Sunday, May 13, 2018

তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । নারী ও মুহাম্মদ
পশ্চিমা পণ্ডিত ইজহাক গোল্ডজিহার বলেছেন, ইসলাম প্রতিষ্ঠাতার কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কোরান, হাদিস ও জীবনীগ্রন্থগুলো যেভাবে অকপট ও বিস্তারিত তথ্যসমৃদ্ধ, অন্যান্য ধর্মের পবিত্রগ্রন্থ, ধর্মপ্রচারকের কীর্তিগাঁথা এবং ইতিহাসের বইগুলো সেদিক থেকে সমকক্ষ নয়। গোল্ডজিহার তার অত্যন্ত মূল্যবান বই Le dogme et la loi de l’Islam – slā একটি অধ্যায়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্যের মাধ্যমে নারীদের প্রতি নবি মুহাম্মদের ক্রমবর্ধান প্রীতি সম্পর্কে বিশদভাবে নথিভুক্ত ঐতিহাসিক সত্যগুলো তুলেধরেছেন। ইব্রাহিম এবং নুহ ছাড়াও যিশু এবং মুসা নবির জীবন সম্পর্কে আমরা যা জানি তা আসলে জনপ্রিয় কল্পপুরাণে তৈরি কুয়াশার বাতাবরণে ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার ধারণায় আবদ্ধ। নবি মুহামদের জীবন সম্পর্কে কোরানের আয়াত, নির্ভরযোগ্য হাদিস এবং প্রথমদিককার জীবনী-গ্রন্থগুলোতে শতাধিক বর্ণনা রয়েছে যেগুলো পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ থেকে মুক্ত। এ-উৎসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোরান, যার আয়াতে সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনাবলী সম্পর্কে তথ্য সরাসরি পাওয়া যায়; এবং আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময়কালীন প্রেক্ষাপটসমূহ তফসিরকারকদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে জানা যায়। নবি মুহাম্মদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কিত আয়াতগুলোর সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে অনেক বেশি।
কোরানের সকল তফসিরকারক একমত যে, ইহুদিদের দ্বারা নবির নারীসঙ্গ প্রীতির সমালোচনার প্রেক্ষিতে সুরা নিসা-এর ৫৪ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। ইহুদিদের অভিযোগ ছিল স্ত্রীসঙ্গ গ্রহণ ছাড়া নবির অন্য কোনো কাজ নেই। আয়াতে বলা হয়েছে : “তারা কি ঈর্ষা করে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা-যা দিয়েছেন? কারণ আমি ইব্রাহিমের বংশধরকে তো কিতাব ও হিকমত দিয়েছিলাম, আর তাদেরকে দিয়েছিলাম এক বিশাল রাজ্য। (৪:৫৪)।
আল্লাহ-প্রদত্ত নবুওতির অধিকার এবং অধিক সংখ্যক স্ত্রী থাকার দরুন মুহাম্মদের প্রতি ইহুদিরা ঈর্ষান্বিত ছিল। ইহুদিদের বক্তব্য ছিল, একজন সত্যিকারের নবি এতোবেশিসংখ্যক স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন না। আয়াতের দ্বিতীয় বাক্যে সমালোচকদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে এবং আবশ্যিকভাবে তা দাউদ এবং সলোমনের মতো নবিদের প্রতি ইঙ্গিত করা হচ্ছে। উক্ত নবিদের নিরানব্বইজন করে স্ত্রী ও এক হাজারের মতো হারেমবাসী নারীসঙ্গী থাকার পরেও তাদের দুজনের নবি হিসেবে মর্যাদায় কোনো হানি ঘটেনি। ইসরাইলের সন্তানদের অন্যান্য রাজার কাহিনীর মতো এই ধারণাগুলো কল্পনার সুতোয় বোনা অত্যুক্তি মাত্র।
কোনো কোনো ইউরোপীয় সমালোচকদের মতে, যে ধর্মপ্রচারক পূর্বপুরুষের সংস্কার-বিশ্বাসকে প্রত্যাখান করে, সংশোধন করে নিজস্ব ধর্মপ্রচার করে গিয়েছেন, তার ব্যক্তিত্বের সাথে এরূপ মাত্রাতিরিক্ত নারীসঙ্গপ্রীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সমালোচক কয়েকজনের মতে, ইসলামের যেসব বিধি-বিধান নারীর মর্যাদা এবং অধিকারের উন্নয়ন ঘটিয়েছে সেগুলো নারীর প্রতি মুহাম্মদের ভালোলাগা থেকেই উৎসারিত হয়েছে।
অবশ্যই একজন মানুষ এবং প্রতিটি মানুষেরই দুর্বল দিক রয়েছে। যৌনচাহিদা মানুষের একটি আবশ্যিক প্রবৃত্তি এবং অন্যদের সম্পর্কে চিন্তা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এটা তখনই তিরস্কারযোগ্য যখন সমাজে ক্ষতিকর আচরণের বিস্তার ঘটায়। অন্যথায় একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের ভালো-মন্দ, শক্তি-দুর্বলতা নিয়ে আলোচনার কোনো অর্থ নেই। খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকে সক্রেটিসের ভাবনা এথেন্স থেকে গ্রিসের সর্বত্র এবং পর্যায়ক্রমে সমগ্র মানবজাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। সক্রেটিসের ব্যক্তিগত জীবন কি ঘৃণ্য ছিল, এই প্রশ্নটি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে যদি না তিনি তার জীবনাচরণের মাধ্যমে সমাজের কোনো ক্ষতি সাধন করে থাকেন। অ্যাডলফ হিটলারকে যৌনপ্রবৃত্তির উর্ধ্বে বলা যায় কারণ এদিক থেকে তিনি অক্ষম কিংবা সীমিতভাবে সক্ষম ছিলেন। পক্ষান্তরে তিনি ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারা পোষণ করতেন যা পৃথিবীকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
নবি মুহামদ নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছেন। তার জনগণকে পৌত্তলিকতার অন্ধকূপ থেকে উদ্ধারে ব্রত ছিলেন। মুহাম্মদের নারী-প্রীতি কিংবা অনেক স্ত্রী গ্রহণের ঘটনা তার চূড়ান্ত লক্ষ্যের প্রতি যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেনি কিংবা তা অন্যদের অধিকারকেও ক্ষুন্ন করেনি। মহান নেতাদের কাজের ধরন ও চিন্তাধারাকে সমসাময়িক সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুসারে এবং সমাজ ও মানবজাতির কল্যাণে এগুলোর অবদানের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা উচিত। অথচ এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করলে, মানুষের চিন্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের ফলে যারা একমাত্র বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, অথবা বেঁচে থাকার জন্য কতগুলো কঠোর শর্তের ভিত্তিতে নিজেদের সহায়-সম্পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের এই বিষয়গুলো নিয়ে তুলনামূলকভাবে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ বেশি রয়েছে।
মুসলমানদের বিবেচনাবোধে ভুল ছিল, যদিও তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার। ইসলামের প্রতিষ্ঠাতাকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে মুসলিম পণ্ডিতেরা এমন সব বক্তব্য পেশ করেছেন ও লিখেছেন যা কোরানের স্পষ্টভাবে বোধগম্য আয়াত এবং নির্ভরযোগ্য আদি ঐতিহাসিক তথ্যগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক। মিশরীয় গবেষক এবং শিক্ষামন্ত্রী মুহামদ হোসেন হায়কল তার লাইফ অব মুহাম্মদ বইয়ে বিংশ শতাব্দীর জ্ঞানের আলোকে এই বিষয়ে নিরীক্ষা করতে গিয়ে পাশ্চাত্য সমালোচনার প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এমন-কী বইটির একটি অধ্যায়ে অযাচিতভাবে নবির নারীপ্রীতিকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। ওই অধ্যায়ের একটি অনুচ্ছেদ এখানে উল্লেখ করা হলো: “খাদিজার সাথে দীর্ঘ বিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে নবি মুহাম্মদ কখনো একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। …এটা খুবই স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী একটি ব্যাপার। খাদিজা একজন ধনী সন্ত্রান্ত মহিলা ছিলেন। তিনি একজন গরীব, কিন্তু সৎ ও কঠোর পরিশ্রমী কর্মচারীকে বিয়ে করেছিলেন। খাদিজা মুহামদকে নিজ গৃহে জায়গা দিয়েছিলেন, কেননা স্বীয় স্বভাব কিংবা দারিদ্র্যের কারণে মুহাম্মদ অন্যান্য কুরাইশ যুবকের মতো উদাম যৌনতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেননি। এ কারণেই বয়স্ক ও অভিজ্ঞ খাদিজা মনেপ্রাণে নিজের থেকে পনেরো বছরের ছোট স্বামীর যত্ন নিয়েছেন। নিজের অর্থবিত্ত কাজে লাগিয়ে মুহাম্মদকে সচ্ছলভাবে জীবনযাপনে সাহায্য করেছেন যেন মুহামদ তার বাল্যজীবনের দুঃখকষ্ট ও চাচার উপর নির্ভরতার কথা ভুলে থাকতে পারেন। খাদিজার গৃহের নিরিবিলি ও আরামদায়ক পরিবেশে মুহাম্মদ তার দশ-বারো বছর ধরে জমে থাকা চিন্তাভাবনাকে পরিপূর্ণতা দানের সুযোগ পেয়েছেন। খাদিজা নিজে মুহাম্মদের মৌলিক চিন্তাধারার সাথে একমত ছিলেন। কেননা ওয়ারাকা বিন নওফলের চাচাতো বোন হিসেবে তিনিও হানিফদের নন্দনতত্ত্বের প্রতি আগ্রহী ছিলেন”। মুহাম্মদের নবুওতি লাভের পর খাদিজা তার স্বামীর লক্ষের সত্যতা ও স্বগীয় অনুপ্রেরণার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। উল্লেখ্য খাদিজা মুহাম্মদের চার কন্যা জয়নাব, রোকেয়া, উমে কুলসুম এবং ফাতেমার মাতা ছিলেন”। এই পরিস্থিতিতে খাদিজার জীবদ্দশায় মুহামদ কিভাবে আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারতেন? কেবল খাদিজার মৃত্যুর পরে মুহাম্মদ আয়েশার পাণিপ্রার্থী হয়েছিলেন। অন্যদিকে আয়েশা যেহেতু সাত বছর বয়সী শিশু ছিলেন সেজন্য আস-সাকরান বিন আমরের বিধবা স্ত্রী সওদাকে বিয়ে করেছিলেন। এরপর হায়কল তার বইয়ে মন্তব্য করেন, ‘সওদার না ছিল রূপ, না ছিল ধনদৌলত। তাঁকে বিয়ে করে নবি মুহাম্মদ আবিসিনীয় একজন মুসলিম অভিবাসীর নিঃসঙ্গ বিধবা স্ত্রীর প্রতি বদান্যতা ও কৃপার কাজ করেছেন।
নবি মুহাম্মদ সওদাকে বিয়ে করেছেন কারণ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা হিসেবে তিনি গৃহকার্যে পারদর্শী এবং চারটি শিশুকন্যাকে দেখাশোনায় সক্ষম-হায়কল এমনটা লিখলে আরও ভালো হতো। যদিও এই বক্তব্যের বিরোধিতার সুযোগ রয়েছে। কারণ নবি মুহাম্মদ প্রথমে আয়েশার কথা চিন্তা করেছিলেন। আয়েশা এতোটা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন যে, তিনি দুবছর অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করতে পারতেন না। পরবর্তীতে মুহাম্মদ সওদাকে বিয়ে করেন। হতে পারে তিনি স্ত্রীসঙ্গবিহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন না। এমন যুক্তিকে সমালোচনা করার কারণ নেই। সম্ভাব্য আরেকটি কারণ হতে পারে, ওই সময়ে বিয়ের উপযোগী অন্য কোনো মহিলার অনুপস্থিতি। কুরাইশরা মুহাম্মদকে নিজেদের কন্যাদানে অনাগ্রহী ছিলেন। আবার মুসলমানদের বিয়ের উপযোগী কোনো কন্যাসন্তান ছিল না। সময়টা ছিল খাদিজার মৃত্যু-পরবর্তীকালীন দুই বাতিন বছর। নবি তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন। ইয়াসরিব বা মদিনায় অভিবাসনের পর নবি মুহাম্মদের জীবনধারা পাল্টে যায়। তখন নারীদের প্রতি আগ্রহ পূরণের সুযোগ আসে। এই সত্যকে অস্বীকার করার প্রয়োজন নেই। সহীহ বুখারিতে নবি মুহাম্মদের নয় জন স্ত্রী ও দুই জন দাসীর সাথে যৌন সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং বলা বাহুল্য, সে যুগের নৈতিকতার সাথে ব্যাপারটি বেমানান নয়। কিন্তু তাঁকে সর্বকালের জন্য মানুষের আদর্শ বলে দাবি করলে বিপত্তির সূচনা ঘটে – অনুবাদক ] নবি মুহাম্মদের স্ত্রীদের মোটামুটি একটি পূর্ণ তালিকা নীচে উল্লেখ করা হল :
১. খুয়েলিদ ইবনে আসাদের কন্যা খাদিজা একজন ধনী, সন্ত্রান্ত মহিলা। মুহাম্মদ ছিলেন খাদিজার তৃতীয় স্বামী। খাদিজার গর্ভে নবি মুহাম্মদের প্রথম পুত্র সন্তান কাশেম, দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগে মৃত্যু হয়। এরপর জয়নাব, রোকেয়া, উম্মে কুলসুম এবং ফাতেমা চার কন্যাসন্তানের জন্ম দেন খাদিজা। আত-তাহের নামের আরেকটি পুত্রসন্তান হয় তাদের ঘরে। কিন্তু ওই পুত্র সন্তানটিও শৈশবে মারা যান।
২. জামার কন্যা সওদা। তিনি আবিসিনিয়ায় অভিবাসিত একজন মুসলমানের বিধবা স্ত্রী। মিশরীয় বুদ্ধিজীবী হায়কলের অভিমত, নবি তাঁকে বিয়ে করেছিলেন একজন নিঃসঙ্গ মুসলমান বিধবার প্রতি করুণা হিসেবে। হায়কলের অভিমত উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
৩. হজরত আবু বকর আস-সিদ্দিকির কন্যা আয়েশা। সাত বছর বয়সে মুহামদের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয় এবং নয় বছর বয়সে তিনি মুহাম্মদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুজনের বয়সের পার্থক্য প্রায় চল্লিশ বছর। হিজরি ১১ সনে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) যখন মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেন, তখন আয়েশার বয়স ষোল অথবা সতের। তিনি নবির সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। হৃদয় থেকে কোরান শিক্ষালাভকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। নবির বচন ও কর্মের (হাদিস) এবং মুসলমানদের সংস্কৃতি সম্পর্কিত তথ্যেরও একজন গুরুত্বপূর্ণ উৎস তিনি। খলিফা উসমান হত্যাকাণ্ডের পর বিবি আয়েশা আলি বিন আবু তালিবের খলিফা পদে আসীন হওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন।আয়েশা হিজরি ৩৬ (৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ) সনে আলির বিরুদ্ধে জঙ্গে জামাল বা উটের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেপরাজিত হোন।
৪. মক্কা থেকে মদিনায় অভিবাসী এবং ওহুদের যুদ্ধে আহত হয়ে মৃত্যুবরণকারী একজন মুসলমানের স্ত্রী উমে সালমা।
৫. হজরত ওমর বিন আল-খাত্তাবের কন্যা হাফসা। স্বামী মৃত্যুর পর তারও নবির সাথে বিয়ে হয়। এই বিয়ের একটি প্রায়োগিক দিক রয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
৬. জাহাশের কন্যা জয়নাব। তিনি নবির পালকপুত্র (মুক্তদাস) জায়েদ বিন আল-হারিসের প্রাক্তন স্ত্রী। জয়নাবের সঙ্গে নবি মুহাম্মদের বিয়েকে অন্যতম ভালোবাসার বন্ধন হিসেবে গণ্য করা হয়। জায়েদ ও জয়নাবের সম্পর্ক নিয়ে একটি দীর্ঘ বর্ণনামূলক কবিতা রয়েছে। জয়নাবের জন্য নবির প্রীতি ও আদর এতোই বেশি ছিল, তাকে আয়েশার একজন প্রতিদ্বন্দীতে পরিণত করে।
৭. মুসতালিক গোত্রের প্রধান আল-হারিস বিন আবু দেরার-এর কন্যা ও মুসাফির বিন সাফওয়ানের প্রাক্তন স্ত্রী জুয়ায়রিয়া। হিজরি ৫৪ (৬২৭ খ্রিস্টাব্দে) সালে বানু-মুসতালিক গোত্রের পরাজয়ের পর জুয়ায়রিয়াকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করা হয় এবং পরবর্তীতে মুসলমান যোদ্ধাদের মধ্যে একজনের গনিমতের মালে হিসেবে জায়গা হয়। জুয়ায়রিয়ার মালিক তাঁকে একটি নির্দিষ্ট মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা ছিল তার সাধ্যের বাইরে। জুয়ায়রিয়া তাই নবি মুহাম্মদের বাড়িতে গিয়ে সাহায্য চাইলেন, নবি যেন মুক্তিপণের পরিমাণ কমাতে মধ্যস্থতার দায়িত্ব নেন। পরবর্তী কাহিনী বিবি আয়েশার বর্ণনা অনুযায়ী, জুয়ায়রিয়ার সৌন্দর্য ও মাধুর্য এমনই ছিল যে, তাঁকে দেখামাত্র সবাই পুলকিত বোধ করত। জুয়ায়রিয়াকে আমার ঘরের দরজার সামনে দেখে আমি বিচলিত বোধ করি। কেননা নিশ্চিত ছিলাম আল্লাহর বান্দা তাঁকে দেখামাত্র পছন্দ করবেন এবং সেটাই হলো। জুয়ায়রিয়া যখন নবির সাথে দেখা করার সুযোগ পেলেন এবং আর্জি ব্যক্ত করলেন, নবি তখন বললেন, তিনি জুয়ায়রিয়ার জন্য আরও ভালো কিছু করবেন- নবি নিজে তার মুক্তিপণ পরিশোধ করবেন এবং পাণিপ্রার্থী হবেন। জুয়ায়রিয়া তা শুনে খুশি হয়ে সম্মতি জানালেন। নবির সাথে জুয়ায়রিয়ার বিয়ের পর মুসলমানরা মুসতালিক গোত্রের বন্দীদের অনেককে ছেড়ে দিলেন। যেহেতু তাঁরা নবি মুহাম্মদের তালাতো ভাইবোন ছিল। আমি অন্য কোনো নারীর কথা জানি না, যে নিজের আত্মীয়-স্বজনদের জন্য এমন সুন্দর পরিণতি ও আশীৰ্বাদ বয়ে নিয়ে এসেছে।’
৮. আবু সুফিয়ানের কন্যা উমে হাবিবা (আরেক নাম রামালা)। তার প্রথম স্বামী উবাদুল্লাহ বিন জাহাশ আবিসিনায় মৃত্যুবরণ করেন।
৯. খায়বারের ইহুদি নেতা কেনানা বিন আবু রাবিয়ার স্ত্রী সাফিয়া। তিনি হোয়ায় বিন আকতাবের কন্যা। খায়বার যুদ্ধে বন্দী হওয়ার পর নবি তাঁকে গনিমতের মাল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। খায়বার থেকে মদিনায় আসার পরে নবি তাকে বিয়ে করেন।
১০. হেলাল গোত্রের আল-হারিসের কন্যা মায়মুনা। মায়মুনার এক বোনের বিয়ে হয়েছিল আবু সুফিয়ানের সাথে এবং আরেক বোনের সাথে আব্বাস বিন আব্দুল মোতালেবের বিয়ে হয়েছিল। মায়মুনা খালেদ বিন আল-ওয়ালিদের খালা। (খালেদ পরবর্তীতে সিরিয়া দখলে ভূমিকা রাখেন)। কথিত আছে মায়মুনার সাথে নবির বিয়ের পর খালেদ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নবি তাকে কয়েকটি ঘোড়া উপহার দিয়ে বরণ করে নেন।
১১. শোরাইয়ার কন্যা ফাতেমা।
১২. ইয়াজিদের কন্যা হিন্দ (উম্মে সালমা)।
১৩. শাবার কন্যা আসমা ।
১৪. খোজায়মার কন্যা জয়নাব।
১৫. কায়েসের কন্যা হবলা। হাবলার ভাই আল-আশাত বিন কায়েস দক্ষিণ আরবের এক নেতা। তিনি ইরান দখলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।(৭০)
১৬. নোমানের কন্যা আসমা। নবি এই বিয়েকে পূর্ণতা দান করেননি।
১৭. আদ-জাহাকের কন্যা ফাতেমা। এই বিয়েও পূর্ণতা পায়নি।
১৮. মিশরীয় কপটিক খ্রিস্টান ক্রীতদাসী মারিয়া (মেরি দ্য কপ্ট বা মারিয়া কিবতিয়া)। তাঁকে ৬২৮ সালে মিশরের রোমান গভর্নর (ইসলামের ইতিহাসে মিশরের শাসকদের ‘আল-মুকাওকিস”নামে ডাকা হয়) উপহারস্বরূপ দান করেছিলেন নবিকে”। মারিয়ার গর্ভে নবির ইব্রাহিম নামের এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু শৈশবেই শিশুটির মৃত্যু ঘটে।
১৯. মারিয়ার মতো রায়হানাও কোরানের ভাষায় তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যাদের মালিক হয়ে যায় বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ রায়হানা ছিলেন একজন ক্রীতদাসী। তার সাথে বিয়ের প্রয়োজন ছিল না এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনেও কোনো বাধা ছিল না। তিনি ইহুদি গোত্র বানু-কুরাইজার একজন যুদ্ধবন্দী। যুদ্ধ শেষে তিনি গনিমতের মাল হিসেবে নবির কাছে জায়গা হয়েছিল। কিন্তু তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণে রাজি হননি এবং নবির সাথে কোনো চুক্তিভিত্তিক বিয়েতেও রাজি হননি। শেষে নবির গৃহে একজন গৃহপরিচারিকা হিসেবেই ছিলেন।
২০. দাউস গোত্রের উম্মে শারিক। তিনি সেই চারজন নারীর মধ্যে একজন, যারা নিজেদের নবির কাছে সমর্পণ করেছিলেন। চুক্তিভিত্তিক বিবাহিত নারী এবং অস্থায়ী সঙ্গী ছাড়াও নবির গৃহে আরও কয়েকজন নারী ছিলেন তাঁরা এই শ্রেণিতে পড়েন। চুক্তিভিত্তিক বিবাহিত স্ত্রীর সংখ্যা সর্বোচ্চ চারজন হতে পারে। এ-ধরনের বিয়েতে মোহরানা, সাক্ষীদের উপস্থিতি এবং নারীর পিতা কিংবা অন্য অভিভাবকের সমতির প্রয়োজন রয়েছে। ক্রীতদাসীর সাথে মুসলমানদের যৌনসম্পর্ক স্থাপনে বৈধতা দেয়া হয়েছে, যদি ওই নারীর স্বামী পৌত্তলিক কিংবা অবিশ্বাসী হয়ে থাকেন। আর কেবলমাত্র নবির ক্ষেত্রে নিজেকে সমর্পণকারী কোনো নারীর সাথে নবির বিয়ের বৈধতা দেয়া হয়েছে সুরা আহজাব-এর ৫০ নম্বর আয়াতের শেষ অংশে। নবির কাছে নিজেদেরকে সমর্পণকারী অন্য তিনজন মহিলা হচ্ছেন মায়মুনা, জয়নাব এবং খাওলা।
উমে শারিক যখন নিজেকে নবির কাছে উপহার হিসেবে সমর্পণ করলেন বিবি আয়েশা তখন উদ্বিগ্ন বোধ করলেন। কেননা উমে শারিক ছিলেন খুব সুন্দরী এবং মুহাম্মদ উপহার হিসেবে তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করেন। হাদিসে আছে এ- ঘটনায় ঈর্ষা ও অসমান অনুভব করেন বিবি আয়েশা। তিনি বলেন, যে নারী নিজেকে একজন পুরুষের কাছে সমৰ্পিত করে, তার নিজের কী মূল্য থাকতে পারে এ ভেবে আমি আশ্বর্যান্বিত হই। সুরা আহজাবের ৫০ নম্বর আয়াতের শেষাংশ কোনো বিশ্বাসী নারী নবির কাছে নিবেদন করলে আর নবি তাকে বিয়ে করে বৈধ করতে চাইলে সেও বৈধ এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছিল যেখানে উম্মে শারিককে উপহার হিসেবে নবি কর্তৃক গ্রহণকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। একথা শুনে আয়েশা রাগান্বিত হয়ে বলেন : আপনার প্রভু আপনার ইচ্ছাকে অনুমোদন দিতে ওহি পাঠাতে খুব একট বিলম্ব করেন না, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। [ বুখারি হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী : খাওলা বিনতে হাকিমসহ কয়েকজন বিয়ের জন্য আল্লাহর নবির কাছে নিজেদের সমর্পন করেছিলেন। আয়েশা বললেন, ‘এই মেয়েদের কী লজ্জা-শরম নেই, তাঁরা যেচে এসে পুরুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করছে? এ-সময় সুরা আহজাবের ৫০-৫১ নম্বর আয়াতদ্বয় নাজিল হয়, যেখানে বলা হয়েছে, . . . তুমি ওদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তোমার কাছ থেকে দূরে রাখতে পার ও যাকে ইচ্ছা গ্রহণ করতে পার… (৩৩:৫১)। আয়েশা তখন বলেন, ‘হে আল্লাহর নবি! আপনাকে খুশি করতে আপনার প্রভু তো দেখি খুব একটা দেরি করেন না। দ্রষ্টব্য: বুখারি শরিফ, ভলিউম ৭, বুক ৬২ নম্বর ৪৮ – অনুবাদক)।
তফসির আল-জালালাইনের লেখক মিশরের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ জালালউদ্দিন আল-মাহালি ও জালালউদ্দিন আল-সুয়তির ভাষ্য থেকে বিবি আয়েশা ও নবির মনোমালিন্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী উম্মে শারিকের সাথে নবির সম্পর্ক হওয়ার পর এবং সুরা আহজাব-এর ৫০ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হবার পর আয়েশা রূঢ়ভাবে বলে ওঠেন, যে নারী নিজেকে একজন পুরুষের কাছে আগ বাড়িয়ে সমৰ্পিত করে, তার নিজের কী মূল্য থাকতে পারে, এ ভেবে আমি আশ্চর্যান্বিত হই। পরবর্তীতে ৫১ নম্বর আয়াতে আয়েশাকে তিরস্কার করা হয় এবং ওই আয়াত অবতীর্ণ হবার পরেই নবির ইচ্ছাপূরণে প্ৰভু সময়ক্ষেপণ করেন না বলে আয়েশা মন্তব্য করেন। সুরা আহজাব-এর ৫০ নম্বর আয়াতে স্ত্রী ও ক্রীতদাসী গ্রহণে নবির অধিকারের কথা বলা হয়েছে: “হে নবি! আমি তোমার জন্য তোমার স্ত্রীদেরকে বৈধ করেছি যাদেরকে তুমি দেনমোহর দিয়েছ ও বৈধ করেছি তোমার ভান হাতের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে যাদেরকে আমি দান করেছি, এবং বিয়ের জন্য বৈধ করেছি তোমার চাচাতো, করলে আর নবি তাকে বিয়ে করে বৈধ করতে চাইলে সেও বৈধ। এ বিশেষ করে তোমারই জন্য, অন্য বিশ্বাসীদের জন্য নয়…।” (৩৩:৫০)। একই আয়াতে আরও বলা হয়েছে: বিশ্বাসীদের স্ত্রী ও তাদের দাসীদের সম্বন্ধে আমি যা নির্ধারণ করেছি তা আমি জানি। এই আয়াতের শেষাংশ নিয়ে বিবি আয়েশা প্রতিবাদ করলে ৫১ নম্বর আয়াতে সতর্কতা জারি করা হয়, যার মাধ্যমে স্ত্রীর ওপর নবির ক্ষমা চূড়ান্ত এবং অসীম পর্যায়ে উন্নীত করা হয়। এর ফলে স্ত্রীরা নবির কোনো কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হন: তুমি ওদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা দূরে রাখতে পার ও যাকে ইচ্ছা গ্রহণ করতে পার, আর তুমি যাকে দূরে রেখেছ তাকে কামনা করলে তোমার কোনো দোষ নেই। এ-বিধান এজন্য যে, এতে ওদেরকে খুশি করা সহজ হবে আর ওরা দুঃখ পাবে না, এবং ওদেরকে তুমি যা দেবে তাতে ওদের প্রত্যেকেই খুশি থাকবে। তোমাদের অন্তরে যা আছে আল্লাহ তা জানেন। আল্লাহ সব জানেন, সহ্য করেন। (৩৩:৫১)।
আল-জামাখশারি তার লেখা কোরানের তফসিরগ্রন্থ “আল-কাশশাফ- এ সুরা আহজাবের ৫১ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, “নবির স্ত্রীরা যারা একে অন্যের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ এবং প্রতিদ্বন্দী ছিলেন তারা নিজেরা বেশি করে গনিমতের মালের ভাগ চেয়েছিলেন। (বানু কুরাইজা লোকদের হত্যা করার পর, মুসলমানরা প্রচুর পরিমাণ গনিমতের মাল পেয়েছিলেন। তখন নবির স্ত্রীরা এখান থেকে এক পঞ্চমাংশ ভাগ পাওয়ার আশা করেছিলেন)। বিবি আয়েশাকে উদ্ধৃত করে জামাখশারি বলেন, ৫১ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হবার আগ পর্যন্ত এক মাস নবি তার স্ত্রীদের সঙ্গ ত্যাগ করেন। ওই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর ভীতসন্ত্রস্ত স্ত্রীরা নবিকে তার ইচ্ছানুযায়ী আর্থিক সহায়তা ও ব্যক্তিগত সাহচর্য দেবার কথা বলেন।
অর্থাৎ স্ত্রীদের সাথে নবি কিভাবে আচরণ করবেন তা নির্ধারণে নবির একচ্ছত্র আধিপত্যকে তার স্ত্রীরা স্বীকার করে নিলেন। জামাখশারি সুরা আহজাব-এর ৫১ নম্বর আয়াতের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় বলেছেন, এই আয়াত নবিকে তার ইচ্ছামতো সমাজের যেকোনো নারীকে বিয়ে করার আগ্রহ, প্রস্তাব, স্ত্রীরূপে গ্রহণ কিংবা যে কোনো স্ত্রী বা সকল স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেছে। এছাড়া হাসান বিন আলিকে উদ্ধৃত করে জামাখশারি লিখেছেন, নবি যদি একজন নারীর পাণিগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন, তবে অন্য কারো পক্ষে সেই নারীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণের ক্ষমতা নেই, যদি না নবি তার মত পরিবর্তন করেন। জামাখশারি আরও লিখেছেন, ওই সময়ে নবির নয়জন স্ত্রী ছিলেন যাদের সবাইকে সমান সঙ্গ দেবার কথা থাকলেও তিনি তা ক্রমানুযায়ী করেননি, কিংবা পাঁচজনকে একেবারেই সঙ্গ দেননি। এই পাঁচজন হচ্ছেন সওদা, জুয়ায়রিয়া, সাফিয়া, মায়মুনা এবং উমে হাবিবা। যাদেরকে অনুগ্রহ করে নিয়মিত সঙ্গ দিয়েছেন তাঁরা হলেন আয়েশা, হাফসা, উমে সালমা এবং জয়নাব। আয়েশাকে আবার উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, কোনো কোনো দিন এমন হতো যে, নবি আমাদের সবাইকে একে একে না ভেকে, শুধু তাদেরকেই অনুগ্রহ করতেন যাদের পালা আসতো এবং যাদের সাথে তার ওইদিন থাকার কথা। নবি তালাক দিয়ে দিবেন এই ভেবে উদ্বিগ্ন সওদা বিন জামা নবিকে বলছেন, “আমার জন্য সময় বরাদ দেবার প্রয়োজন নেই! আপনার সাথে আমার দাম্পত্য জীবনের আশা আমি পরিত্যাগ করেছি এবং আমার জন্য বরাদ সময় আয়েশাকে অর্পণ করলাম। কিন্তু আমাকে তালাক দিবেন না। কেননা শেষ-বিচারের দিনে আমি আপনার একজন স্ত্রী হিসেবে গণ্য হতে চাই।’
৫১ নম্বর আয়াতের বক্তব্য হচ্ছে, দাম্পত্য অধিকার হারানোর ফলে নবির স্ত্রীরা তুলনামূলকভাবে বেশি খুশি থাকবেন। যদিও স্বগীয় আদেশের মাধ্যমে নবিকে পূর্ণ দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে, এবং তার স্ত্রীদেরকে নবির কাছ থেকে যেকোনো পাওনা অধিকার আদায়ে বঞ্চিত করেছে, তথাপি এই বঞ্চনার মাধ্যমে তাদের কল্যাণ সাধিত হয়েছে। এর মাধ্যমে তাদের নিজেদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দিতার অবসান হবে এবং তারা ভবিষ্যতে সুখী হবেন।
হয়তো নবির স্ত্রীরা মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছিলেন এবং তাদের আত্মসমানের উপর আঘাত এসেছিল, সেই প্রেক্ষিতে সুরা আহজাব-এর ৫২ নম্বর আয়াতে সান্তনাসূচক বক্তব্য এলো। এই আয়াতের প্রতিটি শব্দে তাদের প্রতি সান্তনা এবং আশ্বাসের বাণী রয়েছে : (মুহামদ!) এরপর তোমার জন্য কোনো নারী বৈধ নয় আর তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রগ্রহণও বৈধ নয়, যদি ওদের সৌন্দর্য তোমাকে মুগ্ধও করে, তবে তোমার ডান হাতের অধিকারভুক্ত দাসীদের ব্যাপারে এ-বিধান প্রয়োজ্য নয়। আল্লাহ সমস্ত কিছুর ওপর কড়া নজর রাখেন।’
এই আয়াতে তথাপি একটি সমস্যা রয়ে গিয়েছে। যেমন বিবি আয়েশার একটি বক্তব্য সকল হাদিস-সংগ্রহকারক নির্ভরযোগ্যহাদিস হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন: “সকল স্ত্রীর অনুমোদন না থাকা অবস্থায় নবি মারা যাননি। অর্থাৎ নবির মৃত্যুর আগে সকল স্ত্রীই তার জন্য অনুমোদিত ছিল। প্রভাবশালী সুন্নি পণ্ডিত ইসমাইল ইবনে কাসির (১৩০০-১৩৭৩ খ্রিস্টাব্দ) তার বিখ্যাত তফসির গ্রন্থে বলেছেন, সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিক এবং হাদিস সংগ্রহকারক ইমাম আহমদ ইবনে হানবলের (৭৮০-৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ) সংগ্রহে বিবি আয়েশার উদ্ধৃত এই হাদিসটি রয়েছে। এছাড়া মুহাম্মদ ইবনে ইসা আত-তিরমিজি (৮২৪-৮৯২ খ্রিস্টাব্দ) এবং ইমাম আহমদ আন-নাসাইর (৮২৯-৯১৫ খ্রিস্টাব্দ) সংগৃহীত হাদিসেও তা রয়েছে। যেমন : ‘সুনান আন-নাসাই’, (ইংরেজি অনুবাদ) ভলিউম৪, বুক-২৬, হাদিস-৩২০৭ – অনুবাদক] আল-জামাখশারির মতে, সুরা আহজাবের ৫২ নম্বর আয়াতটি ৫০ নম্বর আয়াত দ্বারা বাতিল হয়েছিল। অর্থাৎ হে নবি! আমি তোমার জন্য তোমার স্ত্রীদেরকে বৈধ করেছি… বক্তব্য টিকে গেছে আর (মুহাম্মদ) এরপর তোমার জন্য কোনো নারী বৈধ নয়…’ বক্তব্যটি বাতিল হয়ে গিয়েছে। হজরত আয়েশার উদ্ধৃত হাদিসটিও ৫০ নম্বর আয়াতের সত্যতার দিকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু অন্য কিছু না হোক, সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য হলেও কোরানের কোনো একটি আয়াত বাতিল হলে সেটি থাকবে উপরে, যে আয়াত দ্বারা বাতিল হয়েছে তা থাকবে নীচে। কারণ ভবিষ্যতের সম্ভাব্য কোনো কাজকে বর্তমানের কোনো বক্তব্য দিয়ে সংশোধন করা যায় না, বরং অতীতের কাজকে সংশোধন করা যায় বর্তমানের বক্তব্য দিয়ে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা দেখি বাতিলকৃত আয়াতটি (৫২নম্বর আয়াত) রয়ে গিয়েছে নীচে আর যে আয়াতটি বাতিল করেছে (৫০ নম্বর আয়াত) এটা অবস্থান করছে উপরে। কোরানের আয়াতের ধারাবাহিকতা সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এমন গরমিল হলো কিভাবে? [ আল্লাহ কি নিজে এই গরমিল করেছেন, নাকি নবি-পরবর্তী খলিফাদের কোরান সংকলন কমিটি আয়াত বিন্যাস করতে গিয়ে এই গরমিল করেছেন?- অনুবাদক। জালালউদ্দিন আল-সুয়তিও আল-ইতকান ফি উলুম আল-কোরান নামের বইয়ে কোরানের সমস্যাগুলো নিয়ে একটি নিবন্ধে মত প্রকাশ করেছেন, ‘সুরা আহজাবের এই পূর্ববর্তী আয়াত দ্বারা পরবর্তী আয়াত বাতিল হয়েছে।”
সুরা আহজাবের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত নবির বিয়ে সম্পর্কিত অধিকারগুলো যখন একের পর এক যোগ হতে থাকে, তখন এগুলো থেকে বিস্ময়কর সুবিধা-প্রাপ্তির বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অন্যান্য বিশ্বাসীদের জন্য চারজনে সীমাবদ্ধ থাকলেও নবির জন্য এর চেয়েও বেশি স্ত্রী গ্রহণ করা সম্ভব ছিল। নবির জন্য তার সাথে মদিনায় অভিবাসনকারী কাজিনদের বিয়ে করা অনুমোদিত ছিল, কোনো ধরনের যৌতুক প্রদান কিংবা সাক্ষীর উপস্থিতি ব্যতিরেকে নিজেকে তার কাছে সমর্পণকারী কোনো নারীকে নবি বিয়ে করতে পারতেন। স্ত্রীদের সমঅধিকার প্রদানে কিংবা তা রক্ষায় নবির কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না, তিনি যে কোনো স্ত্রীর সহচর্য স্থগিত কিংবা বাতিল করতে পারতেন। তিনি যদি কোনো নারীর পাণিপ্রার্থী হতেন, তবে অন্য পুরুষদের সেই নারীর পাণিপ্রার্থী হওয়ার আশা পরিত্যাগ করতে হতো; এবং নবির মৃত্যুর পরে অন্য কেউ তার কোনো স্ত্রীকে বিয়ে করার অনুমোদন ছিল না। এছাড়াও নবির কোনো স্ত্রীর বাড়তি ভাতা পাওয়ার দাবি জানানোর অনুমতি ছিল না।
নবিকে ব্যাপক সুবিধা এবং স্বাধীনতা দেবার বিপরীতে তার স্ত্রীগণের ওপর নানা বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়েছিল। তারা আর দশজন নারীর মতো থাকতে পারলেন না। তাদেরকে সবসময় লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই পর্দার পিছনে থেকে পুরুষের সাথে কথা বলতে হবে। পৌত্তলিক সংস্কৃতির কোনো গয়না পরিধান তাদের জন্য নিষিদ্ধ হলো। ভাতার পরিমাণ যাই হোক না কেন নবির স্ত্রীদের তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে; তাদের পালা যদি না আসে তবে তারা অভিযোগ করতে পারবে না এবং কোনো অবস্থাতেই তাঁরা পুনরায় বিয়ে করতে পারবে না। ৫৩ নম্বর আয়াতের শেষের দিকে সুনির্দিষ্টভাবে মুসলমান পুরুষদের জন্য আরোপিত হয়েছে: . . . তোমাদের কারও পক্ষে আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দেয়া তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীদেরকে বিবাহ করা সংগত হবে না। আল্লাহর কাছে এ গুরুতর অপরাধ। ইহুদিদের নীতিশাস্ত্র তালমুদেও ইহুদি-রাজার স্ত্রীদের পুনরায় বিয়ের ওপর একই রকম নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
আবদুল্লাহ বিন আল-আব্বাসের” বক্তব্য অনুযায়ী, একবার একজন ব্যক্তি নবির একজন স্ত্রীর সাথে দেখা করতে গেল, এবং নবি তাকে পুনরায় এ কাজ করতে নিষেধ করেন। লোকটি প্রতিবাদ করে এই বলে যে, নবির স্ত্রী তার চাচার মেয়ে এবং তাদের দুজনের এ-সাক্ষাতের পেছনে কোনো খারাপ অভিসন্ধি নেই। নবি প্রত্যুত্তর দিলেন, “আমি এ-সম্পর্কে অবগত আছি, কিন্তু আল্লাহ এবং আমার মতো কোনো ঈৰ্ষাপরায়ণ দ্বিতীয়জন নেই। লোকটি ক্রুদ্ধ হয়ে ফিরে যাবার সময় গজগজ করে বলে গেল, তিনি আমাকে আমার চাচাতো বোনের সাথে কথা বলতে নিষেধ করলেন। যাই হোক, নবির মৃত্যুর পর আমি আমার চাচাতো বোনকে বিয়ে করবো। এ-ঘটনার পরই সুরা আহজাবের ৫৩ নম্বর আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে, এমন কোনো সময় আসেনি যখন নবির গৃহে তার বিশজন স্ত্রী একত্রে অবস্থান করেছেন। তার সমানিত স্ত্রী খাদিজার মৃত্যুর কথা পূবেই বলা হয়েছে। নবির স্ত্রী জয়নাব বিনতে খোজায়মানবির জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। রায়হানা নামের দাসীরও মৃত্যু হয় নবির জীবদ্দশাতেই। তিনি দুটি বিয়েকে পূর্ণতা প্রদান করেননি। তার মৃত্যুকালে নয়জনের বেশি পূর্ণ স্ত্রী ছিলেন না।
নবির স্ত্রীদের মধ্যে একসময় দুটি প্রতিদ্বন্দী পক্ষের আবির্ভাব ঘটেছিল। একপক্ষে ছিলেন আয়েশা, হাফসা, সওদা এবং সাফিয়া। অন্যপক্ষে জয়নাব বিনতে জাহাশ, উম্মে সালমাসহ আরও তিনজন। নবির কয়েকজন স্ত্রী এমন সব ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, যেগুলো পরবর্তীতে ইসলামি ইতিহাস এবং সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছে বিবি আয়েশা ও সাফওয়ান বিন আল-মোয়াত্তালকে কেন্দ্র করে ঘটা ঘটনাটি।
হিজরি ৫ সালে (৬২৭ খ্রিস্টাব্দ) বানু-মোসতালিক গোত্রের সাথে লড়াইয়ের সময় হজরত ওমরের একজন ক্রীতদাস ও মদিনার খাজরাজ গোত্রের একজন আনসারের সাথে ঝগড়া বেধে যায়। এই ঘটনায় খাজরাজ গোত্রের একজন নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবায় (যাকে মুসলমানরা বিশ্বাসঘাতকদের নেতা বলেই চিনতেন) ক্রুদ্ধ হয়ে তার আনসার সমর্থকদেরকে বললেন, “আমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছি। (মদিনার সবকিছু মুহাজিরদের দখলের চলে যাচ্ছে এমন ইঙ্গিত করে) কথায় আছে, কুকুরকে খাওয়ালেও সে ঠিকই কামড়ায়, এই প্রবাদটি এখন আমাদের ক্ষেত্রে সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। চলুন আমরা সবাই ইয়াসরিবে ফিরে যাই। ওখানে বেশিরভাগ মানুষই আমাদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু। এই সংখ্যালঘুদের উৎখাত করতে হবে। নবি এই বক্তব্য শুনে তাড়াতাড়ি মদিনার দিকে যাত্রা করলেন, যাতে আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের যে কোনো বিরুদ্ধবাদী কিংবা চক্রান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন। ফিরতিপথে কয়েকটি সংক্ষিপ্ত বিরতি দিয়ে তিনি দ্রুত চললেন।
এই অভিযানের সময় নবির সাথে ছিলেন বিবি আয়েশা। একটি যাত্রাবিরতিতে বিবি আয়েশা প্রাকৃতিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে মরুভূমির ভেতরে প্রবেশ করলেন। পালকির মধ্যে আসার সময় খেয়াল করলেন, তার পুতির মালাটি হারিয়ে গেছে। খোঁজাখুঁজি করতে দেরি হয়ে যায়। এদিকে বিবি আয়েশার অনুপস্থিতি খেয়াল না থাকায় নবি তার অনুসারীদের নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন। আয়েশা এসে দেখলেন তার হাওদা (হাতি কিংবা উটের পিঠের উপরে বসানো কাপড় ঘেরা বসার স্থান) বহনকারী উটটি অন্যান্য উটের সাথে সেই স্থান ত্যাগ করেছে। বিবি আয়েশা মরুভূমিতে একা পড়ে রইলেন। এরই মধ্যে সাফওয়ান বিন আল-মোয়াত্তাল আয়েশাকে দেখতে পেলেন। সাফওয়ানের দায়িত্ব ছিল মুসলমান সৈনিকদের একটু দূরে থেকে অনুসরণ করা, ভুল করে ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র সংগ্রহ করা। মরুভূমির মধ্যে আয়েশাকে একা অবস্থান করতে দেখে চিনতে পারলেন। নিজের উটের পেছনের আসনে বসিয়ে তাকে মদিনায় নিয়ে আসেন। এই ঘটনার কথা গোপন থাকল না।
বিবি আয়েশার প্রতিদ্বন্দী জয়নাবের বোন হামনা এ-ঘটনা শুনে সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলেন এবং অভিযোগ করলেন আয়েশা ও সাফওয়ান ব্যভিচারে লিপ্ত। বিখ্যাত কবি হাসান বিন সাবিত ও মেসতা বিন ওসাসা নামের একজন মুহাজির হামনার সাথে কণ্ঠ মেলালেন। অন্যদিকে সুযোগ-সন্ধানী আব্দুল্লাহ বিন উবায় মদিনা শহরে গুজব ছড়িয়ে দিলেন। পরিস্থিতি মোটেও আয়েশার অনুকূলে ছিল না। অভিযানে নবির সঙ্গী হবার পর এই অল্পবয়স্কা ও সুন্দরী নারী নিজেকে আরও দুজন নতুন এবং একই রকম সুন্দরী রমণীর প্রতিপক্ষ হিসেবে আবিষ্কার করলেন। প্রথমজন হলেন জয়নাব বিনতে জাহাশ, যাকে বিয়ে করার জন্য কোরানের আয়াত নাজিল হয়ে নবিকে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়জন হলেন জোয়ায়রিয়া বিন আল-হারিস, যিনি মোসতালিক গোত্রের মুসাফি নামের একজনের প্রাক্তন স্ত্রী। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, জোয়ায়রিয়াকে অভিযানের পর বন্দী করা হয় এবং নবি তাকে তার মালিকের কাছ থেকে চারশ দিরহাম মুক্তিপণের বিনিময়ে কিনে নেবার কিছুদিন পরে বিয়ে করেন।
এটা অসম্ভব নয়, প্রতিপক্ষের আবির্ভাবে আয়েশার নারীত্ব এমনই আঘাত পেয়েছিল ও রুষ্ট হয়েছিল যে নবিকে সতর্ক করে তিনি জেনে-শুনে পাপ করেছিলেন কিংবা একটি অভিসারের অবতারণা ঘটিয়েছিলেন। যখন আয়েশার হাওদা উটের উপর তোলা হলো, কেউ লক্ষ্য করল না তা বেশি হালকা, এমনটা ভাবা কষ্টকর। মনে আরও প্রশ্ন জেগে উঠে। বিশ্রাম থেকে যাত্রা শুরুর পূর্বে নবি কেন তার প্রিয়তমা স্ত্রীর হাল-হকিকত জিজ্ঞেস করলেন না। আয়েশা কিভাবে এমন বেখেয়াল হয়ে পড়লেন যে, শতশত মুসলমানদের যাত্রা-প্রস্তুতি তার নজরে পড়ল না? তিনি সময়মত ফিরতে পারলেন না। সাফওয়ান তাকে খুঁজে পাবার আগ পর্যন্ত আয়েশা কিভাবে একা মরুভূমিতে পড়ে রইলেন? যদিও সাফওয়ানের কাজ ছিল অভিযান চলাকালীন সময়ে কিছু দূরত্ব বজায় রেখে একে অনুসরণ করা। যাত্রী ও পশুদের জন্য পরবর্তী যাত্রা বিরতির সময় তার কি অভিযানের যাত্রাবিরতির স্থানে পৌছে যাওয়া উচিত ছিল না? সাফওয়ানের আকস্মিক উদয় হওয়া এবং অভিযান চলে যাবার বেশ কিছু সময় পর আয়েশার উদ্ধার হবার ঘটনাটি তথ্য-প্রমাণ এবং যুক্তির বিচারে ধোপে টিকানো কষ্টকর। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সাফওয়ানের সাথে যোগসাজশ করেই বিবি আয়েশা পেছনে থেকে গিয়েছিলেন।
সকালে যখন সাফওয়ান আয়েশাকে উটের পিছনের আসনে বসিয়ে শহরে প্রবেশ করলেন, শহরে তখন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যতই তা ছড়িয়ে পড়ল ততই কুৎসিত আকার ধারণ করল। যেহেতুমদিনা শহরটি অনেক ছোট ছিল, ছোট ছোট বিষয়গুলোও কারো কাছে গোপন থাকে না। প্রশ্ন জাগে, এই ভয়ংকর গুজবের পর কিভাবে বিশ দিন সময় লাগল আয়েশার কাছে পৌছাতে? এবং তা শোনামাত্রই কেন আয়েশা অসুস্থ হয়ে পড়লেন? তিনি অবশ্য অসুস্থতার ভানও করে থাকতে পারেন। অসুস্থতার কারণে আয়েশাকে তার পিতার গৃহে ফিরে যাবার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধিতে ধারণা করা যায়, তিনি শুরু থেকে এই গুজব সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং তখনই অসুস্থতার ভান করে পিতার গৃহে ফিরে গেলেন যখন নবির কানে গুজবটি পৌছে গিয়েছিল। নবি যখন আয়েশার প্রতি শীতল আচরণ করতে লাগলেন এবং দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করলেন। এতো সব বাহ্যিক উপস্থাপন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়লেও আয়েশার নির্দোষ হওয়াকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সম্পূর্ণ ঘটনাকে একটি ছেলেমানুষী ও নারীদের চাতুর্যপূর্ণ নাটক হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। সম্ভাবনা আরও জোরালো হয় যখন জানা যায় সাফওয়ান বহু আগে থেকে একজন কুখ্যাত নারীবিদ্বেষী লোক ছিলেন।
ঘটনা যাই হোক না কেন, লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া এই গুজব নবিকে চরমভাবে বিচলিত করেছিল। তিনি বিশ্বস্ত দুজন সহচর ওসামা বিন জায়েদ ও আলি বিন আবু তালিবের পরামর্শ গ্রহণ করেন। ওসামা দৃঢ়ভাবে মত প্রকাশ করেন, আয়েশা নির্দোষ এবং হজরত আবু বকরের মেয়ে হিসেবে তিনি কোনো অনৈতিক কাজে প্রলুব্ধ হতে পারেন না। অন্যদিকে আলির মত ছিল, নবির বিয়ে করার জন্য মেয়ের অভাব নেই, এবং ওই অভিসার-সম্পর্কিত আসল সত্য ঘটনা সম্ভবত আয়েশার দাসীর কাছ থেকে জানা যাবে। এরপরেই আলি ওই হতভাগ্য দাসীকে বেদম প্রহার করে সত্য উদ্ধারের চেষ্টা করলেন কিন্তু ওই দাসী কিছুই জানতেন না এবং কসম খেয়ে বললেন যে, বিবি আয়েশা নির্দোষ।
নবির মনে তবুও সন্দেহ দানা বেঁধে ছিল। যে কারণে নিজেই আবু বকরের গৃহে আয়েশাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলেন। কিন্তু তিনি কেবল কান্নাভেজা কণ্ঠে আয়েশার নিদোর্য হবার দাবি শুনতে পেলেন। তিনি যখন সেখানে অবস্থান করছিলেন, হঠাৎই একটি স্বগীয় প্রত্যাদেশ নবির কাছে অবতীর্ণ হওয়ায় নবি মূৰ্ছা গেলেন। সবাই তাকে কাপড়ে মুড়ে, মাথার নিচে একটি বালিশ রেখে দিল। তিনি এতটাই ঘৰ্মাক্ত হয়ে গেলেন যে তার আলখাল্লা পুরোটা ঘামে ভিজে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন তখনই ২৪ নম্বর সুরা নুর অবতীর্ণ হলো। এই সূরাটি একটি দীর্ঘ অংশে (২-২৬ নম্বর আয়াত) ব্যভিচার এবং ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগ করার শাস্তি এবং ওই মিথ্যা অভিসারের কাহিনী নিয়ে বক্তব্য রয়েছে। এই আয়াতের মাধ্যমে আয়েশাকে ব্যভিচারের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
আল-জামাখশারির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী কোরানে এর থেকে অন্য কোনো বিষয়ে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ২৩ নম্বর আয়াত এর সর্বোত্তম উদাহরণ: “যারা সাধবী, নিরীহ ও বিশ্বাসী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে তারা ইহলোক ও পরলোকে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। ( ২৪:২৩)। মিথ্যা অভিসারের কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে তিনজন কুৎসারটনাকারীকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে। তারা হলেন হামনা, হাসান বিন সাবিত এবং মেসতা। সুরা নুর-এর ৪ নম্বর আয়াত অনুযায়ী তাদের প্রত্যেককে আশিবার বেত্ৰাঘাত করা হয়। পূর্ববর্তী ঘটনার প্রেক্ষিতে এই শাস্তি প্রদান করা হয়, কেননা তারা যখন অপরাধ করেন, তখনও এই আয়াত অবতীর্ণ হয়নি।
নবির জীবনী-গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত আরও একটি ঘটনা যা কোরানের আয়াতগুলোতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে তা হলো নবির পালক-পুত্র জায়েদ বিন হারিসের স্ত্রী জয়নাব বিনতে জাহাশের প্রতি নবির প্রীতি ও তার সাথে নবির বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। জায়েদ একজন যুদ্ধবন্দী, পরে ক্রীতদাস হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। বিবি খাদিজা তাকে ক্রয় করে মুহাম্মদকে উপহার দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে নবি তাকে মুক্ত করে দিলেন এবং সমসাময়িক একটি প্রথা অনুযায়ী পালক-পুত্ররূপে গ্রহণ করলেন। প্রাক-ইসলামি যুগের আরব সংস্কৃতিতে পালক সন্তানদের রক্তের সন্তানের সমান অধিকার দেওয়া হতো এবং তাদের ওপর একই বিধিনিষেধ আরোপিত হতো। যেমন উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এবং আত্মীয়তা ও বিয়ের ক্ষেত্রে পছন্দের ভিন্নতায়। সুরা আহজাব-এর আয়াত ৪৬ এ নিষেধাজ্ঞা আসার পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানরা আরবের প্রাচীন প্রথা পালন করতেন। এই বিষয়ে আব্দুল্লাহ বিন ওমর একবার বলেছিলেন, “আমরা যারা নবির সান্নিধ্যে ছিলাম তারা জায়েদকে জায়েদ বিন মুহাম্মদ নামে সম্বোধন করতাম। তিনি শুধু নবির পুত্রই ছিলেন না, নবির জন্য অন্যতম নিবেদিত- প্রাণ এবং দৃঢ়বিশ্বাসী সাহাবিও ছিলেন।
জয়নাবের মায়ের নাম ছিল ওমায়মা, তিনি আবার আব্দুল মোতালেবের কন্যা। অর্থাৎ সম্পর্কে জয়নাব মুহাম্মদের ফুফাতো বোন। নবি নিজেই অনুরোধ করেছিলেন, জয়নাবকে যেন জায়েদের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। প্রথমদিকে জয়নাব এবং তার ভাই আব্দুল্লাহ বিয়ের সম্মতি দানে আপত্তি করছিলেন। কারণ জায়েদ ছিলেন একজন মুক্ত ক্রীতদাস। ফলে জায়েদের সাথে তাদের সামাজিক মানমর্যাদার অসাম্য নিয়ে চিন্তিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সুরা আহজাব-এর ৩৬ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হবার পর তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন: আল্লাহ ও তার রসুল কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো বিশ্বাসী পুরুষ বা নারীর সে-বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তার রসুলকে অমান্য করলে সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।’ (৩৩৩৬)। এই প্রত্যাদেশের পর জয়নাবের সাথে জায়েদের বিয়ে দেয়া হয়। জয়নাবের প্রতি নবির ভালবাসাবোধ তৈরি হয় আরও পরে। যার সময়কাল এবং পরিস্থিতির বহু বর্ণনা রয়েছে। তফসির আল-জালালাইনের বর্ণনা অনুযায়ী, জায়েদের সাথে বিয়ের পরে জয়নাবের প্রতি নবির দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে: কিছু সময় পর জয়নাবের প্রতি নবির দৃষ্টি পড়ে এবং নবির হৃদয়ে তার প্রতি ভালবাসার বীজ অঙ্কুরিত হয়। ’
সুরা আহজাব-এর ৩৭ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জামাখশারি বলেছেন, জায়েদের সাথে বিয়ের পরই জয়নাবের প্রতি নবির দৃষ্টি পড়ে। জয়নাব নবিকে এতটা বিমোহিত করেছিলেন যে, নবি তার ভালোবাসাবোধ নিয়ে মন্তব্য করেছেন- হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টির জন্য আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। নবি জয়নাবকে আগেও দেখেছেন। কিন্তু তখন তিনি নবিকে প্রীত করতে পারেননি, বা নবির মধ্যে ভালোবাসাবোধ জাগেনি। না-হলে নবি হয়তো নিজেই তার পাণিপ্রার্থী হতেন। নবির প্রশংসার কথা জেনে জয়নাব জায়েদকে তা অবহিত করেন। জায়েদের মন বলছিল, আল্লাহ তার হৃদয়ে জয়নাবের অবস্থানে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাই তাড়াতাড়ি নবির কাছে ছুটে গিয়ে নিজ স্ত্রীকে তালাক দেবার অনুমতি চাইলেন। নবি পুরো ঘটনা জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জায়েদ জয়নাবকে সন্দেহ করেন কিনা? প্রত্যুত্তরে জায়েদ বললেন, জয়নাবের কাছ থেকে তিনি দয়ালু আচরণই পেয়েছেন, কিন্তু তিনি উদ্বিগ্ন এই কারণে যে, জয়নাব নিজেকে তার থেকে অভিজাত মনে করেন এবং নিজেকে নবির স্ত্রী হবার যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করেন। এ-সময় ৩৭ নম্বর আয়াতের সেই শব্দগুলো প্রত্যাদেশ হিসেবে আসলো: ‘তুমি তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছে রাখো, আল্লাহকে ভয় করো। এই তাৎপর্যপূর্ণ আয়াতটি নবি মুহাম্মদের সততা এবং জবাবদিহিতার একটি অনন্যসাধারণ উদাহরণ। আয়াতটির সম্পূর্ণ অনুবাদ এখানে দেয়া হল: সারণ করো, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন ও তুমিও যাকে অনুগ্রহ করেছ তুমি তাকে বলেছিলে, “তুমি তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছে রাখো, আল্লাহকে ভয় করো। তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করেছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন। তুমি লোকভয় করছিলে, অথচ আল্লাহকেই ভয় করা তোমার পক্ষে অধিকতর সংগত ছিল। তারপর জায়েদ যখন (জয়নাবের সাথে) বিবাহ-সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করলাম যাতে বিশ্বাসীদের পোষ্যপুত্ররা নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহসূত্র ছিন্ন করলে সেসব রমণীকে বিয়ে করতে বিশ্বাসীদের কোনো বাধা না হয়। আল্লাহর আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে। (৩৩:৩৭)।
এই আয়াতটি যথেষ্ট পরিষ্কার এবং বিশদ ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নেই। নবি জয়নাবকে পছন্দ করতেন, কিন্তু জায়েদ যখন নবির সাথে দেখা করে জয়নাবকে তালাক প্রদানের অনুমতি প্রার্থনা করলেন, নবি বিরুদ্ধ-মত দিয়ে জয়নাবের সাথে সংসার চালিয়ে যাবার পরামর্শ দিলেন। জায়েদকে উপদেশ দিয়ে নবি নিজের মনের ইচ্ছা আড়াল করলেন। কিন্তু আল্লাহ নবিকে বললেন যে, লোকে তাকে মন্দ বলবে এই ভয়ে জয়নাবের তালাকের জন্য নিজের সমর্থন প্রকাশে নবি বিরত রয়েছেন। নবির উপদেশ উপেক্ষা করে জায়েদ যখন জয়নাবকে তালাক প্রদান সম্পন্ন করলেন, তাকে বিয়ে করতে আল্লাহ তখন নবিকে অনুমতি দিলেন যেন মুসলমানরা কখনো তাদের পালক-পুত্রের সাবেক স্ত্রীদের বিয়ে করতে কোনো বিধি-নিষেধের সম্মুখীন না হয়।
সম্ভবত জায়েদের সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানে জয়নাবের প্রতি নবির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। জয়নাবের আলাদা বসবাস করার কারণে জায়েদ নবির সাথে দেখা করে তালাকের অনুমতি চাওয়ার ঘটনা থেকে বোঝা যায়, খুব বেশি দিন স্থায়ী না হলেও তারা দুইজন একটি স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্কে ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে আল-জামাখশারির বর্ণিত ঘটনাবলী ক্রমানুসারে সাজানো যেতে পারে: বিয়ের অনুষ্ঠানে জয়নাবকে একনজর দেখার পর মুহাম্মদ তার সুখানুভূতি প্রকাশ করেন এই বলে, “হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টির জন্য আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। নবির এ-কথা শুনতে পেয়ে এবং সম্ভবত তার প্রতি নবির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দেখে জয়নাব নবির প্রকৃত অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলেন। এই অনুভূতি জয়নাবকে প্রেরণা যোগায় এমন একটি লক্ষ্য অর্জনে, যেখানে তিনি কুরাইশ গোত্রের সবচেয়ে সম্রান্ত ব্যক্তির স্ত্রীর মর্যাদা পাবেন। এই আশার বশবর্তী হয়ে এবং যেহেতু জয়নাব কখনো জায়েদকে স্বামী হিসেবে কামনা করেননি, তাই তিনি জায়েদের সাথে শীতল আচরণ করতে শুরু করেন। নিজ লক্ষ্য অর্জনে এতোটা অগ্রসর হলেন যে, নিজের সন্ত্রান্ত পরিচয় নিয়ে দম্ভ প্রকাশ করতে শুরু করলেন। তার প্রতি নবির অনুভূতি নিয়ে গর্ববোধ করা শুরু করলেন। জায়েদ তার নেতা এবং মুক্তিদাতার প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে তৎক্ষণাৎ জয়নাবকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্তনিলেন এবং নবির উপদেশ উপেক্ষা করে তালাকের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেন।
ক্যামব্রিজ তফসিরে’ এক ভিন্নবিবরণ রয়েছে: একদিন আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ (আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক তার ওপর) জয়নাবের বাড়িতে জায়েদের সাথে দেখা করতে গেলেন, সেখানে জয়নাবকে একটি চৌবাচ্চায় সুগন্ধি ঢালতে দেখেন। নবি তাকে দেখে প্রীত হলেন এবং জয়নাবকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করার বাসনা জেগে ওঠে। নবিকে দেখে জয়নাব তাকে নিজ হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন। নবি তখন বললেন, ‘প্রশংসনীয় সৌষ্ঠব এবং সৌন্দৰ্যদায়িনী! হায় জয়নাব হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টির জন্য আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা!’ এ-কথাটি দুইবার বলে নবি চলে গেলেন। জায়েদ ফেরার পর জয়নাব তাকে ঘটনা খুলে বললেন এবং জানালেন, আপনি আর আমাকে পাবার অধিকার রাখেন না। যান এবং তালাকের অনুমতি চেয়ে আসুন। জায়েদের মনে জয়নাবের প্রতি বিদ্বেষ জেগে ওঠে। তিনি আর জয়নাবকে দৃষ্টিসীমার মাঝে সহ্য করতে পারছিলেন না। তালাক সম্পন্ন হবার পর, নবি জায়েদকে অনুরোধ করেন, জায়েদ যেন জয়নাবের সাথে দেখা করে বলেন, আল্লাহ তাকে নবির স্ত্রী হিসেবে মনোনীত এখন কি প্রয়োজন থাকতে পারে? জায়েদ উত্তর দিলেন, তিনি আল্লাহর রসুলের কাছ থেকে জয়নাবের জন্য একটি বার্তা নিয়ে এসেছেন। সকল প্রশংসা আল্লাহর রসুলের জন্য বলে জয়নাব দরজা খুলে দিলেন। জায়েদ ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র জয়নাব কাঁদতে শুরু করলেন। জায়েদ বললেন, ‘এখন কাঁদার সময় নয়। আল্লাহ তোমাকে আমার চেয়েও ভালো একজন স্বামী দিয়েছেন। জয়নাব উত্তর দিলেন, আপনি কিছু মনে নিবেন না! কে সেই স্বামী? জায়েদ যখন জানালেন, আল্লাহর রসুলই সেই ব্যক্তি, জয়নাব তখন মাটিতে মাথা ঠুকে প্রার্থনায় নিমগ্ন হলেন।
অন্য আরেকটি বর্ণনা অনুযায়ী জায়েদ বলেছেন: ‘আমি জয়নাবের গৃহে গিয়ে তাকে রুটি সেঁকতে দেখি। যেহেতু সে শীঘ্রই নবির স্ত্রী হতে যাচ্ছে, নবির প্রতি আমার শ্রদ্ধার কারণে আমি তার দিকে সরাসরি তাকালাম না। আমি তার দিকে পিছু ফিরে জানালাম, নবি জয়নাবের পাণিপ্রার্থী হতে চেয়েছেন।”
তফসির আল-জালালাইনের মতে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর পুনরায় বিবাহের জন্য মধ্যবর্তী যে কয়েকটি দিন অপেক্ষা করতে হয়, নবি সেদিনগুলো অপেক্ষা করেন এবং তা শেষ হওয়ার সাথে সাথে নবি কোনো প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান ব্যতিরেকে জয়নাবের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে একটি ভেড়া জবাই করে বিবাহ-ভোজের আয়োজন করা হয়। ভোজের অনুষ্ঠান এবং মানুষের মাঝে রুটি ও মাংস বিতরণের কর্মযজ্ঞ অনেক রাত অবধি চলেছিল। প্রচলিত আছে যে, হজরত ওমর এবং বিবি আয়েশা উভয়েই মন্তব্য করেছেন, সুরা আহজাব-এর ৩৭ নম্বর আয়াতে নবির সততা ও সত্যবাদিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। আয়েশা আরও বলেছিলেন, নবি যদি কোনো কিছু লুকিয়ে রাখার ইচ্ছা করতেন, তবে জয়নাবের প্রতি তার মনের ভাবনা কখনো কোরানে উল্লেখ হতো না। যেমন এই আয়াতে বলা হয়েছে, “তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করেছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন এ শব্দগুলো কখনো অবতীর্ণ হতো না।
শুধুমাত্র কোরানের সুরা আহজাব-ই নয়, কোরানের আরও অনেক সুরা থেকে নবির সততা এবং সত্যবাদিতার পরিচয় পাওয়া যায়। নবি তার মানবিক দুর্বলতা স্বীকারে কুষ্ঠাবোধ করেননি। যদিও মুসলমান রক্ষণশীলরা দীর্ঘদিন ধরে এই সত্যকে স্বীকার করতে চান না, যারা কিনা রাজার থেকেও বেশি রাজকীয় আচরণে প্রলুব্ধ এবং অলৌকিকতার প্রতি চরম আসক্ত। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে এ সম্পর্কে সামান্য পরিমাণে আলোকপাত করা হয়েছে। হাদিসের অনেকগুলো স্পষ্ট প্রমাণ ও সুরা আহজাব-এর ৩৭ নম্বর আয়াতের পরিষ্কার অর্থকে অগ্রাহ্য করে ইসলামি পণ্ডিত আল-তাবারি” মন্তব্য করেছেন, তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করেছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেনবাক্যটি নবি মুহামদকে উদ্দেশ্য করে অবতীর্ণ হয়নি। এটা জায়েদকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। জায়েদের মনের মাঝে কোনো কিছু গোপন ছিল!আল-তাবারি এই ভিত্তিহীন ব্যাখ্যাকে গ্রহণযোগ্য করতে গিয়ে অভিযোগ করলেন ; জায়েদের একটি মারাত্মক ব্যাধি ছিল, যার খবর তিনি গোপন করেছিলেন। এই ব্যাধির কারণে তিনি জয়নাবকে তালাক দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সমাজের কাছ থেকে তার রোগের খবর গোপন রাখা জায়েদের উদ্দেশ্য ছিল। ৭৬
ফুফাতো বোন। নবি তাঁকে পূর্বেও দেখেছেন এবং বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। তিনি তাই জয়নাবকে তালাক না দেবার জন্য জায়েদকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু জায়েদ তার পথপ্রদর্শকের উপদেশ অমান্য করে ঠিকই নিজের স্ত্রীকে তালাক দিলেন। পরবর্তীতে পৌত্তলিক-আরবের প্রথা ভঙ্গের জন্য নবি জয়নাবকে বিয়ে করলেন বিশ্বাসীদেরকে দেখানোর জন্য যে, দত্তক গ্রহণের পর দত্তক পুত্রের সাবেক স্ত্রীকে বিয়ের অনুমোদন রয়েছে। জয়নাবকে বিয়ে করার পেছনে এটি একমাত্র কারণ এবং সম্ভবত এ-কারণেই তিনি বিচ্ছেদ-পরবর্তী বিরতি সমাপ্ত হবার পর তাড়াতাড়ি জয়নাবের গৃহে যান এবং বিয়ের উৎসব সম্পন্ন করেন। হায়কলের মতে, নবির বেশিরভাগ বিয়ের পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে কিংবা বিয়েগুলোর মাধ্যমে তার ধর্ম প্রচারে সুবিধা হয়েছে। নিজের এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে তিনি নবির সাথে হজরত ওমর বিন আল-খাত্তাবের মেয়ে হাফসার বিয়ের ঘটনার একটি উদাহরণ টেনেছেন : ‘একদিন ওমর তার স্ত্রীর সাথে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ওমরের স্ত্রী রাগান্বিত ও ঝাঁঝালো ভাষায় তর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ওমর রেগে গিয়ে বললেন, নারীরা জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে পুরুষের সাথে আলোচনার উপযুক্ত নয়। তাদের মতামত প্রকাশ করারও কোনো প্রয়োজন নেই। তার স্ত্রী প্রত্যুত্তরে বললেন, আপনার কন্যা আল্লাহর রসুলের সাথে এতো বেশি ঝগড়া করে যে, তা-নিয়ে নবি সারাদিনই রেগে থাকেন। স্ত্রীর মুখে এই কথা শুনে ওমর সরাসরি হাফসার বাড়িতে গেলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করার জন্য। তিনি হাফসাকে আল্লাহর শাস্তি ও নবির রাগ থেকে সতর্ক হবার কথা বললেন। তিনি আরও বললেন, ‘এই অল্পবয়স্কা মেয়েটিকে (আয়েশা) নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ো না, যে কিনা নিজের সৌন্দর্য এবং তার প্রতি নবির ভালবাসার কারণে দাম্ভিক আচরণ করে! নবি তোমাকে আমার কারণে বিয়ে করেছেন, তোমাকে ভালবাসেন বলে নয়।’
এটা ঠিক যে নবির অনেকগুলো বিয়ের মধ্যে কয়েকটি সম্পন্ন হয়েছিল আতীয়তার সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ইসলাম-প্রচারের জন্য। হায়কলের মতে, এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আলি এবং উসমানকে নবি জামাতা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। খালেদ বিন আল-ওয়ালিদ ইসলাম গ্রহণ করে হিজরি ৭ সালে (৬২৯ খ্রিস্টাব্দে) মক্কায় হিজরত করতে যান। কারণ সে-সময় নবি সর্বশেষ স্ত্রী মায়মুনাকে বিয়ে করেছিলেন। মায়মুনা খালেদের খালা ছিলেন এবং নবির দুই চাচা আব্বাস ও হামজার স্ত্রীদের একজনের বোন ছিলেন।
বিবাহ সম্পর্কিত আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়, যা ওই সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং কোরানেও এ-সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত, নবি মারিয়া নামের ক্রীতদাসীর সাথে শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন। হাফসা তখন আকস্মিকভাবে সেখানে উপস্থিত হোন। নবির দিকে অসমানসূচক ভাষায় চিৎকার করে বলেন, আপনি কেন আপনার দাসীকে নিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে আছেন? হাফসাকে সন্তুষ্ট করতে নবি আর কখনো মারিয়াকে স্পর্শ না করার প্রতিজ্ঞা করলেন। ঝড় শান্ত হয় গেলে নবি মত পরিবর্তন করলেন। হয়তো তিনি মারিয়াকে পছন্দ করতেন কিংবা মারিয়া এ-ঘটনায় মনে আঘাত পেয়েছেন এই ভেবে। সুরা তাহরিম-এর প্রথম পাঁচটি আয়াতে নবির তখনকার আচরণ সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে ; হে নবি আল্লাহ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন কেন তুমি তা নিষিদ্ধ করছ তোমার স্ত্রীদেরকে খুশি করার জন্য? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আল্লাহ তোমাদের শপথ থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, আল্লাহ তোমাদের সহায়। আর তিনি সর্বজ্ঞ, তত্ত্বজ্ঞানী। (৬৬:১২)। সুরা মায়িদা-এর ৮৯ নম্বর আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী, ভুলবশত বা নিরর্থক শপথ বাতিলের জন্য দশজন গরীবকে মাঝারি ধরনের খাবার দিয়ে, বা কাপড় দিয়ে সহায়তা কিংবা একজন দাসকে অবমুক্ত করা অথবা তিনদিন রোজা থাকার কথা কোরানে বলা হয়েছে। মোকাত্তেল বিন সুলেমানের” একটি হাদিস ভাষ্যে রয়েছে, নবি মারিয়াকে স্পর্শ না করার যে শপথ করেছিলেন,
সুরা মায়িদার নির্দেশ অনুযায়ী একজন দাসকে অবমুক্তকরণের মাধ্যমে সেই শপথ বাতিল করেন; এবং হাসান বিন আলির একটি হাদিস অনুযায়ী সুরা ফাতিহার ২ নম্বর আয়াতের যিনি পরম করুণাময়, পরম দয়াময়’ শব্দগুলো থেকে বোঝা যায় আল্লাহ নবিকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
‘(সরণ করো) নবি তার স্ত্রীদের একজনকে গোপনে কিছু বলেছিল। তারপর সেই স্ত্রী তা অন্যকে বলে দেয়, আল্লাহ নবিকে তা জানিয়ে দেন। এ-বিষয়ে নবি সেই স্ত্রীকে কিছু বললও না। নবি যখন তাকে বলল, সে জিজ্ঞেস করল, ‘কে আপনাকে একথা জানাল?’ নবি বলল, “আমাকে জানিয়েছেন তিনি, যিনি সর্বজ্ঞ, যাঁর সব জানা। (৬৬:৩)। এই আয়াত নিয়ে আলোকপাত করা দরকার: নবি হাফসাকে অনুরোধ করেছিলেন, এ- ঘটনা যেন অন্য কেউ জানতে না পারে এবং মারিয়াকে আর তিনি স্পর্শ করবেন না বলে শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাটি বিবি হাফসা বিবি আয়েশাকে বলে ফেলেন। নবি যখন হাফসার সাথে কথা বলেন এবং এও জানান, হাফসার বক্তব্য ফাঁসের কথা ইতিমধ্যে আল্লাহ তাকে জানিয়েছেন। যদিও নবি কতটুকু জানেন তা পরিষ্কার করেননি। হাফসা ভেবে নিলেন, আয়েশা হয়তো নবিকে এ-বিষয়ে অবহিত করেছেন। তিনি যখন জিজ্ঞেস করলেন নবি কিভাবে জানেন, নবি প্রত্যুত্তরে বললেন যে, আল্লাহ তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করেছেন। কোরানের প্রতিটি পাঠকই এ-বিষয়ে একমত হবেন যে, মানব-জাতির জন্য সর্বকালের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে এ-ধরনের ব্যক্তিগত বিষয়াবলীর অন্তর্ভুক্তি অবশ্যই আমাদেরকে আশ্চর্যজনক ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেয়। কোরানের তফসিরকারকদের দেয়া ব্যাখ্যাগুলোও বিস্ময়কর। যেমন ক্যামব্রিজ তফসির-এ বর্ণিত একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে: হাফসা যখন আয়েশাকে নবির এই ঘটনা জানালেন এবং আল্লাহ যখন নবিকে হাফসা কর্তৃক এই তথ্য ফাঁসের খবর সম্পর্কে অবহিত করলেন, নবি এর প্রমাণ দেয়ার জন্য হাফসা আয়েশাকে যা বলেছেন তার কিয়দংশ হাফসাকে অবহিত করলেন।”
এ-ধরনের ব্যক্তিগত সাংসারিক বিষয়াবলী, মেয়েলি-কথাবার্তা যা পৃথিবীর যেকোনো সময় যেকোনো প্রান্তে ঘটে থাকতে পারে, তা কিভাবে কোরানের আলোচ্য-সূচিতে জায়গা পেতে পারে? এর মাধ্যমে আল্লাহকে, সমগ্র বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তাকে ছোট করা হয়নি? আল্লাহকে হাফসার সাথে আয়েশার কথাবার্তার একজন তথ্য-ফাঁসকারী পর্যায়ে নামিয়ে আনেননি? যেকোনো পরিস্থিতিতে, সুরা তাহরিম-এর প্রথম তিনটি আয়াত স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য-কলহের একটি সাধারণ পরিস্থিতি মাত্র।
পরবর্তী দুটি আয়াতের (৪-৫ নম্বর আয়াত) মাধ্যমে হাফসা এবং আয়েশাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তারা দুজন যদি প্রতিবাদ করতে থাকেন এবং স্ত্রী- স্বরূপ ঈর্ষা প্রকাশ করতে থাকেন তবে তারা নবির বিরাগভাজন হবেন। এজন্য শেষ হাতিয়ার স্বরূপ নবি তাদেরকে তালাক দিতে পারবেন। তোমাদের হৃদয় যা কামনা করেছিল তার জন্য তোমরা দুজন অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে যাও। তোমরা যদি তার (নবির) বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে (জেনে রাখো) আল্লাহ তার অভিভাবক; জিবরাইল ও সৎকর্মপরায়ণ বিশ্বাসীরা, আর তার ওপর ফেরেশতারাও, তাকে সাহায্য করবে। (৬৬:৪)। নবি যদি তোমাদের সকলকে তালাক দেয়, তবে তার প্রতিপালক তোমাদের পরিবর্তে হয়তো তোমাদের চেয়ে আরও ভালো স্ত্রী তাকে দেবেন; যারা মুসলমান, বিশ্বাসী, তওবা করে, এবাদত করে, রোজা রাখে, অকুমারী ও কুমারী।’(৬৬৫)। যদিও এই আয়াতগুলোর অর্থ এবং অবতারণার পরিস্থিতি উভয়েই পরিষ্কার, তথাপি কোনো কোনো তফসিরকারক এই আয়াতগুলোকে এমন উদ্ভট উপায়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন, তা অবিশ্বাস্য! পাঠক হিসেবে তা আমাদের মধ্যে শুধু মৃদু হাস্যরসের সৃষ্টি করে। ক্যামব্রিজ তফসির অনুযায়ী এই আয়াতে ব্যবহৃত ইহায়ইবল (বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্তরা) বলতে মিশরের ফারাও রাজার স্ত্রী আসিয়াকে বোঝানো হয়েছে। কুমারী (আবকার) শব্দ দ্বারা যিশু খ্রিস্টের মাতা মেরিকে বোঝানো হয়েছে। তাদের দুজনই নবি মুহামদকে বিয়ে করার জন্য স্বর্গে অপেক্ষা করে আছেন।
সুরা তাহরিম-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সম্পূর্ণ আরেকটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট জানা যায়। এই ভাষ্য-অনুযায়ী, নবি জয়নাবের বাড়িতে কিছু মধু পান করেছিলেন এবং এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে আয়েশা এবং হাফসা নবিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার মুখ দিয়ে বাজে গন্ধ আসছে যে। প্রশ্নের আকসিকতায় বিব্রত নবি তখন প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি আর কখনো মধু খাবেন না। পরবর্তীতে (সম্ভবত নিজের প্রতিজ্ঞায় অনুশোচনাবোধ থেকে) এই প্রতিজ্ঞাকে অস্বীকার করে সুরা তাহরিম-এর ১নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হয়। তখন থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদানপূর্বক প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের নিয়ম চালু হয় এবং নবির স্ত্রীদের সতর্ক করা হয় এই বলে যে, তাদেরকে নবি তালাক দিতে বাধ্য হবেন যদি না তারা নিজের মধ্যকার ঈর্ষা এবং প্রতিদ্বন্দিতা বন্ধ করেন। এই ভাষ্যটি স্বীকৃত হাদিস হবার সম্ভাবনা কম, কেননা তা হাফসার জানা তথ্যকে এবং নবির গোপন খবর ফাঁস হবার ঘটনা বেমালুম চেপে গিয়েছে।
——————-
পাদটীকা
৪৪. কোরানের ১০৫ তম সুরা ফিল-এ এই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আবিসিনীয়রা এই যুদ্ধে একটি বিশাল রাজকীয় হাতি ব্যবহার করেন। সুরা ফিল-এর ৩-৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবিল পাখি কঙ্কর ফেলে আবিসিনীয় বাহিনীকে কুপোকাত করে ফেলে। ইতিহাসবিদ ইকরিমা এবং কোরানের বিশিষ্ট তফসিরকারক আল-তাবারির মতে, কোরানের এই আয়াতগুলো রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, আসলে যুদ্ধের ময়দানে আবিসিনীয়রা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল।
৪৫. ধারণা করা হয়, কোরানের ৩৪ তম সুরা সাবার ১৫-১৬ নম্বর আয়াতদ্বয় এই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে। প্রত্নতাত্ত্বিক ও শিলালিপির নিদর্শন থেকে জানা গেছে, এই ঘটনা ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ঘটেছিল।
৪৬. মক্কা থেকে প্রায় ৫০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত তুলনামূলক বড় শহর। এখানে স্বল্পপরিসরে কৃষিকাজের মাধ্যমে খাদ্যশস্যের চাষ হতো। বাণিজ্যিক কাফেলা ও মরুযাত্রীর ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এই শহর গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পৌত্তলিকদের দেবী আল-লাতের একটি উপাসনালয়ও এখানে ছিল।
৪৭. কোরানে একবার (৩৩:১৩) এই শহরের নাম ইয়াসরিব উল্লেখ করা হয়েছে এবং চারবার আল-মদিনা (৯:১০১, ৯:১২০, ৩৩:৬০, ৬৩:৮) উল্লেখ করা হয়েছে।
8৮. Le dogme et la loi de l’Islam SFFITT :Felix Arin, দ্বতীয় সংস্করণ, প্যারিস ১৯৫৮, পৃ. ৩।
৪৯, উমিয়িন শব্দটিকে অনেকক্ষেত্রে নিরক্ষর হিসেবে ধরা হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এবং কোরানের অনেক জায়গায় যাদেরকে ধর্মগ্রন্থ দেয়া হয়নি বলতে বোঝানো হয়েছে।
৫০. সুরা বাকারার ১৯১ নম্বর আয়াতে ফিৎনা শব্দটি যন্ত্রণা প্রদান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। নৈরাজ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।
৫১. ইরানের খোরাসানের তুশ শহরের আবু হামিদ মুহাম্মদ আল-গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১ খ্রিস্টাব্দ) একজন অসামান্য মরমী সাধক ও ধর্মবিশারদ ছিলেন। তার সবচেয়ে বহুল পঠিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে : ইহিয়া উলুম ঈদ-দ্বিন’ (নীতিনৈতিকতা বিষয়ক গ্রন্থ),
কিমিয়ায়ে সাদাত’, ‘তামফাতুল আল-ফালাসিফা (অধিবিদ্যাবিষয়ক দর্শন) এবং আল-মনকেদ মেন আদ-দালাল (আত্মজৈবনিক)। ইমাম গাজ্জালি যদিও একজন বিশিষ্ট সুন্নি বিশেষজ্ঞ, তবে তার লিখিত রচনাবলী শিয়া মতাবলম্বীদের অনেকেই সমানের চোখে দেখে থাকেন।
৫২. দ্রষ্টব্য : পাদটীকা ২০।
৫৩. দ্রষ্টব্য : পাদটীকা ৬।
৫৪. খুব সম্ভবত নবির রেওয়াজ অনুসরণ করে আব্বাসীয় শাসক এবং পরবর্তী মুসলমান শাসকরা সম্মানসূচক উপহার হিসেবে ‘আলখাল্লা পরিধান করতেন। যদিও প্রাচ্যে এই পোশাকটি ইসলামের প্রচারের অনেক আগে থেকে পরিধান করা হতো। মিশরীয় কবি শরাফ উদ্দিন আল-বুশিরির (১২১২-১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ) লিখিত আলখাল্লা গাথা নামে জনপ্রিয় একটি ধর্মীয় কবিতা রয়েছে। কবিতাটা তিনি লিখেছেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর। একদিন কবি স্বপ্নে দেখেন নবি তার দিকে একটি আলখাল্লা ছুড়ে দিচ্ছেন, সেখান থেকে তিনি কবিতা লেখার প্রেরণা লাভ করেন।
৫৫. আলি দস্তি বাক্যটি ব্যবহার করেছেন এভাবে খাবার রান্নার জন্য বসে আছো এমন ভাব প্রদর্শন করিও না।’
৫৬. আরবি হিজাব’শব্দটির মূল অর্থ ঢেকে রাখা’। ‘বোরখা শব্দের অর্থে পর্দা শব্দের ব্যবহার অনেক পরে শুরু হয়েছে।
৫৭. ইসলামি পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, আদ্য হচ্ছে একটি প্রাচীন জাতির নাম আর ইরাম হচ্ছে তাদের শহর। অবশ্য ভিন্নমতে ওই গোষ্ঠীর প্রধানের নাম হচ্ছে ইরাম। আল্লাহ প্রেরিত নবি হুদকে অপমান করায় ওই জনগোষ্ঠীকে বন্যা ও অনাবৃষ্টির কবলে পড়তে হয়। ফলে তারা ধ্বংস হয়ে যায়।
৫৮. আরেকটি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নাম হচ্ছে সামুদ। রোমান লেখনীতেও এদের নাম উল্লেখ আছে। তারা পেত্রা নগরীর নাবাতিয়ানদের সমগোত্রীয় ছিল এবং সেমেটিক রচনা ও লিপিতে এখনো তাদের কিছু লেখা অবশিষ্ট খোঁজ পাওয়া যায়। রোমানরা পেত্রা নগরী দখল করার পর তাদের শহর আল-হেইর (হেজাজের উত্তরে অবস্থিত) ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে ছিল অনেক দিন ধরে। আল হেরা থেকে উদ্ধার করা পাথরের লিপিতে (পেত্রা থেকে কিছুটা ছোট) সামুদের লেখা রয়েছে। ইসলামি বর্ণনা অনুযায়ী, নবি সালেহকে অস্বীকার করায় সামুদবাসীরা বজ্রাঘাত ও ভূমিকম্পের ফলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
৫৯. সাধারণভাবে আরবি ওয়াতাদ’ শব্দের অর্থ কাঠের টুকরোর স্ত্র অথবা তাবু গাঁথার পেরেক বোঝায়। শিবির বা তাবুর অধিপতি কথাটির কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত কোনো তফসিরকারক বা ইসলামি চিন্তাবিদ দিতে পারেননি।
৬০. আলফ্রেড গিয়োম অনূদিত ইবনে ইসহাকের লাইফ অব মুহাম্মদ, অক্সফোর্ড ১৯৫৫, পৃ. ৬৫১। আলি দস্তি এবং আলফ্রেড গিয়োম উভয়েই আরবি ‘আওয়ান’ শব্দটিকে বন্দী’ বা অবরুদ্ধ’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আক্ষরিক অর্থে এটি হচ্ছে মধ্যবর্তী’। এক্ষেত্রে সম্ভবত ‘স্বাধীন ও পরাধীনের মধ্যবর্তী কিছু বোঝানো হয়েছে। সুরা বাকারা-এর ৬৮ নম্বর আয়াতে বয়স্ক ও কমবয়সীর মধ্যবর্তী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ভিন্নমতে এটি হচ্ছে আরবি ‘আনিয়া’ শব্দের বহুবচন, যার অর্থ হচ্ছে “অক্ষমতায় যন্ত্রণাক্লিষ্ট’।
৬১. মাহমুদ বিন ওমর আল-জামাখশারি (১০৭৫-১১৪৪ খ্রিস্টাব্দ) কোরানের তফসিরসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বই রচনা করেছেন। তার আল-কাশশাফ’ নামের কোরানের তফসিরসহ আরবি ব্যাকরণ ও আরবি-ফার্সি অভিধানও তিনি রচনা করেছেন। তিনি
ইসলামের যুক্তিবাদী মুতাজিলা দর্শনের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। একই সাথে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও কোরানের লৌকিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন।
৬২. আব্দুল্লাহ বিন ওমর আল-বায়দাওয়ি আরবিতে কোরানের তফসির রচনা করেছেন। এখনো সুন্নি মুসলমানরা এই তফসির গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহার করেন। আনোয়ার উল-তানজি শিরোনামের এই তফসির গ্রন্থটি আল-জামাখশারির আল-কাশশাফ – কে ভিত্তি করে রচিত তবে মুতাজিলা দর্শনের প্রভাবমুক্ত।
৬৩. বাগদাদে জন্মগ্রহণকারী ইমাম আহমদ বিন হানবল (৭৮০-৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ) হাদিসের সংকলন আল-মোসনাদ’- এর রচয়িতা। সংকলনটি শেষ পর্যন্ত হানবলের পুত্র আব্দুল্লাহ সমাপ্ত করেন। ইসলামি ধর্মতত্ত্বের আক্ষরিক ও নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনুসরণের তিনি পথিকৃৎ। তিনি হানবলি দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। আব্বাসীয় শাসনামলে মুতাজিলা মতাদর্শের বিপক্ষে দাঁড়ানোর কারণে নির্যাতনের শিকার হন এবং কারাবাসও করতে হয়। দামেস্ক শহরের নাগরিক আহমদ বিন তায়মিয়া (১২২২-১৩২৮ খ্রিস্টাব্দ) পরবর্তীতে হানবলি মতাদর্শকে প্রসারিত করেন এবং বই রচনা করেন। যা কট্টরপন্থী ওয়াহাবি মতাদর্শ বিকাশে ভূমিকা রেখেছিল।
৬৪. ইরাকের বসরা শহরে জন্মগ্রহণকারী মুহাম্মদ বিন সাদ (৭৮৪-৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ) কিতাব আল-তাবাকাত গ্রন্থের রচয়িতা। এই গ্রন্থে নবি ও সাহাবিদের জীবনী এবং ৪২৫০ টি হাদিসের উল্লেখ রয়েছে।
৬৫. আরবি ভাষায় মুতা পরিভাষাটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে উপভোগ করা। সুরা নিসার ২৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখিত যাদেরকে তোমরা উপভোগ করবেশব্দসমষ্টিও একই উৎসের অর্থ প্রকাশ করে।
৬৬. আরবি ইদা”শব্দের অর্থ ‘অপেক্ষার প্রহর’। এটা সেই সময়কালকে বোঝায় যখন কোনো বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত নারীর দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি থাকে না। কারণ এই সময়কালে তার আগের স্বামী কর্তৃক অন্তঃসত্ত্বা হবার সম্ভাবনা থাকে। ইসলামি শাস্ত্র অনুযায়ী, কোনো বিধবার জন্য ইদ্দতকাল হচ্ছে ৪ মাস ১০ দিন, কোনো তালাকপ্রাপ্ত নারীর জন্য ৩ মাস, বিধবা দাসীর জন্য ২ মাস, তালাকপ্রাপ্ত দাসীর জন্য ১.৫ মাস।
৬৭. আব্বাসীয় খলিফার শাসনামলে মুহাম্মদ আত-তিরমিজির (মৃত্যু ২৭৯ হিজরি বা ৮৯২ খ্রিস্টাব্দ) জন্ম পারস্যে। সুন্নি ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যতম ছয়টি হাদিস সংকলনের অন্যতম জামি আত-তিরমিজি সংকলনটি করেছেন তিনি। সুন্নি মুসলমানদের কাছে এই হাদিসের স্থান শীর্ষে।
৬৮. হানিফ সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে প্রথম অধ্যায়ে।
৬৯. নবি মুহাম্মদের কন্যা জয়নাবের প্রথম বিয়ে হয়েছিল খাদিজার বোনের ছেলে আবুল-আসের সাথে। রোকেয়া ও উমে কুলসুমের বিয়ে হয়েছিল মুহাম্মদের চাচা আবু লাহাবের দুই পুত্র ওতবা ও ওতাইবার সাথে। আর ফাতেমার বিয়ে হয়েছিল মুহাম্মদের চাচাতো ভাই আলি বিন আবু তালিবের সাথে। ইসলাম প্রচার শুরু করলে নবি মুহাম্মদের সাথে চাচা আবু লাহাবের দ্বন্দু শুরু হয় এবং লাহাব পুত্রদেরকে মুহাম্মদের কন্যাদ্বয়কে তালাক দিতে বাধ্য করেন। পরে রোকেয়ার সাথে বিয়ে হয় হজরত উসমানের। রোকেয়ার মৃত্যুর পর উসমান বিয়ে করেন মুহাম্মদের আরেক কন্যা উম্মে কুলসুমকে।
৭০. এনসাইক্লোপেডিয়া অব ইসলাম”- এ লেখক এইচ. রেকেনডফ মেয়েটির নাম বলেছেন কায়লা। (দ্রষ্টব্য : Encyclopedia of Islam, 2nd ed., Leiden 1960, vol. I, p. 697, article al-Ash’ath) ISIRTFI ডব্লিউ. এম. ওয়াট মেয়েটির নাম বলেছেন
“čFTERTĞii”(Muhammad at Madina, Oxford 1956, p. 397) | উভয় লেখকই উল্লেখ করেছেন, নবি মুহাম্মদের সাথে তার বাগদান সম্পন্ন হয়েছিল কিন্তু মেয়েটি মদিনা পৌছানোর আগেই নবির মৃত্যু ঘটে।
৭১. ইরানের বাদশাহ খশরু-২ পারভেজের সেনারা ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে মিশর আক্রমণ করে। ৬২৮ সাল পর্যন্ত মিশরের বিশাল অংশ ইরানের দখলে ছিল। ঐতিহাসিক আল-তাবারি হিস্ট্রি অব দ্যা প্রফেটস এন্ড কিংস (তারিক আল-রসুল ওয়া আল-মুলুক) বইয়ে বলেছেন, ষষ্ঠ হিজরিতে (৬২৭-৬২৮ খ্রিস্টাব্দ) বিশিষ্ট কবি এবং সাহাবি হাসান ইবনে সাবিত মিশর ভ্রমণকালে মিশরের রোমান গভর্নর (আল-মুকাওকিস নামে সম্বোধন করা হয়) নবির জন্য খ্রিস্টান ক্রীতদাসী মারিয়া কিবতিয়া এবং সাবিতকে মারিয়ার বোন শিরিনকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। সম্ভবত ৬২৮ সালের পূর্বে মারিয়া মদিনায় এসে পৌছান।
৭২. নবির চাচাতো ভাই ও আব্বাসীয় খেলাফতের পূর্বপুরুষ আব্দুল্লাহ বিন আল-আব্বাস (ইবনে আব্বাস নামেও পরিচিত) প্রচুর সংখ্যক হাদিস-বক্তা হিসেবে সুপরিচিত। ৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে (৬৮ হিজরি) তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
৭৩. দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনে আল-খাত্তাবের পুত্র আব্দুল্লাহ বিন ওমর (৬১৪-৬৯৩ খ্রিস্টাব্দ)। মুসলমানদের পক্ষে তিনি অসংখ্য যুদ্ধে লড়াই করেছেন। কিন্তু উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করতে তিনি সবসময় অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। একজন সৎ ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এবং অভ্রান্ত হাদিস-বক্তা হিসেবে তিনি সুপরিচিত।
৭৪.দ্রষ্টব্য : পাদটীকা ৪৩।
৭৫. দ্রষ্টব্য ; পাদটীকা ১।
৭৬. প্রথম পক্ষের স্ত্রীর গর্ভে জন্মানো ওসামা নামে এক পুত্রসন্তান ছিল জায়েদের। ৬২৬ সালে জয়নাবকে তালাক দেবার পর তিনি আরও বিয়ে করেন এবং অনেক সন্তানের পিতা হন। মুসলমানদের পক্ষে তিনি অনেক যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নবি তাঁকে প্রথম সিরিয়া-অভিযানের সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। ওই যুদ্ধে (মুতা যুদ্ধ নামে পরিচিত) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জায়েদের তরুণ পুত্র ওসামা ৬৩২ সালের সিরিয়া অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেনাপতির দায়িত্বে ওসামার নিয়োগ নিয়ে অনেক শীর্ষ সাহাবি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।
৭৭. আল-জামাখশারি তার বিখ্যাত কোরানের তফসির আল-কাশশাফ – এ (পাদটীকা ৬১ দ্রষ্টব্য) হাদিসটি মোকাত্তেল বিন সুলেমানের বলে উল্লেখ করেছেন। আলি দস্তিও আল-জামাখশারির এই হাদিসটি গ্রহণ করেছেন। (তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পল প্র্যাকম্যান)।

No comments:

Post a Comment