকে দোজখী বানাতে পারি না। লক্ষাধিক নবী-আম্বিয়াদের প্রত্যেককেই আমি দাগ দিতে চেষ্টা করেছি এবং কিছু কিছু সফলও হয়েছি। কিন্তু আমি কাউকে দোজখী বানাতে পরিনি।
“আমার দাগায় পড়ে তারা সামান্য গুনাহ যা করেছেন, আল্লাহ তার শাস্তি প্রদান করেছেন এ দুনিয়াতেই, পরকালে তাঁরা সবাই থেকেছেন নিষ্পাপ। যেমন – হযরত আদমের বেহেস্ত থেকে দুনিয়ায় নির্বাসন, হযরত ইউনুসের মৎস্যগর্ভে বাস, হযরত আইউবের বিমার, শেষ নবী (দ) এর খাদান শহিদ ইত্যাদি উক্তরূপ পাপেরই শাস্তি।
“আজ পর্যন্ত আমি আল্লাহতালার মাত্র একটি হুকুমই অমান্য করেছি। তাঁর হুকুমে আদমকে সেজদা না করে। আর অন্য কজনও তো তাঁর হুকুম অমান্য করেছে প্রায় একই সময়, একই জায়গায় থেকে। কিন্তু সেজন্য তিনি রাগ করেননি বা কাউকে কোনোরূপ শাস্তি দেননি। জেবরাইল, মেকাইল ও এস্রাফিল ফেরেস্তাত্রয়কে আল্লাহ হুকুম করেছিলেন পৃথিবী থেকে মাটি নেবার জন্য, আদমকে বানাবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু একে একে তিন ফেরেস্তাই আল্লাহর হুকুম খেলাপ করে ফিরে গেলেন তাঁর কাছে খালি হাতে, মাটির অসম্মতির জন্য। অবশেষে আজরাইল ফেরেস্তা আল্লাহর আদেশ মোতাবেক জোরপূর্বক কিছু মাটি নেওয়ায় তদ্বারা আদমকে বানানো হলো। কিন্তু চারবার আদেশ অমান্য সত্ত্বেও আল্লাহ মাটিকে (দোজখের) আগুনে পোড়ালেন না, বরং পানি দিয়ে কাদা বানিয়ে মহানন্দে আদমের মূর্তি বানালেন ও তাতে প্রাণদান করলেন। আর তিন ফেরেস্তা যে তাঁর হুকুম অমান্য করলেন তুচ্ছ মাটির কথা মেনে, তা যেনো তাঁর খেয়ালই হলো না। পক্ষান্তরে তাঁর হুকুম অমন্যের দায়ে আমাকে নাকি দিলেন অভিশাপ, আমার গলায় দিলেন লানতের তাওক এবং নির্বাসিত করলেন বেহেস্ত থেকে দুনিয়ায় চিরকালের জন্য। এসব কি তাঁর পক্ষপাতিত্ব বা ন্যায়বিরোধী কাজ নয়? না, এতে তিনি এতটুকু পক্ষপাতিত্ব বা অন্যায় করেননি। বরং অন্যায় করেছে মানুষ, তার ইচ্ছে ও উদ্দেশ্যকে উপলব্ধি করতে না পেরে।
“বলা হয় যে, আমি অভিশপ্ত, তিরস্কৃত ও নির্বাসিত হয়েছি। বাস্তবে তার একটিও না। এ বিষয়ে একটু খোলাসা করেই বলি।
“প্রথমত আমি আল্লাহর বিরাগভাজন ও অভিশপ্ত হয়ে থাকলে তিনি আমাকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান করতে পারতেন, পারতেন রোগ, শোক, দুঃখ-কষ্ট ও অভাব ভোগ করাতে, যেমন করেছেন হারুৎ-মারুৎ ফেরেস্তাদ্বয়কে। সর্বোপরি পারতেন মৃত্যু ঘটিয়ে জগত থেকে আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে। কিন্তু তিনি তার একটিও করেননি। বরং উল্টোই করেছেন। যদি কেউ কাউকে বলে, ‘তুমি রোগ, শোক, দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে দীর্ঘজীবন লাভ করে – তাহলে সেটা কি তার পক্ষে আশীৰ্বাদ না অভিশাপ? আল্লাহ আমাকে কোনো রোগ দেননি, শোক দেননি, অপমৃত্যু দেননি, কোনো অভাব দেননি, বরং দীর্ঘায়ু দান করেছেন। এসবের মধ্যে অভিশাপ কোনটি?
“দ্বিতীয়ত বলা হয়ে থাকে যে, আমি তিরস্কৃত হয়েছি। অর্থাৎ আল্লাহ আমার কণ্ঠে লানতের তাওক দান করেছেন। এ কথাটিও পুরো ঠিক নয়। আমি “তাওক একটি পেয়েছি ঠিকই। তবে সেটা কাঠের না লোহার না স্বর্ণের তৈরী, কেউ তা দেখেননি বা শোনেননি কারো কাছে আজ পর্যন্ত। ওটা কারাবাসীর কণ্ঠে যেমন তিরস্কার (তাওক), তেমন বিজয়ীর কণ্ঠে পুরস্কার (মেডেল) সূচিত করে। তারতম্য শুধু গঠন ও উপকরণে। এ বিষয় পরে বলবো।
“তৃতীয়ত বলা হয় যে, আমি বেহেস্ত থেকে বিতাড়িত হয়েছি, নির্বাসিত হয়েছি পৃথিবীতে। আল্লাহর আদেশে পৃথিবীতে আসা-যাওয়া অথবা স্থায়ীভাবে বসবাস করে তাঁর নির্দেশিত কর্তব্য তো অন্যান্য ফেরেস্তাগণও পালন করে থাকে। তারাও কি নির্বাসিত ? জেবরাইল ফেরেস্তা সংবাদ বহন ও আজরাইল ফেরেস্তা মানুষের জান কবজ করার উদ্দেশ্যে না হয় পৃথিবীতে আসে ও চলে যায়। কিন্তু মিকাইল ফেরেস্তা পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারে না আবহাওয়া বিভাগের কাজ বন্ধ করে। কেরামান ও কাতেবীন ফেরেস্তাদ্বয় রোজনামচা (ডাইরী) লেখা ছেড়ে দিয়ে মানুষের কাঁধ থেকে এক পা বাইরেই দিতে পারে না এবং মনকির ও নকিরকে তো জীবন কাটাতে হচ্ছে মানুষের কবরে কবরেই পৃথিবীতে। এরা যদি নির্বাসিত বলে সাব্যস্ত না হন, তবে আমি নির্বাসিত হই কোন বিচারে? আমিও তো আল্লাহর আদেশে আমার কর্তব্য পালন করে যাচ্ছি পৃথিবীতে বসে। বরঞ্চ আমি ওদের প্রত্যেকের চেয়ে মুক্ত ও স্বাধীন।
“জেবরাইল ফেরেস্তা সংবাদবাহক। সে আল্লাহর সকালের আদেশ কারো কাছে বিকেলে পৌছাতে পারে না। মেকাইল ফেরেস্তা আবহাওয়া পরিচালক ও খাদ্য পরিবেশক। সে আল্লাহর সকালের আদেশের বৃষ্টি বিকেলে এবং বাংলাদেশের বৃষ্টি আরবদেশে বর্ষাতে পারে না, পারে না ধনীর খাদ্য গরীবকে দান করতে। এভাবে প্রত্যেক ফেরেস্তাই আছে তাদের নিজ নিজ কর্তব্যের নিয়মশৃঙ্খলে আবদ্ধ। কিন্তু আমার কর্তব্য (পরীক্ষা) কাজ সম্পাদনে আল্লাহ আমাকে এরূপ কোনো নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেননি। আমার পরীক্ষাকাজের সকাল-বিকাল নেই বা শীত-বসন্ত নেই, এশিয়া-ইউরোপ নেই ; নেই যুব-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব পার্থক্যের নির্দেশ। বস্তুত আমি বিতাড়িত বা নির্বাসিত নই, অন্যান্য ফেরেস্তাদের মতোই আমি কর্তব্যের খাতিরে প্রেরিত হয়েছি পৃথিবীতে। আমি আল্লাহর মনোনীত ফেরেস্তা — বিশ্ববাসীর বিশ্বাসের পরীক্ষক (একজামিনার) ।
“বলা হয় যে, আদমকে সেজদা না করায় আমি ঘৃণিত ও অধঃপতিত হয়েছি এবং আদমকে গন্ধম ভোজন করিয়ে মানুষের শক্র হয়েছি। বাস্তবে তা নয়। বরং পুরস্কৃত হয়েছি ও পদোন্নতি লাভ করেছি এবং মানবকুলের বন্ধুর কাজই করেছি। আমার কথা শুনে আপনি একটু তাজ্জব হলেন বুঝি। এ বিষয়ে একটু বুঝিয়ে বলি।
“ফেরেস্তারা নূরের তৈরী। তাই পাক-সাফ বটে, তবে ওদের বুদ্ধি নেহাত কম। নিজেরা কোনো কাজই করতে পারে না আল্লাহর হুকুম তামিল করা ছাড়া। হা হুজুর’ ছাড়া না হুজুর বলার ওদের অভ্যাস নেই। তবে একদিন না হুজুর’ বলেছিলো, কিন্তু তা খাটনি। আল্লাহ পৃথিবীতে মানবজাতি সৃষ্টির পরিকল্পনা ঠিক করে আদমকে বানাবার পূর্বে ফেরেস্তাগণের আক্কেল পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। তাতে তারা আল্লাহকে বলেছিলেন, “আদমীরা আপনার হুকুম-আহকাম মানবে না বা এবাদত করবে না। সুতরাং আদম সৃষ্টি না করাই উত্তম। মানবজাতির পরম সৌভাগ্য যে, আল্লাহ ফেরেস্তাদের সে উপদেশ অগ্রাহ্য করে আদমকে বানালেন। কিন্তু আল্লাহ যদি ফেরেস্তাদের প্রস্তাব মেনে আদমকে না বানাতেন, তাহলে মানবজাতির এ দুনিয়াস্ত্রীতির কি দশা হতো?
“আদমকে বানিয়ে আল্লাহ ফেরেস্তাদের ডেকে বললেন – তোমরা আদমকে সেজদা করো। আল্লাহর হুকুম পেয়ে সব ফেরেস্তা একযোগে অর্থাৎ জামাতের সহিত এক রাকাত নামাজ আদায় করলেন আদমকে কেবলা করে। কিন্তু আমি সে নামাজ পড়লাম না। আল্লাহর আসনে আদমকে বসিয়ে তাকে সেজদা করতে আমার বিবেক বাধা দিলো। আমার বিবেক বললো যে, আল্লাহ পরিস্কার ভাষায় বলেছেন, “আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা কোরো না। তবে আজ কেন আদমকে সেজদা করতে বললেন? হয়তো এর কারণ ফেরেস্তাদের আক্কেল পরীক্ষা করা। আল্লাহ দেখতে চান যে, ওদের তুচ্ছ করা আদমকে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ফেরেস্তারা সেজদা করতে আপত্তি করে কি-না।
“মনে করুন – কোনো এক ব্যক্তি তার পাচটি ছেলেকে ডেকে জনৈক পথিককে দেখিয়ে বললো, “তোমরা সবাই ওকে বাবা বলে ডাকো। পিতার আদেশ পালন করা কর্তব্য, এ নীতিবাক্যটি পালন করে চারটি ছেলেই সেই পথিককে ‘বাবা বলে ডাকলো। কিন্তু একটি ছেলে ডাকলো না। সে ভাবলো, ‘পিতা কখনো দুজন হতে পারে না। পথিককে বাবা বললে তা হবে মিথ্যে কথা বলা। আর পিতা তো আগেই বলেছেন, কখনো মিথ্যে কথা বলবে না। আমার মুখে পথিককে বাবা ডাকার মধুর শব্দটি শুনে পিতা খুশী হবার জন্য নিশ্চয়ই এ কথাটি বলেননি, বলেছেন আমাদের আকেল পরীক্ষার জন্য। সুতরাং পিতার এ আদেশটি না মানাই শ্রেয়। এ ভেবে সে ছেলেটি তার জীবনের মহাকর্তব্য (সত্যকথন) পালন করলো, কপট পিতাকে মিথ্যা ‘বাবা ডাকলো না। ছেলেদের পিতা তার চার ছেলের অজ্ঞতা দেখে মনোক্ষ্ম হলেন এবং এক ছেলেকে বিজ্ঞতার পুরস্কার বাবদ তার গলায় দিলেন মেডেল।
“আল্লাহ হলেন অন্তর্যামী। মানুষ বা ফেরেস্তা কারো বাহ্যিক আচার-আচরণ দেখে তিনি তুষ্ট হন না, বিচার করেন মনের। আদমকে সেজদা করার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ ফেরেস্তাগণের আক্কেলের পরীক্ষা নিয়েছিলেন। আমি তাতে উত্তীর্ণ হওয়ায় তিনি আমাকে দান করেছেন বিজয়ের একটি নিশানা। কেউ কেউ তাকে বলে আমার পরাজয়ের নিশানা বা লানতের তাওক । বস্তুত আল্লাহ আমাকে দান করেছেন বিজয়ের নিদর্শনস্বরূপ ‘মেডেল ।
“বলা হয় যে, আমি আদমের শক্র, আদম জাতির শক্র ; কেন না গন্ধম ভক্ষণ করিয়ে আমি আদমকে বেহেস্তছাড়া করেছি। আসলে তা নয়। যৌনক্রিয়ায় নাকি মানুষ নাপাক হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে বেহেস্ত হলো চিরপবিত্র স্থান। সেখানে ওসব নাপাকীর কোনো স্থান নেই। কাজেই আদম-হাওয়া বেহেস্তে থাকলে তাদের যৌনক্রিয়া আজীবন বন্ধ রাখতে হতো। ফলে আদম থাকতেন নিঃসন্তান ও নির্বংশ। আদমের প্রেমাসক্তি সম্পূরণ ও বংশবৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ আদম-হাওয়াকে স্থান দিয়েছেন পৃথিবীতে তাদের বংশবৃদ্ধির গরজে।
“বেহেস্তের মধ্যে তখন তিন জাতীয় ফলের গাছ ছিলো। প্রথমত সুখাদ্যদায়ক বৃক্ষ, এর ফলগুলো ছিলো সাধারণ খাদ্য। অর্থাৎ জীবনধারণের উপযোগী খাদ্য। দ্বিতীয়ত জীবন বৃক্ষ। এর ফলগুলো ছিলো অমরত্বের প্রতীক। অর্থাৎ পরমায়ুবর্ধক। তৃতীয়ত জ্ঞানদায়ক বৃক্ষ। অর্থাৎ জ্ঞানবৃদ্ধির সহায়ক। এই জ্ঞানদায়ক ফলটিরই নামান্তর গন্ধম।
“আদমকে যখন বানানো হলো, তখন তিনি ছিলেন নিজীব মাটির পুতুল এবং আল্লাহ যখন প্রাণদান করলেন, তখন হলেন তিনি সজীব পুতুল। কিন্তু তখনও জ্ঞান বস্তুটি তার মধ্যে ছিলো না মোটেই। এমন কি লজ্জা-জ্ঞানও না। আদম-হাওয়া ছিলেন উলঙ্গ। ইতর প্রাণী ও মানুষের প্রধান পার্থক্য হলো লজ্জাজ্ঞান | আদম-হাওয়ার সেই লজ্জাজ্ঞান জন্মালো গন্ধম ভক্ষণের পর। ক্রমে জন্মালো ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বিবিধ জ্ঞান গন্ধম ভক্ষণের ফলে। পক্ষান্তরে বিবি হাওয়া হলেন রজস্বলা গন্ধম ছেড়ার ফলে। কাজেই গন্ধম না খেলে হযরত আদম থাকতেন জ্ঞানশূন্য আর বিবি হাওয়া থাকতেন বন্ধ্যা। আদমের জ্ঞান ও বিবি হাওয়ার সন্তানোৎপাদিক শক্তি জমালো গন্ধম খাওয়ার ফলে। সুতরাং গন্ধম খাইয়ে আমি শুধু আদম-হাওয়ারই নয়, তাবৎ মানবজাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বংশবিস্তারের সহায়তাই করেছি, যা অন্য কোনো ফেরেস্তা করেননি। কার্যত আমি মানুষের পিতার চেয়ে ভক্তির পাত্র এবং গুরুর চেয়ে মান্যবর। দুঃখের বিষয় এই যে, কতক মানুষ তা বাহ্যত মানতে চান না, তবে কার্যত মেনে চলেন। আর তাতেই আমি সন্তুষ্ট কেননা একজন বিশ্বাসী মানুষ দিনেরাতে নানা কারণে যতবার আমার নামটি মুখে উচ্চারণ করেন, মনে হয় যে, ততোবার তার বাবার নামও উচ্চারণ করেন না। বিশেষত আমার নামটি তাদের প্রাতঃস্মরণীয় ও অগ্রপাঠ্য।
“আপনি ভাবছেন, এ বিরাট পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে দাগ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় কিরূপে। আপনার এ ভাবনাটা অমূলক নয়। আসলে ও কাজটা ততো কঠিন নয় আমার পক্ষে। কেননা আমি দুনিয়ার সকল অঞ্চলের সকল মানুষকে দাগ দেই না, দাগ দেই ঈমানদাদিগকে। অর্থাৎ যারা আমাকে বিশ্বাস করে তাদেরকে। আমার উপর যাদের ঈমান নেই, অর্থাৎ আমি আছি বা আমার অস্তিত্বকে যারা অস্বীকার করেন, তারা তো কাফের। কেননা পবিত্র কোরানে আল্লাহ বলেছেন, “শয়তান আছে এবং পবিত্র হাদিছে নবী বলেছেন, “শয়তান আছে। এতদসত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি যদি বলে, “শয়তান নেই, তবে পবিত্র কোরান-হাদিছের বাণী অমান্যকারী সে ব্যক্তি কি কাফের নয়?
“আবার যে ব্যক্তি কাফেরের ঔরসে জন্মলাভ করে, সে তো জন্মসূত্রেই কাফের এবং সে নানাবিধ বেসরা কাজ (মূর্তিপূজা) ইত্যাদি করে থাকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে আমার দাগ দেওয়া ছাড়াই। তাকে তার কৃতকর্মে বাধা দানের অর্থ হয় অসৎকাজে অর্থাৎ পাপকাজে বাধাদান করা। আল্লাহ তো কারো অসৎকাজে আমাকে বাধা দিতে বলেন নি। তাই আল্লাহর আদেশ মেনেই আমি কোনো বিধমীকে দাগা দেই না। অর্থাৎ আমার অস্তিত্বের উপর যাদের ঈমান নেই, তাদের আমি দাগ দেই না, এমনকি তাদের কোনো সৎকাজেও না। তাইতো বর্তমান দুনিয়ায় ঈমানদারদের চেয়ে বেঈমানদারগণই সৎকাজ করেন বেশী।
“আমাকে যেমন সকল মানুষকে দাগ দিতে হয় না, তেমন সকল জায়গায় আমি সমভাবে অবস্থানও করি না। বিশ্বাসীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপাসনা মন্দির ও ধর্মধামেই আমাকে সময় কাটাতে হয় বেশী। কেননা ওগুলোই হচ্ছে আমার প্রধান কর্মকেন্দ্র। তবে মফস্বলেও কিছু কিছু কাজ না করলে চলে না |
“আপনার জানতে ইচ্ছা হচ্ছে যে, অহরহ মানুষের সহবাসে থাকা সত্ত্বেও তারা আমাকে দেখতে বা আমার অস্তিত্বই অনুভব করতে পারে না, এর কারণ কি এবং কোথায় বসে আমি মানুষকে দাগ দিয়ে থাকি? তা বলি শুনুন। “আল্লাহ আমাকে ক্ষমতা দান করেছেন মানুষের দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে এবং শিরায় । শিরায় চলতে। যখন আমি কোনো ব্যক্তিকে দাগ দিতে চাই, তখন তাকে বাইরে থেকে ডেকে বলি না যে, তুমি এ কাজটি করো না এবং ও কাজটি করো। আমি তখন প্রবেশ করি তার দেহের কেন্দ্রস্থল মস্তিকে এবং মস্তিষ্কের কেন্দ্রবিন্দু ত্রিতলা মনের একেবারে নীচের তলায়, যে জায়গাটির নাম অচেতন মন বা ‘নিজ্ঞান মন। সেখানে বসে আমি তার অচেতন মনকে প্রলুব্ধ করি কোনো কাজ করতে বা না করতে। আমার কর্মকেন্দ্র মানুষের মস্তিকের অভ্যন্তরে অবস্থিত। তাই দুষ্ট লোকেরা বলে টুপির নীচে শয়তান থাকে। তাদের সে কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। কেননা আমার অধিষ্ঠানটি টুপির নীচেই উপরে নয়।
“আমি পূর্বেই বলেছি যে, আমি আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারি না, কেউ পারে না। আমি যা কিছু করি তদ্বারা আল্লাহর ইচ্ছাকেই পূরণ করি এবং অন্যেরাও তা-ই করে থাকে। দুঃখের বিষয় এই যে, বিশ্বাসীরা তা পুরাপুরি মানেন না। তাঁরা আল্লাহকে বলেন সর্বশক্তিমান, আবার কোনো কাজে আমার উপর দোষ চাপান। শুধু তাই নয়, তাঁরা আরও বলেন, ‘শুভ কাজের কর্তা আল্লাহতা’লা এবং অশুভ কাজের কর্তা শয়তান।’ যদি তা-ই হয়, তবে “আল্লাহ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও সর্বশক্তিমান – এ কথাটির সার্থকতা কি? এতে কি আমাকে ‘আল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বী ও দ্বিতীয় শক্তিধর বলে প্রমাণিত হয় না? বস্তুত তা নয়। আমার সমস্ত কাজেই আছে আল্লাহতালার সমর্থন। এখন তাই একটু বলছি।
“বলা হয়, আল্লাহ দুনিয়ার সব কাজ করবার ক্ষমতাই মানুষকে দান করেছেন। কিন্তু হায়াত,মউত, রেজেক ও দৌলত, এ চারটি কাজ রেখেছেন নিজের হাতে। আবার এ কথাও বলা হয় যে, খুন-খারাবী, চুরি-ডাকাতি ও ব্যভিচারের উদ্যোক্ত শয়তান। তাই যদি হয় অর্থাৎ আমার দাগায় পড়েই যদি কোনো এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে হত্যা করে, তাহলে আহত ব্যক্তির জান কবজ করতে আজরাইল ফেরেস্তা সেখানে আসেন কার হুকুমে? সেই দিনটি মৃতব্যক্তির হায়াতের শেষ দিন নয় কি? কলেরা-বসন্তাদি রোগে অসংখ্য মানুষ মরে জীবাণুদের আক্রমনে। সেই জীবাণুদের দাগ দেয় কে?
“সমস্ত জীবের রেজেক (খাদ্য) দান করেন স্বয়ং আল্লাহতালা। চোর-ডাকাতের রেজেক দান করেন কে? মানুষ জানে না যে, আল্লাহ কার রেজেক কার ভাণ্ডারে রেখেছেন। আল্লাহ যার রেজেক ও দৌলত যেখানে রেখেছেন, যে কোনও উপায়েই হোক সেখান থেকে এনে সে তা ভোগ করবেই। চোর চুরি করে বটে, কিন্তু আসলে সে তার আল্লাহর বরাদ্দকৃত খাদ্যই খায়। আমি যদি দাগ দিয়ে চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে একের রেজেক অন্যকে খাওয়াতে পারি, তাতে আল্লাহর গৌরব বাড়ে কি? অন্যান্য জীবের রেজেকও আল্লাহতালাই জোগান। গেরস্ত বাড়ির হাঁস-মোরগ ও খাদ্যাদি চুরি করে শেয়াল-কুকুরে খায়। তাদের দাগ দেয় কে?
“বলা হয় যে, শয়তানের খপ্পরে পড়ে মানুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তাতে আল্লাহর কোনো সমর্থন নেই। যদি তাই হয়, তবে জারজ সন্তানের প্রাণদান করে কে ? মানব সৃষ্টোত্তর কালে আল্লাহ যখন মানুষের প্রাণ সৃষ্টি করেছেন, তখন থেকেই তিনি জানেন যে, কোন প্রাণ কখন কোথায় জমাবে, কে কি কাজ করবে এবং অস্তিমে কে কোথায় যাবে, অর্থাৎ বেহেস্ত না দোজখে। তিনি এ-ও জানতেন যে, কে কার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে। তিনি ইচ্ছা করলে ব্যভিচারীদ্বয়কে দাম্পত্যবন্ধন দান করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে জারজ সন্তানদের জন্য প্রাণ সৃষ্টি করে রেখেছেন। জারজ সন্তানদের প্রাণদান করেন আল্লাহ ইচ্ছা করেই। ব্যভিচার ঘটিয়ে আমি আল্লাহর সেই ইচ্ছাকেই পূরণ করি মাত্র।
“বিশ্বাসীরা মনে করেন যে, শয়তান না থাকলে মানবজাতির মঙ্গল হতো। তাঁরা ভেবে দেখেননি যে, আমার নির্দেশিত পথে চলেই বর্তমান জগতের মানুষের যতো সব আয়-উন্নতি এবং তারই সাহায্যে চলছে ভালো ধর্মের বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য। আজ যদি আমি দুনিয়া ছেড়ে চলে যাই বা আমার দাগাকাজ বন্ধ করি, তাহলে মানবসমাজে যে বিপর্যয় দেখা দেবে তা থেকে রক্ষা পাবে না বিশ্বাসীরাও।
“প্রথমত কতিপয় রাষ্ট্ৰীয় দপ্তর থাকবে না। ফলে মন্ত্রিত্ব হারাবে অনেকে এবং রাজ্যশাসনে বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ হবে কর্মহীন। সুরশিল্পী, চিত্রশিল্পী থাকবে না, থাকবে না মাদকদ্রব্যের ব্যবসা। এছাড়া থাকবে না সুদ, ঘুষ, কালোবাজারী ইত্যাদির পেশা। আর এতে মানবসমাজে যে ভয়াবহ বেকারত্ব ও আর্থিক সংকট দেখা দেবে, তার প্রতিক্রিয়া হবে ধর্মরাজ্যেও। কেননা ঐসব অসৎবৃত্তির আয় দ্বারাই তো হচ্ছে যতো মসজিদ-মাদ্রাসার ছড়াছড়ি ও হজ্জ্বযাত্রীদের সংখ্যাবৃদ্ধি।
“কোনো কিছুর অভাব আমার নেই বা অন্য কোনো দুঃখ আমার নেই। একটিমাত্র দুঃখ এই যে, মানুষ আল্লাহকে না জানার ফলে এবং তাঁর কুদরৎ অনুধাবন করতে না পেরে অযথা আমার উপর দোষারোপ করে। আল্লাহ ইচ্ছাময় ও সুমহান। “এখন আর বেশী কথা বলার সময় নেই। নামাজের সময় হচ্ছে, মসজিদে যাই। আসসালামু আলাইকুম।”
আগন্তুক চলে গেলেন মসজিদের দিকে। কিন্তু নামাজ পড়তে না দাগ দিতে তা বুঝা গেলো না। মাইকের আজানে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো, চেয়ে দেখি পূর্ব আকাশ পরিষ্কার।
বিস্ময়বিষ্ট হয়ে আমি ভাবতে লাগলাম – এতদিন আমার মনে হচ্ছিলো যে, হিন্দু পুরাণশাস্ত্রে লিখিত ‘নারদ মুনি’ পরবর্তিকালে শয়তান রূপ লাভ করেছেন। উভয়ের পরিচয়পত্র মিলালে তা বেশ বুঝা যায়। হিন্দুশাস্ত্ৰমতে – ‘নারদ-এর মাতাপিতা নেই। সে ভগবান ব্রহ্মার মানসসৃষ্টি। তার বাসস্থান ছিলো স্বর্গে এবং সে ছিলো ধাৰ্মিক চূড়ামণি। সে সৃষ্টিকর্তার একটি আদেশ অমান্য করায় অভিশপ্ত হয়ে (মানবরূপে) পতিত হয় মর্ত্যে (পৃথিবীতে)। সে ছিলো সর্ববিদ্যাবিশারদ এবং স্বৰ্গ-মর্ত্য-অন্তরীক্ষে ছিলো তার অবাধ গতি।”
সৃষ্টি, বাসস্থান, স্বৰ্গচ্যুতি ও গুণাবলীর বর্ণনায় নারদ এবং শয়তান দুজনের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। শয়তান যেনো নারদের একটি অভিনব সংস্করণ। তবে দ্বিতীয় বা তৃতীয় নয়, চতুর্থ সংস্করণ। নারদ-নাটকের দ্বিতীয় সংস্করণের নায়ক পার্সি ধর্মের ‘আহরিমান, তৃতীয় সংস্করণে ইহুদী ধর্মের সেদিম বা ‘দেয়াবল এবং চতুর্থ সংস্করণের নায়ক হচ্ছে শেষ জামানার শয়তান।
পূর্বেকার ঐসব অনুমান আমার হঠাৎ যেনো নস্যাৎ হয়ে গেলো। কেননা মূর্তিমান শয়তান যে আজ আমার চোখের সামনেই বসা ছিলো এতক্ষণ।
লেখকঃ আরজ আলী মাতুব্বর
বিমানবিহারের বাসনা মানুষের সার্বজনীন ও বহুকালের পুরানো এবং তা পূরণও করেছেন কেউ কেউ হাজার হাজার বছর আগেই। প্রাচ্যের ও প্রতীচ্যের ধর্মীয় ও পৌরাণিক পুঁথিপত্তরে তার বহু বিবরণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। তার মধ্যে বহু ক্ষেত্রেই মানুষের উড্ডীন যান ছিলো পাখী। যেমন – লক্ষ্মীদেবীর বাহন পেচক, সরস্বতীর বাহন হংস, বিষ্ণুর বাহন গরুড় এবং বাদশাহ নমরুদ নাকি উড়েছিলেন শকুন পাখীর সাহায্যে। আবার কেউ কেউ রথে গোড়ীতে) চেপে উড়েছেন এবং বাদশাহ সোলায়মান নাকি উড়েছেন তার সিংহাসনে চেপেই। কিন্তু এরা সবাই উড়েছেন পৃথিবীর কাছাকাছি, বায়ুমণ্ডলের মধ্যে, এঁদের কেউই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে মহাকাশে যাননি বা যেতে পারেননি। তবে এঁরা সবাই উড়েছেন আপন আপন প্রচেষ্টায়। এ ছাড়া আর একভাবে মানুষ মহাকাশ (স্বর্গ) ভ্রমণ করেছে। কিন্তু তা তাদের আপন প্রচেষ্টায় নয়। মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন তাঁরা ঈশ্বর প্রেরিত স্বগীয় দূতের আহানে স্বগীয় যানে আরোহণ করে। আর সেখানে তারা দেখেছেন অত্যাশ্চর্য ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, সাক্ষাৎ করেছেন ঈশ্বরের সাথে, আবার স্বর্গদূতেরা ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন তাদের নিজ নিজ ঠিকানায়। এহেন মহাকাশ ভ্রমণকে ইসলামিক ভাযায় বলা হয় ‘মে্রাজ বা ‘মেয়ারাজ।
মুসলমানদের মতে ওভাবে মহাকাশ ভ্রমণ বা মেরাজ গমন করেছেন একমাত্র শেষ পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদ (দ)। বস্তুত তা নয়। মহর্ষি এনক ঐভাবে মে’রাজ গমন করেছিলেন খ. পূ, প্রায় ৩০০০ অব্দে এবং মহর্ষি ইজেকিয়েল ও মহর্ষি ইলাইজা মে’রাজ গমন করেছিলেন খু পু প্রায় ৬০০ অব্দে। খ. পূ. প্রায় ২০০০ অব্দে মহাপ্রবর ইব্রাহীম মে’রাজ গমন করেছিলেন বলেও শোনা যায়। তবে তা তৌরিত তথা পবিত্র বাইবেলে লিখিত নেই, তা জানা যায় অন্যান্য সূত্রে। আর শেষ নবী মেরাজ গমন করেন কোন তারিখে, তা তো মুসলমান মাত্রেই জানেন। এ সমস্ত মনীষীগণ প্রত্যেকেই মহাকাশে লক্ষ লক্ষ মাইল পথ ভ্রমণ করে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন অতি অলপ সময়ের মধ্যে। কিন্তু তখনকার সকল লোকে এবং আজও অনেকে তাঁদের সে মহাকাশ ভ্রমণের বিবৃতি বিশ্বাস করতে চায়নি। এমনকি ভ্রমণকারীদের আগনদলীয় কিছুসংখ্যক লোকও ছিলেন বা আছেন যারা ও বিষয়ে সন্দিহান।
উপরোক্তরূপ মহাকাশভ্রমণ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে সাম্প্রতিককালে, তা প্রকাশ করেছেন জর্জ অ্যাডামকি নামে জনৈক আমেরিকাবাসী। তাঁর সে বিবৃতি লিপিবদ্ধ করার আগে সংক্ষেপে তাঁর পরিচয়টা দিয়ে নিই।
জর্জ অ্যাডামকির জন্ম পোল্যাণ্ডে ১৮৯১ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখে। যখন তাঁর বয়স প্রায় দুবছর, তখন তাঁর বাবা-মা আমেরিকা গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন। তারা থাকতেন নিউইয়র্কের কাছে ডানকার্ক শহরে।
জর্জ স্কুলে বেশিদিন পড়তে পারেন নি। কিন্তু তাই বলে যে লেখাপড়া শেখেননি তা নয়। বরঞ্চ বাড়িতে পড়ে তার বয়সী বালক-বালিকা অপেক্ষা বেশীই শিখেছিলেন। যখন তিনি একটু বড় হলেন, মনে যখন কিশোর, তখন তিনি ভাবতে শুরু করলেন – মানুষ ঝগড়া-বিবাদ না করে মিলে-মিশে থাকতে পারে না কেন? তখন থেকেই তিনি ভাবুক। আকাশের প্রতি আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশী। কিন্তু তিনি ইতিহাস এবং ভূগোল উত্তমরূপে পড়েছিলেন।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান। কিন্তু জানতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার সঙ্গতি তার বাপমায়ের নেই। এজন্যে তাঁর কোনো অভিযোগ ছিলো না। তিনি নিজে কাজ করতেন, রোজগার করতেন ; কিন্তু সংসারে দিয়ে এমন উদ্ধৃত্ত থাকতো না যা দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন।
সারা দেশটাকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ভাবলেন। যেখানে যা বা যার কাছে যা পারলেন তিনি তাই শিখতে লাগলেন ; কোনো ব্যক্তিবিশেষের কাছেই হোক, লাইব্রেরীতেই হোক কিংবা মিউজিয়মেই হোক। শিক্ষা তাঁর সম্পূর্ণ হয়েছিলো।
১৯১৩ সালে জর্জ আমিতে যোগদান করেন। থাটিন্থ ক্যাভালরির সঙ্গে তাঁকে ডিউটিতে পাঠানো হয় মেকসিকো সীমান্তে। ১৯১৯ সালে তিনি আর্মি থেকে ছাড়া পান। তাঁর কাজের প্রশংসা করা হয়েছিলো। ইতিমধ্যে ১৯১৭ সালে বড়দিনের দিন মেরি সিমবারকির সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিলো। আমি থেকে ছাড়া পেয়ে রুজি-রোজগারের চেষ্টায় জর্জ অ্যাডামস্মিক বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। এশহর থেকে ওশহর, ওগ্রাম থেকে এগ্রাম ঘুরে বেড়ান, যেখানে কাজ পান সেখানেই থেকে যান। এতে তাঁর অভিজ্ঞতাও বাড়ে প্রচুর, ভালোও লাগে ঘুরে বেড়াতে।
এভাবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত কাটিয়ে দেবার পর অ্যাডামস্কি স্থির করলেন – আর ঘুরে বেড়ানো নয়, এবার থিতু হয়ে বসা যাক। লাগুনা বিচ নামে একটি গ্রাম বেছে নিলেন এবং সেখানে তিনি মাষ্টারী আরম্ভ করে দিলেন। ১৯৪০ সালে অ্যাডামকি লাগুনা বিচ থেকে ভ্যালি সেন্টারে উঠে গেলেন। “ভ্যালি সেন্টার হলো ক্যালিফোর্নিয়ায় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মানমন্দির মাউন্ট প্যালোমার যাবার রাস্তায়। তাঁর বাড়ির নাম ‘প্যালোমার গার্ডেন’। অ্যারিজোনার মরু অঞ্চলে ডেজার্ট সেন্টার গ্রাম। ১৯৫২ সালের ২০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সেখানে মহাকাশ (ভেনাস গ্রহ) থেকে ফ্লাইং সসারে আগত জনৈক মহাকাশচারীর সাথে অ্যাডামকির সাক্ষাৎ হয়। সে সাক্ষাৎকারের বিবরণ লিখে তিনি প্রকাশ করেন ফ্লাইং সসারস্ হ্যাভ ল্যাণ্ডেড নামে একখানা যুগান্তকারী বই। অতঃপর ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ার ফ্লাইং সসারে চেপে দুজন মহাকাশচারী অ্যাডামস্কিকে তাদের সাথে মহাকাশ ভ্রমণে নিয়ে যায় এবং ভ্রমণান্তে তাঁকে পৃথিবীতে তাঁর নিজালয়ে পৌঁছে দিয়ে যায়। এবারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখে তিনি ইনসাইড দি ফ্লাইং সসার নামে আর একখানা পুস্তক প্রকাশ করেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, উক্ত পুস্তকে জর্জ অ্যাডামকি তাঁর মহাকাশ ভ্রমণের যে বিবৃতি প্রকাশ করেছেন, তার সাথে সেকালের মেরাজের কাহিনীসমূহের মৌলিক পার্থক্য বিশেষ কিছুই নেই।
এখন জর্জ অ্যাডামকির সে ভ্রমণকাহিনীর কিছু অংশ তাঁর নিজের কথায়ই বলছি –
১৯৫৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ার আমি লসএঞ্জেলস শহরে এসে পৌছলুম। আমি বাস করি শান্ত একটি শহরে আর লসএঞ্জেলসে যত মানুষ, তত গাড়ী, তত গোলমাল আর রাত্রিবেলায় চোখ ধাধানে আলো। এই শহর আমার ভালো লাগে না। তবুও আমাকে আসতে হয়েছে, কারণ আমি ডাক পেয়েছি। কিসের ডাক? শীঘ্রই জানা যাবে।
শহরের কেন্দ্রস্থলে একটা হোটেলে আমি উঠেছি। নিজের ঘরে ঢুকে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশে একবার চেয়ে দেখলুম। কেন? জানিনা। কোনো প্রেরণা লাভের উদ্দেশ্যে ? তাও তো বলতে পারছি না।
এখন সবে বিকেল চারটি বেজেছে। নিচে ককটেল বারে কিছু লোক আমাকে চিনে ফেলল। খ্যাতির বিড়ম্বনা। ইতিমধ্যে আমার বই ‘ফ্লাইং সসারস্ হ্যাভ ল্যাণ্ডেড প্রকাশিতও হয়েছে, রেডিও ও টিভিতে বক্তৃতা দিয়েছি। ক্লাবে, কলেজ হলে, বিজ্ঞান সভাতেও বক্তৃতা দিয়েছি, কাগজেও ছবি ছাপা হয়েছে।
আমাকে ওরা এক জায়গায় বসিয়ে নানা প্রশ্ন করতে লাগল। আমার খারাপ লাগছিল না। কোথা দিয়ে তিন ঘটা কেটে গেল। নিজের ঘরে ফিরে গেলুম। পোশাক পাল্টে বাইরে খেয়ে এলুম।
একজন মহিলার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। তাকে টেলিফোন করলুম। তিনি বললেন, আমাকে যেতে হবে না। তিনিই আমার হােটেলে আসছেন। রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটা পর্যন্ত কথা বলে মহিলা চলে গেলেন। আমি তাঁকে স্ট্রটকারে তুলে দিয়ে হােটেলের লবিতে বসে একটা সান্ধ্য সংস্করণ পড়তে লাগলুম।
কাগজ পড়তে ভালো লাগছে না। মন ভীষণ চঞ্চল। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। এমন সময় দুজন যুবক আমার দিকে এগিয়ে এলো। দুজনেই আমার অপরিচিত। কিন্তু তারা যেন আমাকে অনেকদিন থেকে চেনে। এইভাবে তারা আমার দিকে এগিয়ে এসে একজন আমাকে ডাকল, মি. অ্যাডামস্কি।
দুজনকে দেখে মনে হয় উঠতি ব্যবসায়ী। একজন ছফুটের ওপর লম্বা, বয়স আন্দাজ তিরিশ। দেহবর্ণ ইংরেজীতে যাকে বলে রাষ্ট্ৰী। চোখের তারা ঘোর বাদামী, দৃষ্টিতে বেশ কৌতুক মাখা। মাথার কালো চুল ব্যাকাব্রাশ করা।
অপরজন মাথায় খাটাে, বয়স বোধহয় তিরিশ হয়নি, গোল মুখ বালকের মতো। বেশ ফর্সা, চোখের তারা নীলাভ ধূসর। মাথার চুল বাদামী এবং কোকড়ানো। কারও মাথায় টুপি নেই। দুজনে যেনো দুই ভিন্ন দেশের মানুষ।
দ্বিতীয় যুবক মি. অ্যাডামস্কি বলে হ্যাণ্ডশেক করবার জন্যে হাসিমুখে তার হাত বাড়িয়ে দিলো। তখনও আমি জানি না এরা কে ? কিন্তু যেই আমি হ্যাণ্ডশেক করলাম, আমনি আমার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল।
এইতো ১৯৫২ সালের ২০ নভেম্বর তারিখে অ্যারিজোনার মরু প্রান্তরে ভেনাস গ্রহের সেই যুবক আমার সঙ্গে এইভাবে হ্যাণ্ডশেক করেছিল। এতক্ষণ আমার মনে সন্দেহ উকিঝুকি মারছিল, মারছিল, কিন্তু এবার আমি বুঝলাম এরা ভিন্ন গ্রহের মানুষ। কিন্তু দুজনের চেহারার এত পার্থক্য কেন ? পার্থক্য কেন পরে জানতে পেরেছিলুম।
ওদের মধ্যে যার বয়স কম সে আমাকে বলল, আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আপনাকে আমরা এখন একটু বাইরে নিয়ে যেতে চাই। আপনার কি সময় হবে?
নিশ্চয় চলুন। আমি কিছু চিন্তা না করেই রাজি হয়ে গেলুম।
হােটেল থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লুম, আমি মাঝখানে, ওরা দুপাশে দুজন। এক জায়গায় অনেক গাড়ী রাখা ছিল। একটা গাড়ীতে আমাকে ওরা উঠতে ইশারা করে নিজেরাও উঠল। কমবয়সী যুবকটি ড্রাইভারের সিটে বসল। গাড়ীখানা আমেরিকায় তৈরী, কালো রং, বেশ বড়, পন্টিয়াক সিডান |
আমরা বসার সঙ্গে সঙ্গে সে গাড়ী ছেড়ে দিল এবং যে কোন সুদক্ষ ড্রাইভারের মতো গাড়ী চালিয়ে নিয়ে চলল। পথ তার উত্তমরূপে চেনা বলে মনে হলো। আমার খুব অবাক লাগছিল, আমি কোনো কথা বলতে পারছিলুম না, মনে নানা প্রশ্ন।
নীরবতা ভঙ্গ করে অপর যুবকটি যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, আপনার ধৈর্যের প্রশংসা করতে হয়, কারণ এতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমাদের সম্বন্ধে কোনো কৌতুহল প্রকাশ করেননি, জিজ্ঞাসাও করেননি আমরা আপনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি।
আমি মৃদু স্বরে বললুম, আমি জানি তোমরা নিজেরাই বলবে।
মৃদু হেসে যুবক বলল, ঐ ছেলেটা যে গাড়ী চালাচ্ছে ও হলো মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দা, যাকে তোমরা বল মার্স আর আমি আসছি শনি অর্থাৎ স্যাটার্ণ থেকে।
যুবকের বাচনভঙ্গি স্পষ্ট এবং উচ্চ কণ্ঠে কথা বলে। কথা বলার ধরণ এমন চমৎকার যে, অবিশ্বাস করার কোনো কারণ পাওয়া যায় না।
গাড়ী চালাতে চালাতে কনিষ্ঠ যুবক বলল, আমরা হলুম আমাদের গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগকারী ব্যক্তি, যাদের আপনারা বলেন “কস্টাইম্যান (সেকালের ফেরেস্তা?)। আমরা পৃথিবীতে কয়েক বছর হলো আছি, গোড়ার দিকে আমাদের ইংরেজী উচ্চারণে কিছুটা জড়তা ছিল, কিন্তু এখন তা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। আমরা এখন আপনাদের সঙ্গে মিশে গেছি। অন্য গ্রহের মানুষ বলে কেউ আমাদের চিনতে পারে না, অবশ্য আমরাও আমাদের পরিচয় কারো কাছে প্রকাশ করি না।
জ্যেষ্ঠ যুবক বলল, সেটা বিপজ্জনক হবে, তবে দেখুন, পৃথিবীর মানুষ তাদের যতটা না চিনতে পারে, আমরা তার চেয়ে বেশী চিনতে পারি।
আমি বললুম, বুঝেছি, তুমি বলতে চাইছ যে, আমি আমাদের আর একজন মানুষকে যতটা না চিনতে পারি, তার চেয়ে তোমরা আমাদের আরও ভালো করে চিনতে পার, এই তো? ঠিক তাই, আচ্ছা একটা কথা, আপনি তো বিশ্বাস করেন যে, অন্য গ্রহে আমাদের মতোই মানুষ আছে এবং এজন্য আপনাকে অনেক বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে, কারণ আপনাদের বিজ্ঞানীরা বলেন যে, অন্য কোনো গ্রহে জীবন অসম্ভব। অতএব আপনি যদি এখন গাড়ী থামিয়ে চিৎকার করে রাস্তার মানুষদের বলেন যে, দেখ এই দুটি মানুষ, এরা পৃথিবীর নয়, একজন মঙ্গল গ্রহের এবং অপরজন শনি গ্রহের – তাহলে অবস্থাটা কি হবে?
তাহলে আমাকে তো পাগল বলবেই এবং তোমাদেরও হেনস্থা কম হবে না। কেউ বিশ্বাসই করবে না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। আমার মনে কিন্তু এক মিনিটের জন্যেও সন্দেহ জাগেনি। আমি ওদের কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছি। –
জ্যেষ্ঠ যুবক বলল, আমরা অবশ্য মাঝে মাঝে আমাদের গ্রহে ছুটি কাটিয়ে আসি। হ্যা, বলিনি, আমরা দুজনই এখানে চাকুরী করি এবং আমাদের মতো আরও অন্য গ্রহবাসী আছে।
আমার ইচ্ছে হয়েছিল, একবার জিজ্ঞাসা করি, তোমরা কি বিয়ে করেছ? তোমাদের বৌছেলেমেয়ে কি এখানে থাকে? কিন্তু পরমুহূর্তে মনে হলো, না ওরা একাই থাকে। কে জানে ওদের গ্রহে বিবাহ করার রীতি আছে, না অন্য কোনোরকম রীতি আছে। টেলিপ্যাথির দ্বারা ওরা যদি আমার মনের কথা বুঝতে পারে, তা হলে ওরা নিজেরাই জবাব দেবে।
আমি আবার মনে মনে ভাবতে লাগলুম, পৃথিবীতে তো আরো অনেক লোক আছে এবং অনেক বিজ্ঞানীও আছেন যারা বিশ্বাস করেন অন্য গ্রহে মানুষ থাকতে পারে না। তা ভিন্ন গ্রহের এই বাসিন্দারা তেমন মানুষ বা বিজ্ঞানীর সঙ্গে যোগাযোগ না করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল কেন? অবশ্য বায়ান্ন সালে বিশে জুন তারিখে ভেনাসের সেই মানুষটি আমাকে বলে গিয়েছিল যে, আমার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবে। কিন্তু এদের দুজনের মধ্যে কেউ তো ভেনাসের মানুষ নয়। কারণ যা-ই হোক, মনে মনে আমি কৃতজ্ঞ।
স্যাটারিয়ান অর্থাৎ শনিবাসী আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, তোমার সঙ্গে কিন্তু আমরা প্রথম যোগাযোগ করলুম না, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কেউ আমাদের বিশ্বাস করেনি, কেউ করেছে, সে কথা সে অপরকে বলেছে, তার কথা তো বিশ্বাস করেনি উল্টো প্রচুর লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে, এই ভয়ে বাকী ক’জন যারা আমাদের বিশ্বাস করেছে তারা আর মুখ খোলেনি।
প্রায় দেড় ঘটা গাড়ী চলল। কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছি না, বাইরে অন্ধকার (মে’রাজের ঘটনা সমস্তই ঘটেছে রাতে), এদিকের পথ-ঘাট আমি ভাল চিনিও না। আমিও জিজ্ঞাসা করিনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, ওরাও বলেনি।
সোজা রাস্তা ছেড়ে এবার গাড়ী ডানদিকে একটা কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলতে লাগল।
মঙ্গলবাসী বলল, তোমাকে আমরা অবাক করে দেব, অপেক্ষা কর।
মনে মনে বলি, অবাক তো করেই দিয়েছ।
যাই হোক, গাড়ী যাচ্ছে। রাস্ত নির্জন, কোনো গাড়ী বা মানুষ চলছে না। পনের মিনিট কাটল। কিন্তু দূরে ওটা কি? ঝিকমিক করছে, আবার অনুজ্জ্বল কি যেন একটা দাড়িয়ে আছে মাটির ওপর । –
গাড়ী যখন আরও খানিকটা এগিয়ে গেল, তখন চিনতে পারলুম, অ্যারিজোনার ডেজার্ট সেন্টারে তিন মাস আগে দেখা সেই রকম একটা ফ্লাইং সসার। ওরা ওটাকে বলল – স্কাউট (বোরাক?)।
এই সসার বা স্কাউট আমার দেখা সসারের মতো প্রায়, তবে এর কিছু বেশী বোধহয়, কুড়ি ফুট হবে।
গাড়ী থামল। স্কাউটের কাছে গাড়ী থেমেছে। গাড়ীতে বসে দেখতে পেলুম স্কাউটটির সামনে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ কি কাজ করছে। গাড়ী থেকে নেমে আমরা সকলে সেই স্কাউটের কাছে এগিয়ে গেলুম। কাছে আসতে মানুষটি ঘুরে দাঁড়াল, আরে এতো আমার পরিচিত সেই ভেনুশিয়ান।
সে হাসিমুখে আমাকে অভ্যর্থনা করে বলল, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলুম। লক্ষ্য করলুম, সেবার সে কথা বলেনি, আকারে-ইঙ্গিতে ও টেলিপ্যাথির সাহায্যে আমরা ভাববিনিময় করেছিলুম। কিন্তু এবার সে কথা বলল, তবে এদের মতো স্পষ্ট নয়।
সে আরও বলল, স্বকাউটটার একটা যন্ত্রাংশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল, সেটা এই ফঁাকে মেরামত করে নিলুম। কথা বলতে বলতে সে ছোট ধাতব একটা পদাৰ্থ বালির ওপর ফেলে দিলো। আমি সেটা তুলে নিলুম এবং সেটি আমার কাছে এখনো আছে।
রাসায়নিকরা সেই ধাতুখণ্ডটি পরে পরীক্ষা করে রায় দিয়েছিলেন যে, এটি কোনো মৌলিক ধাতু নয়, একাধিক ধাতু মিশ্রিত অ্যালয়, তবে কি কি ধাতু মিশিয়ে অ্যালয় তৈরী হয়েছে তা তারা বলতে পারেননি।
আমি যখন সেই ধাতুখণ্ডটি তুলে নিয়ে পকেটে রাখছিলুম, তখন ভেনুশিয়ান মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করেছিল, ওটা নিয়ে কি করবে? আমি বলেছিলুম, পরে কাজে লাগতে পারে, তোমাদের সংস্পর্শে যে এসেছিলুম তার হয়তো প্রমাণ দিতে পারবো। –
মৃদু হেসে ভেনুশিয়ান বলেছিল, তোমরা আর্থম্যানরা সুভেনির সংগ্রহ করতে ভালবাস, তাই না?
আমি প্রতিবাদ করিনি। আমিও মৃদু হেসেছিলুম।
এই ভেনুশিয়ানের সঙ্গে পরে আমার মাঝে মাঝে দেখা হয়েছিল, তবে মঙ্গলবাসী ও শনিবাসীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলুম। ওদের নাম জানিনা, জিজ্ঞাসাও করিনি। কিন্তু তাদের পরিচয়ের সুবিধের জন্য আমি মনে মনে ওদের নাম দিলুম। মঙ্গলবাসীর নাম দিলুম ফিরকন, শনিবাসীর নাম দিলুম রামু আর ভেনুশিয়ানের নাম দিলুম অরথন।
ফিরকন, রামু এবং অরথন এবার থেকে আমার সঙ্গী। পরে আরও সঙ্গী জুটেছিল। অরথন স্বাউটের ভেতর ঢুকবার সময় আমাকেও ভেতরে যেতে ইশারা করল। আমার হৃৎপিণ্ড বুঝি লাফিয়ে উঠলো। আমার আশা পূর্ণ হতে চলেছে। ফ্লাইং সসারের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবো, হয়তো ওরা আমাকে মহাকাশে নিয়েও যাবে।
ফিরকন ও রামু আমাকে অনুসরণ করল। ফিরকন মনে সেই মঙ্গলবাসী বলল, কি তোমাকে বলেছিলুম না অবাক করে দেব?
অ্যাডামস্কি বলছেন, প্রথমেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ছোট একটি ঘরে। ঘর ছোট হলে কি হবে, দরজা কিন্তু বেশ উচু। ঘরে ঢুকবার সময় শনিবাসী লম্বা রামুকেও মাথা নীচু করতে হলো না। ঘরে ঢুকে রামু মেঝের এক জায়গায় পা দিয়ে টিপতেই দরজা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। মেঝের নিচে এবং স্কাউটের মাথায় কোথাও মৃদু একটা আওয়াজ হচ্ছে।
ঘরে ঢুকে আমি অবাক। কোনদিকে চাইব? ছোট ঘর হলেও দেখবার ও লক্ষ্য করবার মতো কত কি রয়েছে! দরজা বন্ধ, জানালাও দেখা যাচ্ছে না, চারিদিক বন্ধ অথচ নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে না। আরও লক্ষ্য করলুম যে, রামু ফিরকন বা অরথন মহাশূন্যে উঠবার জন্য বিশেষ কোনো পোশাক পরছে না বা আমাকেও পরতে দিচ্ছে না। তবে কি এরা আমাকে নিয়ে উপরে উঠবে না? সন্দেহের দোলায় দুলতে লাগলুম।
আমাকে এরা মহাশূন্যে বা অন্য কোনো গ্রহে নিয়ে যাক বা না যাক, আমি ততক্ষণে এই স্কাউটের গঠনপ্রণালী দেখে নিই।
প্রথমেই নজর করলুম, ঘরের মাঝখানে একটি স্তম্ভ, ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। এই স্তম্ভটি নাকি মহাশূন্য থেকে চুম্বকশক্তি আহরণ করে আর সেই শক্তি হল এই স্কাউট চালক। স্তম্ভটি মেঝেতে দাড়িয়ে আছে বেশ বড় ও পরিষ্কার গোলাকার একটি লেন্সের ওপর। আর সেই লেন্স ঘিরে দুইপ্রান্তে দুটি অর্ধবৃত্তাকার বসবার বেঞ্চি রয়েছে।
লেন্সটির ব্যাস বোধহয় ছফুট হবে। লেন্সটির গঠন নিখুঁত। পরিষ্কার কিন্তু স্বচ্ছ নয়, অর্ধস্বচ্ছ।
ফিরকন আমাকে একটি বেঞ্চে বসতে বলল, নিজে আমার পাশে বসে যন্ত্রপাতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে লাগল। উল্টোদিকের বেঞ্চে বসল রামু আর অরথন গেল কন্ট্রোল রুমে।
এবার বোধহয় স্কাউট ওপরে উঠবে। আমার সেকি পুলক, কি উত্তেজনা। অরথন কন্ট্রোল রুমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ও রামুর সামনে রবারের মতো কোনো জিনিস দিয়ে তৈরী একটা বার ধীর গতিতে পড়ল। ফিরকন আমাকে ওটা ধরতে বলল। স্কাউট ওপরে উঠবার আগে বাকুনি প্রতিরোধ করবার জন্যে এই বার। আমাদের প্লেনের সিটবেল্ট আর কি। আমার কাছে সব অবিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। কিন্তু অবিশ্বাস করি কি করে? সবই তো আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
দেওয়ালে কয়েকটা বড় বড় চার্ট টাঙানো আছে। নানা রং, নানা চিহ্ন, কিছুই বুঝতে পারলাম । না, ওরাও বলল না। আমিও জিজ্ঞাসা করলুম না।
ফিরকন বলল, এই স্কাউট চালাবার জন্যে দুজন লোক দরকার হয়। সাধারণত এগুলিতে দুজন লোকই থাকে। তবে দুজনের বেশী লোক এরা বহন করতে পারে ; এই আমরা এখন যেমন চারজন বসে আছি।
অরথনের কন্ট্রোল রুম দেখতে পাচ্ছি। জটিল কোনো যন্ত্রপাতি চোখে পড়ল না। অধিকাংশ কাজই বোতাম টিপে করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে অরথনের সামনে যেন একটা অরগান রয়েছে, তার চাবি টিপে সে স্কাউট চালাচ্ছে।
নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না তো? বিপদ ঘটলে এরা কি করে? প্যারাগুট থাকলেই বা কি হবে? প্যারাশুট খুলে মহাশূন্যে নামবে কোথায়? তবে কি মৃত্যুবরণ করে? নাকি আত্মহত্যা করে? –
পাইলটের সিটের সামনে একটা পেরিস্কোপ রয়েছে। সেই পেরিস্কোপ দিয়েই পাইলট বাইরে দেখতে পায়। ফিরকন বলল, আমাদের এই স্কাউট ঠিক তোমাদের সাবমেরিনের মতো, নিচে দিয়ে না চলে জলের অনেক ওপর দিয়ে চলছে।
দেওয়ালে যে ম্যাপ ও চার্ট টাঙানো আছে, আমার নজর তখন সেদিকে, যদিও আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ইতিমধ্যে আমাদের স্কাউট ওপরে উঠতে আরম্ভ করেছে, একবার শুধু একটু মৃদু বাকুনি অনুভব করেছিলুম। ম্যাপ ও চার্টের দিকে চেয়েছিলুম, কিন্তু হঠাৎ দেখি কি স্থানবিশেষে আলো জুলে উঠছে, বিভিন্ন রঙের ও বিভিন্ন উজ্জ্বলতার। পাইলট অর্থাৎ অরথন মাঝে মাঝে সেদিকে চেয়ে দেখছে। মনে হলো সেই আলো পাইলটকে নির্দেশ দিচ্ছে।
আমরা যে ঘরে বসে আছি সে ঘরে কিন্তু কোথাও অন্ধকার নেই, এমন কি কোণগুলিও আলোকিত। আলোর রং যে কি, তা আমি বলতে পারব না ; সাদা নয়, নীল নয়, নীলাভ সাদাও নয়, কি রকম তা বলতে পারব না। কিন্তু বেশ মৃদু আলো অথচ ঘরের প্রতিটি সামগ্ৰী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
আমাদের স্কাউট এখন পৃথিবী থেকে অনেক অনেক ওপরে উঠেছে। আমি শারীরিক কোনো অসুবিধা বোধ করছি না, নিশ্বাস নিতেও কোনো কষ্ট হচ্ছে না। স্কাউটের ভেতর নিশ্চয়ই একই বায়ুচাপ রক্ষিত হচ্ছে এবং অনন্তর অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা আছে।
ফিরকন বলল, নিচের দিকে লেন্সটা দেখছ? এই লেন্সের অনেক গুণ। পৃথিবীর যে কোনো জিনিস স্পষ্ট ও বড় আকারে দেখা যায়। এমনকি বিশেষ একটি বস্তু বা ব্যক্তিকেও পৃথকভাবে নজর করা সম্ভব।
ফিরকন আরও বলল, এই রকম একটি লেন্স কাউটের মাথায় আছে। সেটি দূর আকাশ দেখতে সাহায্য করে। মাঝখানে যে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্তত্তটি রয়েছে, ওটিই দূরবীনের কাজ করছে, আবার ওটিই এই স্কাউটের শক্তির উৎস। –
দুটি পৃথক পর্দায় নিচের দিক ও ওপরের দিক দেখবার ব্যবস্থা আছে, যেন দুটি টি, ভি স্বকীন। আমি একটিতে আমাদের পৃথিবীর দৃশ্য এবং অপরটিতে নক্ষত্র দেখতে লাগলুম। কয়েকটি চেনা নক্ষত্র দেখলুম। এগুলি আমার নিজের ১৫ ইঞ্চি টেলিস্কোপে দেখার চেয়ে আরও ভালভাবে দেখা গেল |
ফিরকন বলল, নিচের দিকে দেখ, লেন্সের ভেতর চারটে মোটা মোটা কেবল দেখতে পাচ্ছ? ওদের কাজ কি ? বলছি। এই স্কাউটের নিচে তিনটে বল আছে। স্কাউট যখন নিচে নামে তখন বলগুলিও নীচে নামিয়ে দেওয়া হয়, তোমাদের প্লেনের চাকার মতো আর ওপরে ওঠবার সময় বল তিনটিকে গুটিয়ে নেওয়া হয়। বলগুলো ফাপা, ওগুলো বিদ্যুৎ ভাণ্ডার, মানে ওদের দুরকম কাজ। স্কাউটের ম্যাগনেটিক পোল থেকে তিনটে কেবল বিদ্যুৎ সংগ্রহ করে তিনটি বলে প্রবেশ করিয়ে দেয়। আর চতুর্থ কেবল-এর কাজ ভিন্ন, পাইলটের সামনে যে পেরিস্কোপ আছে সেই পেরিস্কোপ আর ম্যাগনেটিক পোলের সঙ্গে ঐ কেবল যুক্ত। কেবলগুলো সবসময় সক্রিয়। কিন্তু দেওয়ালের চার্টে আলো দেখে এদের কাজ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি আছে স্বকাউটের নিচে।
স্কাউট বা কোনো যন্ত্র বিকল হলে কি কর? আমি প্রশ্ন করি।
স্কাউট ছাড়বার আগে ভাল করে দেখে নেওয়া হয়, সেজন্যে খারাপ হয় না। কিন্তু তবুও যদি খারাপ হয় সেজন্যে প্রতি স্কাউট একটা করে ছোট কারখানা ও উপযুক্ত যন্ত্রপাতি আছে, ফিরকন বলল। –
এরা আমাকে অনেক কিছু দেখাচ্ছে, অনেক কিছুর পরিচয় দিচ্ছে, কিন্তু কোন যন্ত্র কিভাবে কাজ করে তা বলছে না, জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর দিচ্ছে না।
অরথনের গলা শুনলাম, তৈরী হও, এবার আমরা বড় মহাকাশযানে প্রবেশ করব।
সে কি? এইতো পৃথিবীতে ছিলুম। কয়েক মিনিটে এত ওপরে উঠে এলুম? অরথন বলল, হ্যা, বেশী নয়, আমরা চল্লিশ হাজার ফুট ওপরে উঠেছি মাত্র, মাদারশিপ অপেক্ষা করছে, প্রথম যেদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেদিনও এই মাদারশিপ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল, তোমরা সেদিন দেখেছিলে বোধহয়।
কথা বলতে বলতে অরথন পোর্টহােল খুলে দিল। পোর্টহােলের ব্যাস দেড় ফুটের মতো হবে। তার ভেতর দিয়ে নিচে এবং কিছু দূরে আমি মাদারশিপটি দেখতে পেলুম। শূন্যে এমন নিশ্চল হয়ে ভাসছে, যেন শক্ত জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিরাট সিগারের আকারের সেই ক্যারিয়ারশিপ। ফিরকন বলল, ঐ ক্যারিয়ারশিপের ব্যাস দেড়শ ফুট এবং লম্বায় দুহাজার ফুট (ঈশ্বরের সিংহাসন?)।
অনতিবিলম্বে আমাদের স্বকাউট সেই ক্যারিয়ারশিপের ওপর এলো, ক্যারিয়ারশিপের পিঠে বিরাট একটা ডানা যেন সরে গেল আর সেই ফাক দিয়ে আমাদের স্বকাউট তার পেটের ভেতর ঢুকে পড়ল। এত আস্তে অবতরণ করল যে, আমি একটুও কঁকুনি অনুভব করলুম না।
স্কাউট থেকে আমরা বেরিয়ে এলুম। বাইরে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে একটা কেবল, কেবলের প্রান্তে কিছু একটা আটকানো রয়েছে। লোকটি আমাদের অভিবাদন জানিয়ে সেই কেবলটি স্কাউটের একটি অংশের সঙ্গে জুড়ে দিল।
আমি সেদিকে চাইতে রামু বলল, তোমাদের মটর গাড়ী যেমন পেট্রল পাম্পে দাঁড়ালে পাম্প থেকে নজল লাগানো হোসপাইপ দিয়ে পেট্রল ট্যাংকে পেট্রল ভরে দেওয়া হয়, এটাও সেই রকম করা হচ্ছে। তবে পেট্রলের বদলে আমরা অন্য শক্তি বা জ্বালানি ভরে দিচ্ছি। বাইরে যাবার জন্যে স্কাউট সব সময় প্রস্তুত রাখা হয়, কে জানে কার কখন ডাক পড়বে।
ভেতরটা বিরাট, প্রচুর জায়গা। এই ক্যারিয়ারশিপে ছটা স্কাউট থাকে। এর ভেতর যেমন কারখানা ও ল্যাবরেটরি আছে, তেমন সকল রকম আরামের ব্যবস্থাও আছে।
আমি শুধু ভাবছি, এত বড় একটা মহাকাশযান এমন নিশ্চল হয়ে কি করে দাড়িয়ে আছে।
একধারে মহাকাশযানটি চালাবার জন্যে বেশ বড় একটি কন্ট্রোল রুম রয়েছে। দেওয়ালে নানা রকম চর্ট, ম্যাপ, গ্রাফ। এর মধ্যে আবার এক জায়গায় একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপ বসানো আছে।
সমস্ত মহাকাশযানটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কোনো গোলমাল নেই, নেই কোনো তাড়াহুড়োর লক্ষণ। একটা রেডিও রুম তো থাকা দরকার, কিন্তু সেরকম কিছু দেখা গেল না।
আমাকে বসতে বলা হলো। বসবার ব্যবস্থাও বেশ ভালো। সোফা, কৌচ, ডিভান এবং অনুচ্চ টেবিল দ্বারা সুসজ্জিত। সোফাগুলিও বেশ আরামপ্রদ। বেশ সুন্দর কোমল আলোয় মহাকাশযানটি আলোকিত। আমি আরাম করে বসলুম। যা কিছু দেখছি সবেতেই অবাক হচ্ছি। কিন্তু এবার যা দেখলুম তাতে আরও অবাক দেখলুম দুটি অপূর্ব সুদরী যুবতী (হুর-গেলমন?) আমার দিকে এগিয়ে আসছে। যুবতী এবং এত সুদরী মহাকাশচারী আমি আশা করিনি বলেই অবাক হলুম।
ওরা এসে প্রথমে তাদের হাত দিয়ে আমার হাত স্পর্শ করল এবং পরে অতি আলতোভাবে ওষ্ঠ দিয়ে আমার গাল স্পর্শ করল মাত্র। ওরা যে সুদরী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু তাদের ত্বক প্রায় স্বচ্ছ ভালো করে তাদের অনাবৃত দেহ দেখলে বোধহয় দেহের অভ্যন্তরের রক্ত চলাচল এবং অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ দেখা যাবে। একজন আমাকে এক গ্লাস পানীয় দিল শেরাবুন তহুর?)। পান করলুম, শুধু জল কিন্তু একটু ঘন। তেষ্টা পেয়েছিল, সব জলটুকু পান করে ফেললুম। জল পান করতে করতে লক্ষ্য করলুম যুবতী দুটির পরনে গোড়ালি পর্যন্ত বুলওয়ালা এবং কবজি পর্যন্ত হাতওয়ালা একরকম হালকা রঙের গাউন। সেই পোষাক কি কাপড়ের তা বলতে পারব না, তবে দেখে মনে হয় সিন্ধ। পায়ে স্যাণ্ডাল।
দুটি মেয়ের গায়ের রঙে সামান্য পার্থক্য। দুজনেই ফর্সা, তবে একজন ওরই মধ্যে সামান্য মলিন শুনলুম সে মঙ্গলবাসিনী। আমি তার নাম দিলুম ইলমুথ আর অপরজন শুনলুম ভেনাসবাসিনী। তার নাম ভেনাস দেওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু আমি তার নাম দিলুম কালনা।
আমরা বসে কথা বলতে আরম্ভ করলুম। জানতে পারলুম যে, ওরা আরও বড় মহাকাশযান এবং দূরপাল্লার মহাকাশযান তৈরী করেছে। প্রতিটি মহাকাশযান স্বয়ংসম্পূর্ণ। ওরা মহাকাশে ঘুরে বেড়ায়। যে গ্রহে জীব আছে এবং তারা মানুষের মতই জীব, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করাই হলো তাদের উদ্দেশ্য। তারাও অনেকে মহাকাশযান তৈরি করেছে এবং তারাও অন্য গ্রহের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করার উদ্দেশ্যে সেইসব গ্রহে যাওয়া-আসা করে। ব্যতিক্রম পৃথিবী। পৃথিবীবাসীরা গ্রহান্তরের জীবদের নাকি সুনজরে দেখে না।
আমি প্রশ্ন করলুম, তোমাদের ক্যারিয়ারশিপগুলোর গতিবেগ প্রতি সেকেণ্ডে কত মাইল ? অরথন উত্তর দিল। সে বলল, মহাশূন্যে যে প্রবাহ বইছে আমরা সেই প্রবাহ অনুসরণ করে প্রবাহ স্রোতে ভেসে যাই। সেই প্রবাহ স্রোতের যে গতি, আমাদের গতিও তাই।
অরথন আর ইলমুখ উঠে পড়ল। অরথন বলল, তাদের সময় হয়ে গেছে। আমি মনে মনে ভাবি, কিসের সময়? অরথন বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিলো, বলল, দেখতেই পাবে।
একটু পরেই দেখি, ওরা দুজনে এলো পাইলটের পোশাক পরে। আমাদের পৃথিবীর পাইলটের মতো নয়। এদের পোশাক অনেক হাল্কা। দেখে মনে হয় যেন স্কি করতে যাচ্ছে। কিন্তু যারা কি করে তারা পশমের মোটা পোশাক পরে। এদের পোশাকের স্টাইলটা সেই রকম কিন্তু অনেক হান্ধা। ওরা দুজনে এবার বিরাট স্পেস ক্যারিয়ার চালিয়ে নিয়ে যাবে।
কোথায় নিয়ে যাবে? কোনো একটি গ্রহে? মঙ্গল, ভেনাস, শনি? আমিই কি প্রথম মানুষ হবো এই গ্রহ তিনটির একটিতে অবতরণ করতে, নাকি আমার আগে ওরা অন্য মানুষ নিয়ে গেছে?
আমি বসে ফিরকন, রামু এবং কালনার সঙ্গে কথা বলতে লাগলুম। ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এইটুকু বুঝেছিলুম যে, ওরা আমাদের পৃথিবীর সমস্ত খবরই রাখে। মাঝে মাঝে কন্ট্রোল রুম থেকে অরথন বা ইলমুথ এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে। ওরা আমার ওপর বেশ অনেক দিন থেকে নজর রেখেছিল এবং ঠিকই করে রেখেছিল যে, আমাকে ওরা ওদের মহাকাশযানে নিয়ে আসবে এবং ওদের নিজেদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানাবে, যাতে আমি নাকি সে সব কথা পৃথিবীতে ফিরে এসে মর্ত্যবাসীদের জানাতে পারি। জানাতে তো পারি এবং জানাচ্ছিও। কিন্তু আমার কথা ক’জন বিশ্বাস করবে? অথচ আমি যা বলছি এর প্রতিটি কথা সত্য — কেউ বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক।
এই তো ১৯৫১ সালে কোরিয়ার পশ্চিমে ইনচন উপসাগরে একটি সিপ্লেন থেকে সমুদ্রের ভেতরে একটি মিসাইল ক্ষেপণ করা হলো। উৎক্ষিপ্ত মিসাইলটি সবেগে সমুদ্রে ডুবে গেল, প্রতিক্রিয়ার ফলে সমুদ্রের জল একশ ফুট পর্যন্ত উচ্চে উঠল এবং একটু পরে দেখা গেল সেই শূন্যে মিলিয়ে গেল। ঠিক অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল স্কটল্যাণ্ড থেকে কিছু দূরে সমুদ্রে। এই ঘটনা শুনে কেউ তা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এ দৃশ্য বহু নরনারী প্রত্যক্ষ করেছে।
কন্ট্রোল রুম থেকে ইলমুথ একবার বেরিয়ে এসে বলল, আমরা এখন তোমাদের পৃথিবী থেকে পঞ্চাশ হাজার মাইল দূরে। ইলমুথ একটা পোর্টহেল খুলে দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল, ঐ তোমাদের পৃথিবী।
আমি দেখলুম – আমাদের পৃথিবীর ওপর সূর্যের আলো পড়েছে পৃথিবী জুলজুল করছে, কিন্তু চাঁদের মতো তার আলো স্নিগ্ধ নয়। –
অন্ধকার আকাশে আমি দেখলুম কত নক্ষত্র, কেউ জোনাকির মতো ঝিকঝিক করছে, কারও দীপ্তি প্রখর, কারো স্নান। আমি অভিভূত ও আমাকে সমস্ত ক্যারিয়ার দেখাল। বলল, এটা তো ছোট, এতে মাত্র তিরিশজন মানুষ আছে, কিন্তু আমাদের এমন স্পেসশিপ আছে যা হাজার হাজার মানুষ বহন করতে পারে।
আমি প্রশ্ন করি, সেই বিশাল স্পেসশিপের মালিক কোন গ্ৰহ?
কোনো গ্রহই নয়। যখন যার দরকার সে ব্যবহার করতে পারে। ইলমুখ বলল, তুমি বুঝি কেবল তিনটি গ্রহের কথা ভাবছ? এই মহাশূন্যে অনেক গ্রহ আছে, যেখানে সভ্য ও উন্নত মানুষ বাস করে। তাদের কেউ আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে, আবার অনেকে তোমাদের চেয়েও পিছিয়ে আছে।
আমি জিজ্ঞাসা করি, তুমি যে এখন কন্ট্রোল রুম থেকে চলে এসেছ, তা তোমার ডিউটি কে করছে?
কেন? রোবট আছে। সে এই স্পেসশিপ চালাচ্ছে। তবে কন্ট্রোল রুমে অরথন আছে, আমি ফিরে গেলে অরথন আসবে, তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
দেওয়ালে কয়েকখানা ছবি টাঙানো রয়েছে। বেশিরভাগ প্রাকৃতিক দৃশ্য। কিন্তু আমার চোখের সামনে একটা দরজার মাথায় বেশ বড় একখানা ছবি টাঙানো রয়েছে। ছবিখানা দেখে আমার মনে হলো এ ছবি নিশ্চয়ই কোনো দেবতার।
সে দেবতার নাম কি? আমি কালনাকে প্রশ্ন করি — এ ছবি কি কোনো দেবতার? তাঁর নাম কি ?
তোমরা যাকে দেবতা বল ইনি তা নন, তবে ইনি হলেন আমাদের মহত্তম পুরুষ। আমি একে দেখিনি, এর কত বয়স আমি জানি না, কোন গ্রহে থাকেন তা-ও জানি না, তবে শুনেছি এরই নির্দেশে আমরা পরিচালিত হই।
তোমাদের ভেতর কেউ দেখেনি? আমি প্রশ্ন করি।
হ্যা দেখেছেন, তাকে তুমিও শীঘ্রই দেখতে পারে, তোমাদের ভাষায় তিনি আমাদের প্রভু (ঈশ্বর)। আমরাও রূচিৎ তাকে দেখতে পাই। এই মহাকাশযানে তিনি আছেন, কিন্তু আজও তার দর্শন পাইনি। তোমাকে কিছু বলবার জন্য তিনি এসেছেন, তোমার সঙ্গে আমরাও তার দর্শন পাব, তার কথা শুনবো, তার দেওয়া উপদেশ পালন করব।
পৃথিবী ছাড়ার পর থেকে আমি বোধহয় মহাশূন্যে একঘন্টাকাল বিচরণ করছি, কিন্তু এর মধ্যে আমার মনের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। বসে বসে এইসব কথাই চিন্তা করছি।
হঠাৎ অনুভব করলুম আমার সামনের চেয়ারে কোনো জ্যোতির্ময় পুরুষ বসে আছেন। মুখ তুলে দেখি ঠিক তাই। তাঁকে দেখে আমার মনে হলো, আমি কি মীশুর সামনে বসে আছি? তাকে দেখছি?
না, ইনি যীশু নন, তবে নিঃসন্দেহে একজন মহাপুরুষ। শুনলুম এর বয়স হাজার বৎসর। সে কি? দেখে তো মনে হচ্ছে শত বৎসর পূর্ণ হতে এখনও অনেক দেরি।
আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে রামু বলল, আমরা যেমন পুরনো জামা ত্যাগ করে নতুন জামা পরি, ইনিও তেমনি পুরনো দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহে প্রবেশ করেন।
তিনি (মহাপ্রভু) কিন্তু আমার সঙ্গে খুব সাধারণভাবে কথা আরম্ভ করলেন। বললেন, তোমাকে আমরা আমাদের ছোট ও বড় আকাশযান দেখিয়েছি, নক্ষত্ৰলোকের সঙ্গে কিছু পরিচয় করিয়ে দিয়েছি, যাতে তুমি পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে তোমার দেশবাসীকে এসব কথা বলতে পারো। পৃথিবী যে পারমাণবিক শক্তি নিয়ে পরীক্ষা করছে এবং মারণাস্ত্র তৈরী করছে, এজন্য তিনি শংকিত। পার্থিব মানুষের ঐখানেই ক্রটি, তারা শান্তিতে বাস করতে পারছে না।
তিনি বললেন, আমাদের বিষয়ে তোমাদের কিছুই জানা নেই, আমরা আমাদের বিষয়ে জানাবার জন্যে দীর্ঘদিন থেকে চেষ্টা করছি, কিন্তু তোমাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছি না। তিনি অনেক কথা বললেন, যার মূল সুর হলো শান্তি।
তাঁর কাছ থেকে জানলুম যে, তাঁরা পৃথিবীতে মাঝে মাঝে সৎ মানুষ পাঠাচ্ছেন, যারা মানুষকে সংশিক্ষা দিয়ে উন্নত স্তরে পৌছে দিতে পারেন। যীশু হলেন এইরকম একজন মানুষ। যীশুকে তারাই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। পৃথিবী থেকে কিছু মানুষ তারা উঠিয়ে (মে’রাজে) এনে, তাদের শিখিয়ে আবার পৃথিবীতে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পৃথিবীর মানুষ তাদের বুঝতে পারেনি, তাদের শিক্ষা গ্রহণ করেনি , তাদের তারা পাগলা গারদে নিক্ষেপ করেছে বা হত্যা করেছে।
বিদায় নেবার আগে তিনি বললেন যে, এখনও সময় আছে। তিনি আশা করেন যে, পৃথিবীর মানুষ সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে শান্তিতে বাস করবে। শেষ কথা বললেন, সেই মহত্তম পুরুষ যাকে আমরা মানবশ্রেষ্ঠ বলে মনে করি, যার ছবি তুমি দেখতে পাচ্ছ, তাঁর আশীৰ্বাদ তোমার ওপর বর্ষিত হােক। পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে তুমি আমাদের কথা বোলো।
তিনি বিদায় নেবার সঙ্গে সঙ্গে রামু ফিরকন, কালনা এবং অরথন এসে আমার সঙ্গে নানা বিষয় আলোচনা করতে লাগল। মাঝে মাঝে ইলমুথ এসে যোগ দেয়।
বেশ আলোচনা চলছিল এমন সময় রামু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল এবার তোমাকে পৌছে দিয়ে আসি, আজ সময় হয়ে গেছে। স্কাউট রেডি করা হয়েছে। ফিরকন আমাদের সঙ্গে যাবে।
সকলের কাছে বিদায় নিয়ে আমি রামু ও ফিরকনের সঙ্গে স্কাউট গিয়ে উঠলুম। রামু কন্ট্রোলের সামনে বসল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
আমি চুপ করে বসে আছি। আমি যেন আমার মধ্যে নেই। মনকে কিছুতেই স্থির করতে পারছি না। কি দেখলুম, কি শুনলুম এবং কি করব, নানারকম চিন্তা, সকল চিন্তাধারাকে কিছুতেই একটি ধারায় আনতে পারছি না।
কতক্ষণ যে এই অবস্থায় ছিলুম জানি না, ফিরকনের কথায় চমক ভাঙল, আমরা এসে গেছি, পৃথিবীতে পৌঁছে গেছি। এবার আমরা পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করছি না, মাত্র ছইঞ্চি ওপরে ভাসছি।
কন্ট্রোল থেকে উঠে এসে রামু আমার হাত স্পর্শ করে বলল, তোমাকে ফিরকন তোমার হোটেলে পৌছে দেবে। আশা করি তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।
ফিরকন ও আমি স্কাউট থেকে বেরিয়ে এলুম। কিছুদূর হেঁটে গিয়ে গাড়ীতে উঠলুম। সেই পন্টিয়াক গাড়ী সেই নির্জন প্রান্তরে তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। ফিরকন গাড়ী চালিয়ে আমাকে নিয়ে চলল। পথে একটাও কথা হলো না। আমি অভিভূত, কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছি। জানি না আমার মতো এই বিরল অভিজ্ঞতা আর কারও হয়েছে কি না !
হোটেলের সামনে থেকে গাড়ী থামিয়ে ফিরকন আমার হাত স্পর্শ ক্রে বলল, শিগগির আবার দেখা হবে, তোমাকে আমরা জানিয়ে জানিয়ে দেব মানে তুমি নিজেই অনুভব করবে – কবে, কখনও কোথায় আমাদের দেখা হবে (এর পরেও নাকি এ মহাকাশচারীদের সাথে জর্জ অ্যাডামস্কির একাধিকবার যোগাযোগ ঘটেছিল। শেষবারে ঘটেছিলো ১৬ মার্চ, ১৯৬২ সালে – লেখক)।
আমি গাড়ী থেকে বেরিয়ে এসে হাত তুলে ফিরকনকে বিদায় জানালুম। রাস্তা তখন নির্জন, একটিও লোক ছিল না। হোটেলে প্রবেশ করে নিজের ঘরে ঢুকলুম। এই প্রথম আমার ঘড়ির কথা মনে পড়ল, দেখলুম শেষরাত্রি, ৫টা বেজে ১০ মিনিট। এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে মহাশূন্যে আমি অন্তত পঞ্চাশ হাজার মাইল ঘুরে এসেছি।
খাটের প্রান্তে বসে পড়লুম। শুতে ভুলে গেলুম। কিন্তু চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙল বেলা আটটার সময়। –
ব্রেকফাষ্ট সেরে বাসে চেপে আমি প্যালোমারে ভ্যালি সেন্টারে আমার বাড়িতে ফিরে এলুম।
প্ল্যানেট মিসট্রি, চিরঞ্জীব সেন, ১ম প্রকাশ ১৩৮৬, পৃ. ৫৬–৬৪, ৬৬–৭৭।
দূর অতীতের মানুষের কাছে স্বর্গ তথা আকাশ ভ্রমণ করাটা ছিলো একটি অলৌকিক ব্যাপার। তা বিশ্বাস করা শুধুমাত্র ধমীয় দৃষ্টিতেই সম্ভব ছিলো – ঐশ্বরিক ঘটনা বলে। অলৌকিকে বিশ্বাস রাখে এবং রাখে না, এমন কিছু মানুষ সেকালেও ছিলো এবং একালেও আছে। কিন্তু লৌকিকে বিশ্বাস রাখে না, এমন মানুষ সব যুগেই বিরল। কেননা বাস্তবকে অবিশ্বাস করার মানে নিজেকেই অবিশ্বাস করা।
মহাকাশ তথা স্বর্গ ভ্রমণ এখন আর অলৌকিক নয়, বর্তমানে তা হচ্ছে একান্তই লৌকিক ঘটনা। মানুষ চাঁদে অবতরণ করেছে, তা এখন গুরুবাদীরাও অস্বীকার করতে পারেন না। শুক্র, মঙ্গল ইত্যাদি গ্রহে রকেট পাঠানো হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে হয়তো সেখানেও মানুষ অবতরণ করবে।
সৌরজগতের ভিতরে ও তার বাইরে নক্ষত্র-জগতের কোনো গ্রহে কোনোরূপ বুদ্ধিমান জীব আছে কি-না, তার খোজখবর নেওয়া হচ্ছে এবং তাদের সাথে বেতার যোগাযোগের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাকি ইংগিতও পাওয়া যাচ্ছে দূর আকাশে বুদ্ধিমান কোনোরূপ জীব থাকার।
জর্জ অ্যাডামকির মহাকাশ ভ্রমণের বিবৃতিটি হচ্ছে লৌকিক ঘটনার একটি বাস্তবভিত্তিক বর্ণনা। জানি না আধুনিক সুধীমহল বিশেষত বিজ্ঞানীমহল তা কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবেন। অ্যাডামকির বর্ণনার বাস্তবতা প্রমাণিত হলে — দূরতীতের সকল মহাকাশচারীদের মহাকাশ্চারণও অনুরূপ সত্য, একথা অনুমান করা অসঙ্গত নয়।
ঈশ্বর নিরাকার ও সর্বব্যাপী, ধৰ্মজগতে ইহা সর্বত্র স্বীকৃত। ধর্মজগতের বাইরে নাস্তিকমহলে তথাকথিত ঈশ্বরকে মেনে নেয়া হয় না বটে, তবে তাঁরাও এমন একটি মৌলিক শক্তিকে ‘বিশুনিয়ন্তা বলে মেনে নিয়ে থাকেন যে, সে শক্তিও নিরাকার এবং সর্বব্যাপী। এ ক্ষেত্রে আস্তিক ও নাস্তিক মতবাদে বিশেষ পার্থক্য নেই। কিন্তু নাস্তিকরা – ‘নিরাকার অথচ ‘সাকার, এরূপ দ্বিমুখী ঈশ্বরতত্ত্ব মেনে নিতে রাজী নন। তাই তাঁদের বলা হয় নাস্তিক।
ধৰ্মজগতে সাকার ও নিরাকার – এ দুধরণের মতবাদ প্রচলিত থাকলেও নিরাকারবাদীগণও প্রকারান্তরে সাকারবাদীই বটে। যেহেতু বলা হয় যে, ঈশ্বর দেখেন, শোনেন, কথা বলেন, ক্রুদ্ধ হন, খুশি ও বেজার হন, সময়ে হাটাচলাও করেন এবং তিনি বসে আছেন মহাশূন্যের একটি নির্দিষ্ট স্থানে (সিংহাসনে)। সেখানে বসেই নাকি তিনি দূতের মারফতে পৃথিবীর মানুষকে সদুপদেশ দান করেন, যাবতীয় কার্য পরিদর্শন ও পরিচালনা করেন এবং সময় সময় পৃথিবীতেও আসেন ; যেমন এসেছিলেন হযরত মুসা (আ.)-এর সাথে বাক্যালাপ করার জন্য তুর পর্বতে।
মহাকাশ ভ্রমণকারী মনীষীগণ মহাকাশ ভ্রমণে গিয়ে যে ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন এবং যার কাছে মানব-কল্যাণের জন্য নানাবিধ আদেশ-উপদেশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন — তিনি প্রভু, মহাপ্ৰভু যিনিই হােন, তিনি সর্বব্যাপী ও নিরাকার ঈশ্বর নন, নির্দ্ধিতায় তা ‘অনুমান’ করা চলে।
লেখকঃ আরজ আলী মাতুব্বর