Wednesday, May 23, 2018

মানুষ না হয়ে এভাবে মুসলমান হয়ে লাভ কী?


মানুষ না হয়ে এভাবে মুসলমান হয়ে লাভ কী?
সাইয়িদ রফিকুল হক
মাত্র কিছুদিন আগেও আমাদের বাংলাদেশে বেগুন ছিল ২৫-৩০ টাকা কেজি। আর এখন, রোজা শুরুর কয়দিন আগে থেকে তার দামবৃদ্ধি পেতে-পেতে সেই বেগুনের দাম হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেয়ে ৭০-৮০ টাকা কেজি হয়ে গিয়েছে! আর সামান্য শশা ছিল ২০ টাকা, আর খুব বেশি হলে তা ছিল ২৫-৩০ টাকা কেজি। কিন্তু সেই শশারও বেগুনের মতো হঠাৎ করে দামবৃদ্ধি পেয়ে তা হয়ে গিয়েছে ৬০-৭০ টাকা কেজি! একি ‘মগের মুল্লুক’ নাকি? হয়তো বা তা-ই। আসলে, দেশে হঠাৎ করে কোনোকিছুর দামবৃদ্ধি পায়নি। কারণ, মুসলমানদের মাহে রমজানের আগে থেকে পরিকল্পিতভাবে এভাবে দামবৃদ্ধি করছে এদেশেরই একশ্রেণীর মুসলমান-নামধারী কতকগুলো নরপশু।
বাংলাদেশে রোজার আগে সব জিনিসের দাম প্রায় স্থিতিশীল থাকলেও রোজার শুরুতে হঠাৎ করে তার দাম বাড়ানো হয়েছে। আর এই অপকর্মটি করে চলেছে এদেশেরই মুসলমান। এরা নাকি বড়-বড় ব্যবসায়ী। আর নামে একেকটা শিল্পপতি, সিআইপি, ভিআইপি, ভিভিআইপি! আরও কত কী! এরা দেশে কত মসজিদ-মাদ্রাসা বানিয়েছে!
চলতি বছরের রোজার শুরুতে বরাবরের মতো শুধু বেগুন-শশারই দাম বাড়েনি—দাম বেড়েছে অন্যান্য আরও কিছু দ্রব্যসামগ্রীর। রমজান-উপলক্ষে সাধারণ মানুষের গলাকেটে কাঁচাপয়সা-উপার্জনের নিমিত্তে একশ্রেণীর মুসলমান এখন ভয়ানকভাবে দিশেহারা আর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। মনে রাখবেন: এরা শুধুই মুসলমান। আর খুব সহজে এরা মুসলমান হয়ে গিয়েছে। এরা এখনও মানুষ হয়নি। আর এরা কখনও-কোনোদিন মানুষ হবে কিনা তা নিয়েও সবার মনে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে।
রমজানের কয়েকদিন আগে থেকে বেগুন-শশার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাম বেড়েছে টমেটো, লেবু, ধনিয়াপাতা, পুদিনাপাতা, খেজুর, পেঁপে, কলা, আম, লিচুসহ আরও অনেক কিছুর। এদেশের সাধারণ মুসলমানশ্রেণী যে-সব সামগ্রী প্রতিদিন তাদের ইফতারিতে ব্যবহার করে থাকে—ব্যবসায়ী নামক কসাই তথা নরপশুগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে সে-সব পণ্যেরই দাম বাড়িয়েছে। মনে রাখবেন: এরা কিন্তু মুসলমান!
এই তো কয়েকদিন আগে লেবুর হালি ছিল ১০-১৫ টাকা কিংবা আকৃতিতে একটু ভালো বা বড় হলে তা সর্বোচ্চ ২০ টাকা। আমাদের মুসলমানরা রোজার মর্যাদা রাখতে আজ সেই লেবুর হালি পর্যন্ত এখন নিয়ে ঠেকিয়েছে ৪০-৫০ টাকায়! একটা বড় লেবু কিনতে গেলে ১০-১৫ টাকা লাগে! অথচ, রোজার আগে তার দাম ছিল বড়জোর ৪-৫ টাকা। আজ এই রোজার মাসে সেই লেবুর হালি ৪০ টাকা! আর স্থানভেদে কিংবা অভিজাত-বিপণীগুলোতে এই একই লেবু ৫০-৬০ টাকা হালিতে পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে! এরা অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে মাছ-মাংসেরও দাম বাড়িয়েছে!
ছোলা, পেঁয়াজ, চিনি তথা ইফতারসামগ্রীতে ব্যবহৃত প্রায় সব জিনিসের দাম বাড়িয়েছে এদেশেরই ব্যবসায়ী নামক একটি বেজন্মা-গ্রুপ। এরা সবসময় তা-ই করে থাকে। এরা আবার জাতে মুসলমান। এদের অনেকে এখনও কত মসজিদ-মাদ্রাসার সভাপতি আর সেক্রেটারি! এরা আবার আজকের বাংলাদেশে উন্নতজাতের অতিমুসলমান! প্রায় সবাই মডারেট-মুসলমান।
রোজার মাসে পণ্যসামগ্রীর মূল্য-নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার (রোজার আগে) পর্যাপ্ত পরিমাণে পেঁয়াজ, ছোলা, ডাল, চিনি, তেল ইত্যাদিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আমদানি করেছে। এগুলোর সরবরাহ বেশি রাখার জন্য সরকার এই ব্যবস্থা করেছে। বাজারে এখনও পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে দ্রব্যসামগ্রী রয়েছে। মাত্র কয়দিন আগের ১৫ টাকার আলু (স্থানভেদে ১৮-২০ টাকার সেই গোলআলু) আজ ২৫ টাকা হয়ে গিয়েছে! এই না হলে বাংলার ঈমানদার-মুসলমান! দেশের সরকার রোজার মাসে সাধারণ মানুষের মধ্যে অবাধে পণ্যসরবরাহের জন্য বেশ কয়েকটি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক একেবারে তুলে দিয়েছে। এগুলো এখন শুল্কমুক্ত পণ্য। আরও কয়েকটি পণ্যের শুল্কের হার একেবারে কমিয়ে দিয়েছে। তবুও এই ব্যবসায়ী-নামক হায়েনাগুলো সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে নিজেদের স্বার্থে নিয়মিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে! বলুন তো, এরা কি মানুষ? না, নিশ্চয়ই না। এরা নিঃসন্দেহে অমানুষ। আর এই অমানুষগুলোই নাকি আজ মুসলমান!
এখানে, আজ কত সহজে মুসলমান হওয়া যায়। মাথায় একটা সাদা বা যেকোনো রঙের টুপি, মুখে কয়েকগোছা দাড়ি, আর পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি কিংবা লুঙ্গিসমেত পাঞ্জাবি পরলে সেও বিরাট একখান মুসলমান! রমজান-মাসে নিজেদের মুসলমানিত্ব জাহির করার জন্য একশ্রেণীর প্রাণি আদাজল খেয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেয়। আর সে কিন্তু এখনও একসেকেন্ডের জন্য মিথ্যা পরিত্যাগ করেনি! তবুও সে নিজেকে সমাজে-রাষ্ট্রে মুসলমান হিসাবে সাজাতে ও প্রকাশ করতে চায়! স্বার্থের জন্য সমাজে এখন অনেকেই মুসলমান সাজছে।
কারওয়ান-বাজার, চকবাজার, নিউমার্কেট, গাউছিয়াসহ দেশের অধিকাংশ বিপণীগুলোতে গিয়ে দেখুন একশ্রেণীর ছোট-বড় ব্যবসায়ী এই রমজান-মাসে নিজেকে মুসলমান হিসাবে জাহির করার জন্য কতরকমের কলাকৌশল অবলম্বন করে চলেছে। এদের কারও-কারও মাথায় দিবারাত্রির প্রায় ২৪ ঘণ্টা একখান টুপি আছে! আবার কারও-কারও মুখে ইঞ্চিখানেক দাড়ি (রোজার কিছুদিন আগে থেকে তার এই পরিকল্পনা ছিল)! আবার কেউ-কেউ মাথায় টুপি ও পাঞ্জাবি পরে বসে রয়েছে! কিন্তু এসবই ব্যবসা আরকি! আর ধান্দাবাজি সবারই সমান। এরা লোকের কাছে ফাঁকি দিয়ে খারাপ জিনিস বিক্রি করতে ভয়ানক ওস্তাদ। বেশি পণ্য বিক্রির স্বার্থে এরা ক্রেতাদের কাছে এভাবে মুসলমান সেজেছে।
রমজান-মাসেও এদেশের মুসলমান-ব্যবসায়ীরা প্রায় সমস্ত কাঁচামালে, ফলমূলে ও শাকসবজিতে দেদারসে বিষাক্ত ও নিষিদ্ধ কার্বাইড, ফরমালিন, ইথানল ইত্যাদি ব্যবহার করছে। ধর্মবিশ্বাসে এরা সবাই মুসলমান। মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যবিষয়ক ঝুঁকি নিয়ে আজ এদের মধ্যে ন্যূনতম দয়ামায়া নাই। এরা ভয়ানক অর্থলোভী। আর এরাই বুঝি মুসলমান?
অধিক মুনাফার লোভে এই মুসলমান-ব্যবসায়ীসমাজ আজ দেশবাসীকে নানারকম কষ্ট দিচ্ছে। এদের মধ্যে কবে একটুখানি মনুষ্যত্ব জাগবে? আর এরা মানুষ না হয়ে আর কতকাল এভাবে শুধু মুসলমান সেজে থাকবে?
আমাদের, আগে মানুষ হতে হবে। আর সবাইকে হতে হবে মানুষের মতো মানুষ। নামকাওয়াস্তে কোনো-এক মানুষ হলে চলবে না। আমাদের থাকতে হবে মানবিকসত্তা। আমাদের হতে হবে মানবিক। সবার আগে আমাদের মনে মানবিকতা জাগ্রত করতে হবে। আর একজন মানুষ হিসাবে অবশ্যই মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটাতে হবে। সমগ্র মানবজীবনে একমাত্র মনুষ্যত্বই শ্রেষ্ঠ অর্জন। আর পৃথিবীতে মানুষ না-হয়ে কিংবা অমানুষে পরিণত হয়ে ধর্মপালন করতে যাওয়াটা সম্পূর্ণ বোকামি। কারণ, পশুদের ধর্মপালনের কোনো প্রয়োজন নাই। তাই, সবার আগে এইসব মুনাফালোভী-কালোবাজারিচক্রকে আগে মানুষ হতে হবে। তারপর তাদের মুসলমান হওয়ার কথা ভাবতে হবে। আর চিরদিন মনে রাখতে হবে: নিজস্বার্থে মানুষের গলায় ছুরি চালিয়ে কখনও-কোনোদিন ধার্মিক হওয়া যায় না।
দেশের মুসলমান-ব্যবসায়ীরা রমজান-মাস উপলক্ষে রাতারাতি জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের গলাকেটে অবৈধ উপায়ে অর্থোপার্জন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করছে না। এদের মধ্যে মানবিকসত্তা একেবারে অনুপস্থিত। এদের কারও মধ্যে মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, ভ্রাতৃত্ববোধ কোনোকিছুই দেখতে পাই না। এরা চেনে শুধু টাকা। আজ এদের মনুষ্যত্ব নাই। আর এদের কারও মধ্যে কোনোদিন সামান্য মনুষ্যত্ব ছিল কিনা সন্দেহ। এই অমানুষগুলোই সমাজে-রাষ্ট্রে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য এখন নিজেদের মুসলমান বলে প্রচার করছে। এরা নামে ও জাতে আসলেই মুসলমান। কিন্তু এদের কাউকেই আজ মানুষ বলা যায় না। এইসব স্বার্থপর-অমানুষ শুধু মুসলমান হয়েছে কিন্তু মানুষ হয়নি। তাই, মানুষ না হয়ে এভাবে মুসলমান হয়ে লাভ কী? আর মানুষ না হয়ে এভাবে মুসলমান সেজে লাভ কী?
সাইয়িদ রফিকুল হক
১৮/০৫/২০১৮
(পহেলা রমজান, ১৪৩৯ হিজরী)

No comments:

Post a Comment