Wednesday, May 23, 2018

চতুর্থ প্রস্তাব
[ধর্ম বিষয়ক-১]
১। আল্লাহ মানুষকে পরিবর্তন না করিয়া ঝঞ্ঝাট পোহান কেন? 
আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি ইচ্ছা করিলে অসম্ভবও সম্ভব করিতে পারেন। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য যদি ইহাই হয় যে, মানুষ তাঁহার এবাদত বন্দেগী করিবে, তাহা হইলে তিনি সমস্ত মানবকে দিয়া তাঁহার উদ্দেশ্য পালন করাইতে পারেন না কি? পারিলে তাহা না করিয়া তিনি মানুষের দ্বারা হেদায়েতের ঝঞ্ঝাট পোহান কেন? ইহাতে কি তাঁহার আসল উদ্দেশ্যের ব্যাঘাত ঘটিতেছে না? হজরত ইব্রাহিম, মুসা ও মোহাম্মদ (দ.)-কে কোন মানুষ হেদায়েত করে নাই, করিয়াছেন আল্লাহতায়ালা। কিন্তু নমরুদ, শাদ্দাদ, ফেরাউন, আবু জাহেল ইত্যাদি কাফেরদিগকে তিনি হেদায়েত করিলেন না কেন? তিনি স্বেচ্ছায় হেদায়েত করিলেন না, না, করিতে পারিলেন না?
২। ভাগ্যলিপি কি অপরিবর্তনীয়? 
যদিও মানুষ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অজ্ঞ, তবু কর্মফলে বিশ্বাস আছে বলিয়াই সে জগতের সকল রকম কাজকর্ম করিয়া যাইতেছে সমাজ ও রাষ্ট্র কর্মফলকে ভিত্তি করিয়াই গঠিত হইয়াছে এবং ‘কর্মফল আছে’
বলিয়াই উহারা টিকিয়া আছে। রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষকে শিক্ষা দিতেছে – কর্ম কর, ফল পাইবে। কিন্তু ধর্ম শিক্ষা দিতেছে ইহার বিপরীত। ধর্ম বলিতেছে – কর্ম করিয়া যাও, ফল অদৃষ্টে (তকদীরে) যাহা লিখিত আছে, তাহাই পাইবে। এক্ষেত্রে মানুষ কর্ম করিল বটে, কিন্তু ফল রহিল ভগবানের কাছে ভাগ্যলিপিতে নিবদ্ধ। মানুষ জানিল না যে, সে তাহার কাজের ফল পাইবে কি না। কর্মফলের নিশ্চয়তা থাকিলে সন্দিগ্ধ মনেও কাজ করা চলে। যেহেতু তাহাতে মানুষ ভাবিতে পারে যে, হয়ত সে তাহার কাজের ফল পাইতেও পারে। কিন্তু ধর্ম বলে – কর্ম যা কিছুই কর না কেন, ফল নির্ধারিত যাহা আছে, তাহাই পাইবে, একটুও এদিক ওদিক হইবে না। তাহাই যদি হয়, অর্থাৎ কর্মের দ্বারা ভাগ্যলিপি পরিবর্তিত না হয়, তবে কর্ম করিয়া লাভ কি? বিশেষত মানুষের কৃত ‘কর্মের দ্বারা ফলোৎপন্ন’ না হইয়া যদি ঈশ্বরের নির্ধারিত ‘ফলের দ্বারা কর্মোৎপত্তি’ হয়,তবে ‘সৎ’ বা ‘অসৎ’ কাজের জন্য মানুষ দায়ী হইবে কেন?
মনে করা যাক – কোন এক ব্যক্তির ভাগ্যলিপিতে লেখা আছে যে, সে ‘নারকী’। এখন সে নির্ধারিত ঐ ফলোৎপাদক কার্য, যথা – চুরি, ডাকাতি, নরহত্যা ইত্যাদি করিবে না কি? যদি করে, তবে তাহা সে কাহার ইচ্ছায় করে? নিজের ইচ্ছায়, না ভগবানের ইচ্ছায়? আর যদি সে কোন পাপ-কর্ম না করিয়া পুণ্য কর্মই করে, তবে তাহার ভাগ্যলিপির ‘নারকী’ শব্দটি কাটিয়া, স্বর্গবাসী এই শব্দটি লেখা হইবে কি? যদি না-ই হয়, তবে হেদায়েতের তম্বিটি কি লৌকিক? আর যদি হয়, তবে ভবিষ্যৎজান্তা ভগবান এই পরিবর্তনের সংবাদ পূর্বাহ্নে জানিয়া প্রথমবারেই অকাট্য তালিকা প্রস্তুত করেন নাই কেন?
ভাগ্যলিপি অপরিবর্তনীয় হইলে স্বয়ং ভগবানও উহা মানেন কি না। যদি না মানেন, তবে তিনি উহা লিখিয়াছিলেন কেন? আর যদি মানেন, তবে তিনি লিপি প্রস্তুতির সময় স্বাধীন হইলেও বর্তমানে স্বাধীন হন কিরূপে? ভগবানের বর্তমান কর্তব্য কি শুধু তালিকা দেখিয়া দেখিয়া জীবকুলকে দিয়ে কার্য করান? তাহাই যদি হয়, তবে বিশ্বস্রষ্টার আশু কর্তব্য কিছুই নাই?
৩। আদমের পাপ কি?
আলেমগণ বলিয়া থাকেন যে, আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্য হইল এই যে, আল্লাহ তাঁহার দ্বারা পৃথিবী মানুষ পূর্ণ করিবেন এবং শেষপয়গম্বর হজরত মোহাম্মদ (দ.)-এর দ্বারা ইসলাম প্রচার করাইবেন ইত্যাদি। এই সমস্ত পরিকল্পনাই নাকি ভাগ্যলিপির অন্তর্ভুক্ত। আদমকে বেহেস্তে রাখিয়া তাঁহাকে গন্দম খাইতে যে নিষেধ করা হইয়াছিল, সে নিষেধ কি খোদাতা’লার আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল? আদম গন্দম খাইয়া প্রকারান্তরে আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ করিলেন। যে কাজ ভাগ্যলিপির অনুকূল এবং আল্লাহর ইচ্ছাকে পূর্ণ করে, তাহাতে পাপ কি? পক্ষান্তরে আদম যদি গন্দম না খাইতেন, তাহা হইলে মাহফুজের (লিপিফলকের) যাবতীয় লিপিই বরবাদ হইত না কি? অর্থাৎ পৃথিবীতে মানবসৃষ্টি, বেহেস্ত, দোযখ, হাশর ময়দান ইত্যাদির পরিকল্পনা সমস্তই মাঠে মারা যাইত না কি?
৪। শয়তান কি?
শয়তানের সহিত কোন মানুষের প্রত্যক্ষ পরিচয় না থাকিলেও তাহার নামটির সাথে যথেষ্ট পরিচয় আছে। ‘শয়তান’ – এই নামটি এত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হইতেছে যে,হাটে,মাঠে, কোর্ট-কাছারীতে, দোকান,স্কুল-কলেজ,ওয়াজের মাহফিল ইত্যাদির সর্বত্র এবং নারী,পুরুষ,বৃদ্ধ,এমনকি অনেক হিন্দুও ‘শয়তান’ নামটি ব্যবহার করিয়া থাকেন। কেহ,কেহ,এমনও বলিয়া থাকেন যে,“ব্যাটা ভারী শয়তান”।
‘শয়তান’ কথাটির ধাতুগত অর্থ যাহাই হউক, উহাকে সমাজের যাবতীয় দুষ্কর্মের কারক হিসাবেই লোক ব্যবহার করিতেছে।
ধর্মাধ্যায়ীগণ বলিয়া থাকেন যে, শয়তান পূর্বে ছিল ‘মকরম’ বা ‘ইবলিস’ নামক বেহেস্তবাসী একজন প্রথম শ্রেণীর ফেরেস্তা এবং অতিরিক্ত মুসল্লি। মকরম সেখানে খোদাতালার হুকুমমত আদমকে সেজদা না করায় ‘শয়তান’ আখ্যা পাইয়া চিরকাল মানুষকে অসৎ কাজের প্ররোচনা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করিয়া পৃথিবীতে আসে এবং সে অদ্যাবধি নানাবিধ উপায়ে অসৎ কাজে প্ররোচনা বা দাগা দিয়া বেড়াইতেছে।
আদম ও বিবি হাওয়াকে দাগা দিয়াছিল শয়তান একা। কিন্তু আদমের বংশবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শয়তানেরও কি বংশবৃদ্ধি হইতেছে? না হইলে দাগাকাজ সুচারুরূপে চলে কি রকম?
কেহ কেহ বলেন যে, শয়তানেও বংশবৃদ্ধি হয় এবং উহা মানুষের চেয়ে দশগুণ বেশী। কারণ প্রতিগর্ভে সাধারণত মানুষ জন্মে একটি, আর শয়তান জন্মে দশটি করিয়া। তাহাদের নাম হয় যথাক্রমে – জ্বলিতন, ওয়াছিন, নফছ, আওয়াম, আফাফ, মকার, মহুদ, দাহেম, ওল-হান ও বার। ইহারা ক্ষেত্রবিশেষে থাকিয়া বিশেষ বিশেষ দাগাকার্য সম্পন্ন করিয়া থাকে। অধিকন্তু ইহাদের মানুষের মত মরণ নাই। কেয়ামতের দিন মানবজাতি যখন কায় পাইবে তখন ইহাদের মৃত্যু ঘটিবে।
জন্ম-মৃত্যুর ঠেকাঠুকিতেও বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষ টিকিয়া আছে প্রায় তিনশ কোটি। আর মানুষের চেয়ে দশগুন বৃদ্ধি পাইয়া শয়তানের সংখ্যা কত? আদম হইতে আজ পর্যন্ত যত লোক জন্মিয়াছে তাহারা
যদি সকলেই জীবিত থাকিত,তাহা হইলে লোকসংখ্যা যত হইত,বোধ হয় যে,কোন ভাষার সংখ্যা দ্বারা তাহা প্রকাশ করা যাইত না। পৃথিবীতে বর্তমানে শয়তানের সংখ্যা তাহারই দশগুণ বেশী নয় কি? ইহাতে মনে হয় যে, পৃথিবীর জলে, স্হলে ও বায়ুমন্ডলে শয়তান গিজগিজ করিতেছে এবং প্রতিটি মানুষের পিছনে লাখ লাখ শয়তান দাগা দিয়া বেড়াইতেছে।
এত অসংখ্য শয়তান মানবসমাজকে পাপের পথে অহরহ প্ররোচিত করিতেছে, কিন্তু শয়তানের সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাইলেও অসৎকাজের মাত্রা ঐ অনুপাতে বাড়িতেছে না, বরং মানবিক জ্ঞান ও সভ্যতা বৃদ্ধিরর সাথে সাথে অসৎকাজের মাত্রা ক্রমশ হ্রাস পাইতেছে। এখনও দেখা যায় যে, শিক্ষিতের সংখ্যা ও শিক্ষায়তনের সংখ্যা ক্রমশ বাড়িতেছে বৈ কমিতেছে না। ন্যায়নিষ্ঠ সাধুপুরুষদের সংখ্যাও নগণ্য নহে। লন্ডন শহরে নাকি এমন দোকানও আছে, যেখানে বিক্রেতা নাই। অথচ ক্রেতাগণ উচিত মূল্য দিয়াই জিনিসপত্র ক্রয় করিতেছে। আবার কোন রকম হারান জিনিস প্রাপ্ত হইয়াও কেহ তাহা আত্মসাৎ করে না। বরং লন্ডন ট্রান্সপোর্ট লস্ট প্রপার্টি অফিসে উহা জমা দিয়া থাকে, সেখান হইতে জিনিসের মালিক তাহা ফেরত পাইয়া থাকে।১০ সেখানে কি শয়তান কম?
ধর্মপ্রচারকদের বর্ণনা শুনিয়া মনে হয় যে, ফেরেস্তাগণ সবাই নপুংসক। মকরমও তাহাই ছিল ‘লানত’ বা অভিশাপ প্রাপ্তির সময়ও মকরম একাই ছিল এবং নপুংসক ছিল। তৎপর তাহার বংশবৃদ্ধির জন্য লিঙ্গভেদ হইল কখন? শুধু ইহাই নহে, শয়তানের বংশবৃদ্ধি সত্য হইলে, প্রথমত তাহার ক্লীবত্ব ঘুঁচাইয়া পুংলিঙ্গ গঠনাস্তে একটি স্ত্রী-শয়তানেরও আবশ্যক ছিল। বাস্তবিক কি শয়তানেও স্ত্রী আছে? আর না থাকিলেই বা তাহার বংশবৃদ্ধির উপায় কি?
‘শয়তানের দাগা’ বলিতে কি শুধু রোজা-নামাজের শৈথিল্যই বুঝায়, না চুরি, ডাকাতি, বদমায়েশী, নরহত্যা ইত্যাদিও বুঝায়? যদি যাবতীয় অসৎকার্য শয়তান কর্তৃকই অনুষ্ঠিত হয়, তবে জাতিভেদে অসৎ কাজের মাত্রাভেদ হয় কেন? অর্থাৎ, যে কোন দেশের সম্প্রদায়সমূহের জনসংখ্যার অনুপাতে অপরাধী বা কারাবাসীর সংখ্যা হওয়া উচিত। কিন্তু তাহা না হইয়া সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের মধ্যে কারাবাসীর সংখ্যাধিক্য কেন?
জীবজগতে দেখা যায় যে, মাংসাশীগণ উগ্রস্বভাববিশিষ্ট এবং নিরামিষাশীরা শান্ত। গরু, ছাগল,ভেড়া, মহিষ,হাঁস-মোরগ, কবুতর,ইত্যাদি প্রাণী মাংসাশী নহে,ইহারা শান্ত। অথচ ব্যাঘ্র,সিংহ, শৃগাল, কুকুর, কাক, চিল ইত্যাদি প্রাণীকূল মাংসাশী এবং উগ্রস্বভাববিশিষ্ট। এ কথাও স্বীকার্য যে, স্বভাবের উগ্রতায় নানা প্রকার অঘটন ঘটিয়া থাকে। ইহাও দেখা যায় যে, মানব সমাজের ভিতর যে জাতি অতিরিক্ত মাংসাশী, সেই জাতির মধ্যেই অতিরিক্ত দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও নরহত্যা অনুষ্ঠিত হয়। এই সকল গর্হিত কাজের উৎপাদক কি শয়তান,না মাংস আর উত্তেজক মসল্লা?
বলা যাইতে পারে যে, কোন কোন দেশের মানুষ মাংসাশী হইয়াও বেশ শান্ত-শিষ্ট ও সংযমী। ইহার কারণ এই নয় যে, সে দেশে শয়তানের উপদ্রব কম বা সে দেশের মাংসে উত্তেজনাশক্তি নাই। ইহার কারণ এই যে, এইরূপ কোন জাতি নিরক্ষাঞ্চলের অধিবাসী নহে। অধিকাংশই হিমাঞ্চলের বাসিন্দা। দেশের শীতকালই তাহাদের স্বভাবের উগ্রতা প্রশমিত করিয়া রাখে।
সুধীগণ বলেন যে, মানুষের মধ্যে ছয়টি আধ্যাতিক শত্রু আছে। উহারা ষড়রিপু নামে পরিচিত। যথা = কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। ইহাদের তাড়নায় মানুষ নানাবিধ অসৎকাজ করিয়া থাকে। যে কোন উপায়ে হউক, ইহাদিগকে দমন করিতে পরিলে মানুষ নিষ্পাপ হইতে পারে।
মনোবিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সভ্যতার ঊষালোক পইবার পূর্বে আহার-বিহারে মানুষ ও ইতর জীবের মনোবৃত্তির বিশেষ পার্থক্য ছিল না। সে সময়ের মানুষের মন ছিল কৃত্রিমতাহীন, সরল ও স্বাধীন। তখন মানুষ তাহার যে কোন ইচ্ছা বা প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করিতে পারিত। তখন প্রবৃত্তিই ছিল মানুষের যথাসর্বস্ব। জ্ঞান উন্মেষের সাথে সাথে মানুষ প্রথম দলবদ্ধ ও পরে সমাজবদ্ধ হইয়া বসবাস করিতে শুরু করে। এই দল বা সমাজকে রক্ষা করিতে আবশ্যক হইল ত্যাগ ও সংযমের। আদিতে এই ত্যাগ ও সংযম ছিল স্বেচ্ছাধীন। ক্রমে যখন সভ্যতা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল,তখন তাহার দল বা সমাজের বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সংযমকে বাঁধিল নীতি ও নিয়মের শৃঙ্খলে। ইহাতে মানুষের সেই স্বাধীন প্রবৃত্তিগুলিকে সু ও কু – এই দুইভাগে বিভক্ত করিয়া সু প্রবৃত্তিগুলিকে স্বাধীনই রাখা হইল, কিন্তু কু প্রবৃত্তিগুলিকে করা হইল কারারুদ্ধ। কারাবাসী কুপ্রবৃত্তিগুলিকে মনের অন্ধকার কারাকক্ষে ঘুমাইয়া রহিল। মনের যে অংশে সেই রুদ্ধপ্রবৃত্তি বাস করে,বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় তাহাকে বলা হয় অচেতন মন বা নির্জ্ঞান মন (Unconscious Mind)।
মানুষ তাহার জাতিগত জীবনের হাজার হাজার বৎসরের পুরাতন অচেতন মন স্বরূপ মূলধন (উত্তরাধিকার সূত্রে) লইয়া পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এবং ব্যক্তিগত জীবনে মানুষ যে সকল অশুভ কামনা সমাজের নীতি,ধর্মের বিধান ও রাষ্ট্রের শাসনের ভয়ে চরিতার্থ করিতে পারে না,তাহাও ক্রমে বিস্মৃতির অতুলগর্ভে ডুবিয়া গিয়া অচেতন মনে স্হান লয়। অচেতন মনে রুদ্ধপ্রবৃত্তিগুলি সময় সময় জাগ্রত হইয়া কারারক্ষীকে ফাঁকি দিয়া বাহিরে আসে এবং সুপ্রবৃত্তিগুলিকে যে শক্তি অবরুদ্ধ করিয়া রাখে,তাহাকে কারারক্ষী (Censor) বলা হয়। কারাবন্দী কুপ্রবৃত্তিগুলি সময় সময় জাগ্রত হইয়া কারারক্ষীকে ফাঁকি দিয়া বাহিরে আসে এবং সুপ্রবৃত্তিগুলির সহিত মেলামেশা করিয়া তাহাদিগকে বিপথে চালিত করে। ইহা হইতে মানব সমাজের যত কিছু বিড়ম্বনা। মানুষের যাবতীয় অশুভচিন্তা ও অসৎকাজের উদ্যোক্তা এই অচেতন মন।
এতদ্বিষয পর্যালোচনা করিলে বুঝা যায় যে, যাবতীয় অসৎকাজের উদ্যোক্তা মানুষের অভ্যন্তরীণ রিপুসমূহ, বাহিরের কিছু নয়। তবে কি মানুষের কু-প্রবৃত্তিগুলিকেই শয়তান বলা হয়, না মানবদেহাতিরিক্ত স্বতন্ত্র সত্তাবিশিষ্ট শয়তান-এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়?
৫। উপাসনার সময় নির্দিষ্ট কেন?
দেখা যায় যে, সকল ধর্মেই কোন কোন উপাসনার জন্য বিশেষ বিশেষ সময় নির্দিষ্ট আছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে ঐ সকল উপাসনা করিলে বিশ্বপতি কে উহা মঞ্জুর করিবেন না, তাহার কোন হেতু পাওয়া যায় না।
ইসলামিক শাস্ত্রে প্রত্যেহ পাঁচবার নামাজের ব্যবস্হা আছে। এই পাঁচবার নামাজের প্রত্যেকবারের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আদেশ আছে, আবার কোন কোন সময়ে নামাজ নিষেধ।
পৃথিবী আবর্তনের ফলে যে কোন স্হিরমুহূর্তে বিভিন্ন দ্রাঘিমার উপর বিভিন্ন সময় সূচিত হয় এবং প্রতি মুহূর্তেই কোন না কোন স্হানে নির্দেশিত উপাসনা চলিতে থাকে। অথচ সূর্য উদয়, সূর্য অস্ত এবং মধ্যাহ্নে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ (হারাম) । ইহার তাৎপর্য কি? এখানে যখন সূর্যোদয় হইয়াছে, তখন এখান হইতে পশ্চিমে কোনখানে সূর্যোদয় নাই এবং এস্হান হইতে পূর্বদিকে পুর্বেই সূর্যোদয় হইয়াছে। এখানে যখন নামাজ পড়া হারাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই অন্যত্র হারাম নহে। উদাহারণস্বরূপ বলা যাইতে পারে যে, বরিশালে যখন সূর্যোদয় হইতেছে, তখল কলিকাতায় হয় নাই এবং চট্টগ্রামে কিছু পূর্বেই সূর্যোদয় হইয়া গিয়াছে। অর্থাৎ বরিশালে যখন নামাজ পড়া হারাম, তখন কলিকাতা বা চট্টগ্রামে হারাম নহে। তাহা হইলে নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনা নিষিদ্ধ হওয়ার তাৎপর্য কিছু আছে কি?
নামাজের নিষিদ্ধ সময় সম্বন্ধে যে কথা, ওয়াক্ত সম্বন্ধে সেই একই কথা। পৃথিবীর কোনস্হানেই ওয়াক্ত নহে – এরূপ কোন স্হির মুহূর্ত আছে কি? যদি না থাকে, অর্থাৎ, প্রতি মুহূর্তেই যদি পৃথিবীর কোন না কোন স্হানে নামাজ পড়া চলিতে থাকে, তবে নামাজের সময় নির্ধারণের তাৎপর্য কি?
একসময় পৃথিবীকে স্হির ও সমতল মনে করা হইত। তাই পৃথিবীর সকল দেশে বা সকল জায়গায় একই রকম সময় সূচিত হইবে, বোধহয় যে এরূপ মনে করিয়া ঐসকল বিধি-নিষেধ প্রবর্তিত হইয়াছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রমাণিত হইয়াছে যে, পৃথিবী গোল ও স্হিতিশীল।
পৃথিবীর গোলকহেতু যে কোন স্হানে বিশেষত সাগর বা মরূভূমিতে দাঁড়াইয়া দৃষ্টিপাত করিলে নিজেকে ভূ-পৃষ্ঠের কেন্দ্রে অবস্হিত বলিয়া ভ্রম হয়। মনে হয় যে, এই কারণেই আরববাসীগণ পবিত্র মক্কা শহরকে পৃথিবীর (ভূ-পৃষ্ঠের) কেন্দ্রে অবস্হিত বলিয়া ভাবিতেন এবং ওখানের সকাল-সন্ধাকেই ‘সকল দেশের সকাল-সন্ধা’ বলিয়া মনে করিতেন। এই ভ্রমাত্মক ধারণার ফলে যে সকল সমস্যার উদ্ভব হইয়াছে, তাহার কিছু আলোচনা করা যাক।
মনে করা যাক – কোন ব্যক্তি বেলা দেড়টার সময় জোহর নামাজ আদায় করিয়া বিমান-যোগে প্রতি
ঘন্টায় তিন হাজার মাইল বেগে চট্টগ্রাম হইতে পবিত্র মক্কা যাত্রা করিলেন। সেখানে পৌঁছিয়া তিনি দেখেন যে, ওখানে তখন দুপুর হয় নাই। ওয়াক্ত হইলে ঐ ব্যক্তির আর একবার জোহর নামাজ পড়িতে হইবে কি?
প্রতি ঘন্টায় ১০৪১২/৩ মাইল বেগে পশ্চিম দিকে বিমান চালাইলে (আপাতদৃষ্টিতে) সূর্যকে গতিহীন বলিয়া দেখা যাইবে। অর্থাৎ আরোহীর কাছে প্রাতঃ, সন্ধ্যা ও মধ্যাহ্ন কিছুই হইবে না; সূর্য যেন স্হিরভাবে একস্হানে দাঁড়াইয়া থাকিবে। এমতাবস্হায় আরোহীদের নামাজ ও রোজার উপায় কি?
পৃথিবীর শুধু বিষুব অঞ্চলেই বৎসরের কোন কোন সময় দিন ও রাত্রির পরিমাণ প্রায় সমান হয় না, ব্যবধান অল্প থাকে। কিন্তু উহা হইতে যতই উত্তর বা দক্ষিণে যাওয়া যায়, দিন ও রাত্রির সময়ের ব্যবধান ততই বাড়িতে থাকে। মেরু অঞ্চলের কোন কোন দেশের বৎসরের কোন কোন সময় দিন এত বড় হয় যে, ‘সন্ধা’ ও ‘ভোর’-এর মাঝখানে কোন রাত্রি নাই। সেখানে এশার নামাজের উপায় কি?
মেরু অঞ্চলে বৎসরে মাত্র একটি দিবা ও একটি রাত্রি হয় অর্থাৎ ছয় মাসকাল একাদিক্রমে থাকে দিন এবং ছয় মাসকাল রাত্রি। ওখানে বৎসরে হয়ত পাঁচবার (পাঁচ ওয়াক্ত) নামাজ পড়া যায়, কিন্তু একমাস রোজা রাখা যায় কি রকমে?
৬। নাপাক বস্তু কি আল্লাহর কাছেও নাপাক?
পৃথিবীর দ্রব্যাদির মধ্যে কতক দ্রব্য ধর্মীয় বিধানে নাপাক (অপবিত্র) । কিন্তু সে সকল কি আল্লাহর কাছেও নাপাক? যদি তাহাই হয়, তবে তাহা তিনি সৃষ্টি করিলেন কেন? আর যদি না হয়, তবে নাপাক অবস্হায় তাঁহার গুণগান করিলে তাহা তিনি অগ্রাহ্য করিবেন কেন? বলা হয় যে, আল্লাহ সর্বত্র বিদ্যমান। যদি তাহাই হয়, তবে নাপাক বস্তুর ভিতরে আল্লাহর অবস্হিতি নাই কি?
৭। উপাসনায় দিগনির্ণয় কেন?
সাকার উপাসকগণ তাঁহাদের আরাধ্য দেবতার দিকে মুখ করিয়া উপাসনা করিয়া থাকেন। যেমন কালী দেবীকে স্হাপন করা হয় দক্ষিণমুখী করিয়া এবং দুর্গাদেবীকে পশ্চিমমুখী। তাই পূজারীকে বসিতে হয় যথাক্রমে উত্তর ও পূর্বমুখী হইয়া। কিন্তু এই দিগনির্ণয় কেন, তাহা আমরা জানি না। বলা হইয়া থাকে যে, আল্লাহ নিরাকার এবং সর্বব্যাপী। তাহাই যদি হয়, তবে নিরাকার উপাসনায় কেবলার আবশ্যক কি এবং হাত তুলিয়া মোনাজাত কেন? ইহাতে আল্লাহর দিগবিশেষে স্হিতির সংকেত হয় কি না!
৮। ফেরেস্তা কি?
আমরা শুনিয়া থাকি যে, আল্লাহ নিরাকার। কিন্তু নিরাকার মাত্রই আল্লাহ নহে। বিশ্বব্যাপী ইথার (Ether) নিরাকার। কিন্তু ইথারকে কেহ ঈশ্বর বলে না। কেননা আকারবিহীন হইলেও ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় এবং উহার মধ্যে পদার্থের গুণও পাওয়া যায়। বিশেষত ইথার নিরাকার হইলেও চেতনাবিহীন। পদার্থ যতই সূক্ষ্মাক্তিসূক্ষ্ম হউক না কেন, উহার অস্তিত্ব এবং স্হিতি আছে। এমন কোন পদার্থ জগতে পাওয়া যায় নাই, যাহার অস্তিত্ব যন্ত্র বা ইন্দ্রিয়ানুভুতির বাহিরে।
শোনা যায় যে, ফেরেস্তা নামক এক জাতীয় জীব আছে এবং উহারা স্বর্গ-মর্ত্য সর্বত্র, এমনকি মানুষের সহচররুপেও বিচরণ করে। অথচ মানুষ উহাদের সন্ধান পায় না। উহারা কি কোন পদার্থের তৈয়ারী নয়? যদি হয়, তবে কোন অদৃশ্য বস্তুর দ্বারা তৈয়ারী? তাহা কি ঈশ্বর হইতেও সূক্ষ? হইলে তাহা কি? আর যদি কোন পদার্থের তৈয়ারী না হয়, তবে কি তাহারা নিরাকার?
আল্লাহ নিরাকার, চেতনাবিশিষ্ট ও কর্মক্ষম এক মহাশক্তি। পক্ষান্তরে নিরাকার, চেতনাবিশিষ্ট ও কর্মক্ষম আর একটি সত্তাকে ফেরেস্তা বলিয়া স্বীকার করিলে আল্লাহ অতুলনীয় থাকেন কিরূপে?
কেহ কেহ বলেন যে, ফেরেস্তারা নূরের তৈয়ারী। নূর বলিতে সাধারণত বুঝা যায় যে, আলো বা রশ্মি। সাধারণ আলো অদৃশ্য নয়, উহা দৃশ্যমান পদার্থ। কিন্তু বিশ্বে এমন কতকগুলি বিশেষ আলো বা রশ্মি আছে, যাহা চক্ষে দেখা যায় না। যেমন – আলফা রশ্মি, কসমিক রশ্মি ইত্যাদি। বিজ্ঞানীগণ নানা কৌশলে ইহাদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন এবং ইহাদের গুণাগুণও প্রমাণ করিতে সক্ষম হইয়াছেন কিন্তু বিজ্ঞানীগণ উহার কোন রকম রশ্মির দ্বারা তৈয়ারী ফেরেস্তার সন্ধান পাইতেছেন না। ফেরেস্তারা কোন জাতীয় রশ্মির (নূরের) দ্বারা তৈয়ারী?
৯। ফেরেস্তার কাজ কি?
পবিত্র কোরান ও বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনায় জানা যায় যে, স্বয়ং খোদাতা’লার হুকুমে সব সৃষ্টি হইয়া গেল। সৃষ্টিকার্য সম্পাদনে আল্লাহ কোন ফেরেস্তার সাহায্য লন নাই। যিনি সৃষ্টি করিতে পারেন, তিনি তাহা রক্ষা বা পরিচালনাও করিতে পারেন। কিন্তু বিশ্বসংসারের নানাবিধ কার্য সম্পাদন করিবার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বও খোদাতা’লা অসংখ্য ফেরেস্তা সৃষ্টি করিলেন কেন? শোনা যায় যে, ফেরেস্তাগণের নিজ ইচ্ছামত কাজ করিবার ক্ষমতা নাই। যদিও বিভিন্ন কাজ করিবার জন্য বিভিন্ন ফেরেস্তা নিযুক্ত আছেন তথাপি তাঁহার আল্লাহর আদেশ ভিন্ন কোন কাজই করিতে পারেন না। বিশ্বর যাবতীয় কার্য নির্বাহের জন্য প্রত্যেক ফেরেস্তাকেই যদি আল্লাহর হুকুম দিতে হয়, তবে তাঁহার ব্যস্ততা কমিল কি?
কথিত হয় যে, অসংখ্য ফেরেস্তার মধ্যে প্রধান ফেরেস্তা চারিজন। যথা – জেব্রাইল, মেকাইল, এস্রাফিল
ও আজ্রাইল। ইহাদের কার্যাবলী সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক।
ক. জেব্রাইল – এই ফেরেস্তা নাকি পয়গম্বরের নিকট খোদাতালার আদেশ পৌঁছাইতেন। হজরত মোহাম্মদ (দ.) দুনিয়ার শেষ পয়গম্বর। তাঁহার বাদে নাকি আর কোন নবী জন্মিবেন না। কাজেই জেব্রাইল ফেরেস্তাও আর দুনিয়ায় আসিবেন না। তবে কেন কেহ কেহ বলেন যে, নির্দিষ্ট কয়েকবার আসিবেন। সে যাহা হউক, জেব্রাইল ফেরেস্তা বর্তমানে কোন কাজ করেন কি?
মনো বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, জেব্রাইল সম্মোহন বিদ্যা (Hyptonism) আয়ত্ত করিতে পারিলে তাহার দুরদুরান্তে অবস্হিত কোন বিশেষ ব্যক্তির সাথে মানসিক ভাবের আদান-প্রদান করা যায়। উহাকে (Telepathy) বলে। সর্বশক্তিমান খোদাতালা এই টেলিপ্যাথির নিয়মে নবীদের সাথে নিজেই কথাবার্তা বলিতে পারিতেন। কিন্তু তাহা না করিয়া তিনি ফেরেস্তা সৃষ্টি করিয়া তাঁহার মারফত নবীদের কাছে আদেশ পাঠাইয়াছেন কেন?
খ. মেকাইল – শোনা যায়, মেকাইল ফেরেস্তা নাকি মানুষের রেজেক বা খাদ্য বন্টন করেন। ‘খাদ্যবন্টন’ বলিতে সাধারণ মানুষের খাদ্যই বোঝায়। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী যথা – পশু, পাখী, কীট-পতঙ্গ ও বিভিন্ন জাতীয় জীবাণুদের খাদ্যবন্টন করেন কে, অর্থাৎ মেকাইল ফেরেস্তা না স্বয়ং খোদাতালা? অন্যান্য প্রাণীদের খাদ্যবন্টন যদি স্বয়ং খোদাতালাই করেন, তবে মানুষের খাদ্যবন্টন তিনি করেন না কেন? আর যদি যাবতীয় জীবের খাদ্যই মেকাইল বন্টন করেন, তবে জগতের অন্য কোন প্রাণীকে নীরোগ দেহে শুধু উপবাসে মরিতে দেখা যায় না, অথচ মানুষ উপবাসে মরে কেন? আর মেকাইল ফেরেস্তা যদি শুধু মানুষের খাদ্যবন্টন করেন তবে মানুষের মধ্যে খাদ্যবন্টনে এতোধিক পার্থক্য কেন? হয়ত কেহ নিয়মিত পক্ষামৃত (দুগ্ধ, দধি, ঘৃত, মধু, চিনি) আহার করেন, অন্যত্র কেহ জলভাতে শুধু লবণ ও লঙ্কাপোড়া পায় না। মেকাইলের এই পক্ষপাতিত্ব কেন?
মেকাইল ফেরেস্তা নাকি বিশ্বপতির আবহাওয়া বিভাগও পরিচালনা করেন। কিন্তু এই বিভাগেও তাঁহার যোগ্যতা বা নিরপেক্ষতার পরিচয় পাওয়া যাইতেছে না। অতীতকালে যাহাই হইয়া থাকুক না কেন, বর্তমানে ব্যাপকভাবেই পৃথিবীতে খাদ্যসংকট দেখা দিয়াছে এবং বিভিন্ন দেশের নেতাগণ তাঁহাদের নিজ নিজ দেশের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত পতিত জমি আবাদ কর্মে মনোযোগ দিয়াছেন। কিন্তু সসীম ক্ষমতার জন্য সকল ক্ষেত্রে কার্যকৃত হইতে পারিতেছেন না। অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন মেকাইল ফেরেস্তার অসাধ্য কিছুই নই। পৃথিবীর উত্তরও দক্ষিণ মেরুদেশের সঙ্গে যদি সাহারা মরুপ্রদেশের তাপ বিনিময় করিয় যথারীতি বৃষ্টিপাত ঘটান যাইত, তাহা হইলে লক্ষ লক্ষ একর জমি চাষাবাদ ও ফসল উৎপাদনের যোগ্য হইত এবং তাহাতে দুনিয়ার খাদ্যসংকট কতকাংশে কমিয়া যাইত। মেকাইল ফেরেস্তা উহা করিতে পারেন কি না? যদি পারেন, তবে উহা তিনি করেন না কেন?
শোনা যায়, আরবদেশ বিশেষত মক্কা শহর নাকি খোদাতালার খুব প্রিয় স্হান। কেননা দুনিয়ার প্রায় যাবতীয় পয়গম্বর আরব দেশেই জন্মিয়াছিলেন এবং শেষ পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদ (দ.) পবিত্র মক্কা শহরে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সেই আরবদেশে বৃষ্টিপাত ও চাষাবাদ নাই বলিলেই চলে। কিন্তু খোদাতালার অপ্রিয় দেশ ভারতবর্ষে বিশেষত আসামের চেরাপুন্জিতে অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয় কেন?
ভারত-বাংলার কথাই ধরা যাক। ‘কাশী’ হিন্দু জাতির একটি তীর্থস্হান ও নানাবিধ দেবদেবীর প্রতিমার জাদুঘর এবং চট্টগ্রামে মুসলিম বারো আওলিয়ার দরগাহ। এই কাশীর উপর না হইয়া চট্টগ্রামের উপর এতোধিক ঝড়-বন্যা হয় কেন? দেখা যায় যে, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে তাপ, বায়ুপ্রবাহ, মেঘ-বৃষ্টির অত্যধিক পরিমাণে বৈষম্য আছে। ইহার কারণ কি ঐ সকল অঞ্চল ও তাহার নিকটবর্তী সাগর-পাহাড়ের ভৌগোলিক অবস্হান, না মেকাইলের পক্ষপাতিত্ব?
গ. এস্রাফিল – এই ফেরেস্তা নাকি শিঙ্গা (বাঁশী) হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। খোদাতালার হুকুমে যখন ঐ শিঙ্গায় ফুঁক দিবেন, তখনই মহাপ্রলয় (কেয়ামত) হইবে এবং পুন: যখন খোদাতালার হুকুমে ফুঁক দিবেন, তখন হাশর ময়দানাদি পুন: সৃষ্টি হইবে।
আদিতে খোদাহালার হুকুমেই যদি বিশ্ব-সৃষ্ট হইতে পারিয়াছিল। কিন্তু তাঁহার হুকুমে ধ্বংস হইতে পারিবে না কেন? যদি পারে, তবে এস্রাফিলের শিঙ্গা ফুঁকিবার আবশ্যক কি? আবার – প্রথমবারে বিশ্বসৃষ্টি খোদাতালার হুকুমে হইতে পারিল, কিন্তু মহাপ্রলয়ের পরে পুন: হাশর ময়দানাদি সৃষ্টির জন্য শিঙ্গার ফুঁক লাগিবে কেন?
শোনা যায় যে, অনন্ত অতীতকাল হইতে এস্রাফিল ফেরেস্তা শিঙ্গা হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন এবং শেষ দিন (কেয়ামত) পর্যন্ত দাঁড়াইয়া থাকিবেন। অথচ এত অধিককাল দাঁড়াইয়া থাকিয় শিঙ্গায় ফুঁক দিবেন মাত্র দুইটি। কেয়ামতের নির্দিষ্ট তারিখটি আল্লাহ জানেন না কি? জানিলে এস্রাফিল ফেরেস্তাকে এতকাল পূর্বে শিক্ষা হাতে দিয়া দাঁড় করিয়া রাখিবার প্রয়োজন কি?
ঘ. আজ্রাইল – যমদূত জীবের জীবন হরণ করেন, এই কথাটি হিন্দুদের বেদে বর্ণিত আছে এবং উহারই ধর্মান্তরে নামান্তর ‘আজ্রাইল ফেরেম্তা’। আজ্রাইল ফেরেম্তা যে মানুষর জীবন হরণ করেন, তাহার পরিষ্কার ব্যাখ্যা শোনা যায ধর্মপ্রচারকদের কাছে। কিন্তু উহাতে মৃত্যু সম্পর্কে অনেক প্রশ্নই অজ্ঞাত থাকিয়া যায়। গরু, ঘোড়া, বাঘ, মহিষাদি, পশু, কাক, শকুনাদী, পাখি, হাঙ্গর-কুমিরাদী জলজ
জীব ও কীট-পতঙ্গাদির জীবণ হরণ করাও কি আজ্রাইলের কাজ? নানাজাতীয় জীবদেহের ভিতরে ও পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এত অধিক ক্ষুদ্র জীবাণু বাস করে যে, তাহার সংখ্যা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
বিশেষত ঐ সকল জীবের পরমায়ুও খুব বেশী নয়, কয়েক মাস হইতে কয়েক ঘন্টা বা মিনিট পর্যন্ত। উহাদের জীবনও কি আজ্রাইল হরণ করেন?
আম, জাম, তাল, নারিকেলাদি উদ্ভিদের জন্ম-মৃত্যু আছে বলিয়া লোকে বহুকাল পূর্ব হইতেই জানিত। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ বলেন যে, শুধু তাহাই নহে, উদ্ভিদের ক্ষুধা, পিপাসা, সুখ-দুঃখ, স্পর্শানুভূতি, এমনকি শ্রবণশক্তিও আছে। বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মহাশয় যন্ত্র দ্বারা প্রমাণ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, গাছের নিকট গান-বাজনা হইলে উহাদের মন প্রফুল্ল হয়। সুতরাং উদ্ভিদ ও অন্যান্য জীবের জীবন-এ কোন পার্থক্য নাই। এই গাছের জীবন হরণ করেন কে? ইহা ভিন্ন অতিক্ষুদ্র এক জাতীয় উদ্ভিদ আছে, উহাকে বীজাণু বলা হয়। ইহারা অতিশয় ক্ষুদ্র বলিয়া খালি চোখে দেখা যায় না। ইহারা বায়ুমন্ডলে ভাসিয়া বেড়ায় এবং উপযুক্ত পরিবেশ পাইলে নানারুপে আত্ম প্রকাশ করে। যেমন শেওলা, বাইছা, ব্যাঙের ছাতা, সিঁধুল ইত্যাদি। ইহাদের জন্ম এবং মৃত্যু আছে। ইহাদের জীবন হরণ করেন কে?
এমন অনেক জাতের জীবাণু বা বীজাণু আছে যাহার জীবদেহে বিশেষত মানুষের দেহে প্রবেশ করিয়া নানাবিধ রোগ সৃষ্টি করে। উহাদের আকার এত ক্ষুদ্র যে, রোগীর দেহের প্রতি ফোঁটা রক্তে লক্ষ লক্ষ জীবাণু ও বীজাণু থাকে এবং যথাযোগ্য ঔষধ প্রয়োগে অল্প সময়ের মধ্যেই উহারা মারা যায়। ইহাদের জীবন হরণ করেন কে?
মানুষ ভিন্ন অন্যান্য যাবতীয় জীবের জীবনে যদি আল্লাহতালার আদেশেই উড়িয়া যায়, তবে মানুষের জন্য যমদূত কেন? আর বিশ্বজীবের যাবতীয জীবন যদি আজ্রাইল একাই হরণ করেন, তবে তাঁহার সময় সংকুলান হয় কিরূপে? আজ্রাইলের কি বংশবৃদ্ধি হয়? অথবা আজ্রাইলের সহকারী (Assistant) আজ্রাইল আছে কি? থাকিলে – তাহার কি এককালীন সৃষ্টি হইয়াছে, না জগতে জীববৃদ্ধির সাথে সাথে নূতন-নূতন আজ্রাইল সৃষ্টি হইতেছে?
সর্বশেষ প্রশ্ন এই যে, যমদূতই যদি জীবনের হরণ করেন, তবে ‘কারণে মরণ’ হয় কেন? অর্থাৎ রোগ, দুর্ঘটনা ইত্যাদি কোন কারণ ব্যতীত জীবের মৃত্যু হয় না কেন?
প্রকাশ আছে যে, আলোচ্য ফেরেস্তা চতুষ্টয় ভিন্ন আরও চারিজন ফেরেস্তা আছেন, যাঁহারা প্রত্যেক মানুষের সহিত সংশ্লিষ্ট। উহারা হইলেন – কোরামান ও কাতেবীন এবং মনকির ও নকিন। উহাদের সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাইতেছে।
ঙ. কোরমান ও কাতেবীন – ধর্মযাজকগণ বলিযা থাকেন যে, মানুষের সৎ ও অসৎ কাজের বিবরণ লিখিয়া রাখিবার জন্য প্রত্যেক মানুষের কাঁধের উপর কোরমান ও কাতেবীন নামক দুইজন ফেরেস্তা বসিয়া আছেন। উহাদের একজন লেখেন সৎকাজের বিবরণ এবং অপরজন অসৎ কাজের বিবরণ। এই ফেরেস্তাদ্বয়ের লিখিত বিবরণ দেখিয়া মানুষের পাপ ও পুণ্যের বিচার হইবে।
মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াই কোন শিশু পাপ-পুণ্যের অধিকারী হয় না। কেননা তখন তাহাদের ন্যায় বা অন্যায়ের কোন জ্ঞান থাকে না। বলা হইয়া থাকে যে, নাবালকত্ব উত্তীর্ন না হওয়া পর্যন্ত কোন মানুষের উপর নামাজ ও রোজা ফরজ হয় না।
মানুষ সাবালক হইবার নির্দিষ্ট কোন তারিখ নাই। শৈশব উত্তীর্ণ হইয়া কৈশোরে পদার্পণ ও কৈশোর পার হইয়া যৌবনে পদাপর্ণ, ইহার কোনটিই একদিনে হয় না। মানুষ সাবালক হইবার বয়স – কেহ বলেন ১২ বৎসর, কেহ বলেন নারীর ১৪ ও পুরুষের ১৮ বৎসর ইত্যাদি। এমতাবস্হায় কেরামান ও কাতেবীন ফেরেস্তাদ্বয় কাঁধে আসেন কোনসময়? শিশু ভূমিষ্ঠ হইবার পরমুহূর্তে না সাবালক হইবার পর? শিশুর জন্মমুহূর্তের পর হইতে আসিলে ফেরেস্তাদের বেশ কয়েক বৎসর কর্মহীন অবস্হায় বসিয়া দিন কাটাইতে হয়। পক্ষান্তরে মানুষ সাবালক হইবার সুনির্দিষ্ট কোন তারিখ নাই। ঐ বিষয়ে ঈশ্বরানুমোদিত সার্বজনীন কোন তারিখ আছে কি?
শোনা যায় যে, ফেরেস্তারা নাশাক ও দুর্গন্ধময় স্হানে থাকেন না বা উহা পছন্দ করেন না। তাই ফেরেস্তাদের মনোরন্জনের জন্য কেহ কেহ পাক সাফ থাকেন ও খোশবু ব্যবহার করেন। ধর্মীয় মতে অমুসলমান মাত্রই নাপাক। যেহেতু উহারা যথারীতি ওজু গোসল করে না, হারাম দ্রব্য ভক্ষণ করে, এমনকি কেহ কেহ মলত্যাগ করিয়া জলশৌচও কর না। আবার ডোম, মেথর ইত্যাদি অস্পৃশ্য জাতি নাপাক ও দুর্গন্ধেই ডুবিয়া থাকে। উহাদের কাঁধে ফেরেস্তা থাকেন কি না?
যে কোন মানুষের মৃত্যুর পর তাহার কাঁধের ফেরেস্তাদের কার্যকাল শেষ হইয়া যা। অতঃপর তাঁহারা কি করেন? অর্থাৎ, কোন ঊর্ধ্বতন ফেরেস্তা বা আল্লাহতালার নিকট তাঁহার নথিপত্র বুঝাইয়া দিয়া অবসর জীবন যাপন করেন, না নিজ জিম্মায় কাগজপত্র রাখিয়া উহার হেফাজতে দিন কাটান, না অন্য কোন মানুষের কাঁধে বসিয়া কাজ শুরু করেন?
শোনা যায় যে, ফেরেস্তাদের নির্দিষ্ট সংখ্যা নাই এবং থাকিলেও তাহা আল্লাহ ব্যতীত আর কেহ জানে না। উহাদের মধ্য হইতে শুধুমাত্র কেরামন ও কাতেবীন ফেরেস্তাদ্বয় ব্যতীত আর কোন ফেরেস্তার সহিত মানুষের ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা নাই। বাকিদের মধ্যে মাত্র আজ্রাইল ফেরেস্তা কাছে আসেন একদিন, তাহা অন্তিমকালে এবং মনকির ও নকির ফেরেস্তাদ্বয় মানুষের চির সহচর। হাঁটিতে, বসিতে, ভোজনে, শয়নে সবসময়ই উহারা মানুষের পার্শ্বচর। বিশেষত উহাদের অবস্হান মানুষের চক্ষু ও কর্ণ হইতে চারি-পাঁচ ইঞ্চির বেশী দূরে নয়। অথচ মানুষ উহাদের গতিবিধি দেখিতে, শুনিতে, অথবা অস্তিত্বকেই অনুভব করিতে পারে না। ইহার কারণ কি?
মানুষের কার্যবিবরণী ফেরেস্তাগণ যে ভাষাতেই লিখুন না কেন, উহাতে কালি, কলম ও কাগজ বা অনুরূপ অন্য কিছু আবশ্যক। আলোচ্য বিবরণগুলি যদি বাস্তব হয়, তবে উহা লিখিবার উপকরণও হওয়া উচিত পার্থিব। অথচ মানুষ উহার কোন কিছুরই সন্ধান পায় না। উহার বাস্তবতার কোন প্রমাণ আছে কি? যদি না থাকে, তাহা হইলে – যখন ফেরেস্তারা অদৃশ্য, কালি অদৃশ্য, কলম এবং কাগজও অদৃশ্য, তখন বিবরণগুলি ঐরূপ নয় কি?
চ. মনকির ও নকির – কথিত হয় যে, মানুষ কবরস্হ হইবার কিছুক্ষণ পরই ‘মনকির’ ও ‘নকির’
নামক দুইজন ফেরেস্তা আসিযা মৃতকে পুনর্জীবিত করেন ও তাহাকে ধর্ম-বিষয়ে কতিপয় প্রশ্ন করেন। সদুত্তর দিতে পারিলে তাহার সুখের অবধি থাকে না। কিন্তু তাহা না পারিলে তাহার উপর হয় নানারূপ শাস্তি। গুজের (গদার) আঘাতে ৭০ গজ মাটির নীচে প্রৌথিত হয়ে যায়, আবার ঐ ফেরেস্তার নখর দ্বারা তুলিয়া তাহাকে পুনরাঘাত করিতে থাকেন এবং সুড়ঙ্গপথে দোজখের আগুন আসিয়া পাপাত্মা মৃতকে জ্বালাইতে থাকে ইত্যাদি।
কোন বিশেষ কারণ না থাকিলে সচরাচর মৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যেই কবরস্হ করা যায়। ঐ সময়ের মধ্যে মৃতদেহের মেদ, মজ্জা ও মাংসাদির বিশেষ কোন বিকৃতি ঘটে না। এই সময়ের মধ্যেই যদি সে পুনর্জীবন লাভ করিয়া সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়, তবে তাহার সেই নবজীবন হয় বিগত জীবনের অনুরূপ। কেননা দেখা যায় যে, সর্পঘাত, উগ্র মাদকদ্রব্য সেবন, ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ, কতিপয় রোগ, গভীর নিদ্রা ইত্যাদিতে মানুষের সংজ্ঞালোপ ঘটে। এইরূপ সংজ্ঞাহীনতা কয়েক ঘন্টা হইতে কয়েক দিন, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে সপ্তাহকাল স্হায়ী হইতে দেখা যায়। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই সংজ্ঞাপ্রাপ্তির পর কাহারো পূর্বস্মৃতি লোপ পাইতে দেখা বা শোনা যায় নাই। কেননা মগজস্হিত কোষসমূহে (Cell) বিকৃতি না ঘটিলে কোন মানুষের স্মৃতি বা জ্ঞানের ভাবান্তর ঘটে না। তাই কাহারো ভাষারও পরিবর্তন ঘটে না।
হৃৎপিন্ড, ফুসফুস ও মস্তিষ্ক – দেহের এই তিনটি যন্ত্রের সুষ্ঠু ক্রিয়ার যৌথ ফলই হইল জীবনীশক্তি।
উহার যে কোন একটা বা দুইটির ক্রিয়া সাময়িক লোপ পাওয়াকে ‘রোগ’ বলা হয়। কিন্তু ঐ তিনটির ক্রিয়া একযোগে লোপ পাওয়াকে বলা হয় মৃত্যু। শরীর বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, উক্ত যন্ত্রত্রয়ের একটি বা দুইটি নিষ্ক্রিয় (মৃত্যু) হইলে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত তাহাও সক্রিয় করা সম্ভব হইবে। তাহাই যদি হয়, তবে কোন মৃত বাঙ্গালী পুনর্জীবিত হইলে সে কি ফরাসী ভাষায় কথা বলিবে, না, বাংলা ভাষায়?
পৃথিবীতে প্রায় ৩৪২৪টি বোধগম্য ভাষা আছে এবং অধিকাংশ মানুষই মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষা জানে না। কাজেই কোন মৃতকে পুনর্জীবিত করা হইলে, অধিকাংশই তাহার মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোন ভাষায় কথা বলিবার বা বুঝিবার সম্ভাবনা নাই। এমতাবস্হায় মনকিন ও নকির ফেরেস্তাদ্বয় মৃতকে প্রশ্ন করেন কোন ভাষায় – ফেরেস্তী ভাষায়, না মৃতের মাতৃভাষায়?
কেহ কেহ বলেন যে, হাশর ময়দানাদি পরলৌকিক জগতের আন্তর্জাতিক ভাষা হইবে আরবী, বোধহয় ফেরেস্তাদেরও। হাশর, ময়দানাদি পরজগতেও যদি পার্থিব দেহধারী মানুষ সৃষ্টি হয়, তবে তাহা হইবে এক অভিনব দেহ। কাজেই তাহাদের অভিনব ভাষার অধিকারী হওয়াও অসম্ভব নহে। কিন্তু মৃতের কবরস্হ দেহ অভিনব নয়, উহা ভূতপূর্ব। এক্ষেত্রে সে অভিনব (ফেরেস্তী বা আরবী) ভাষা বুঝিতে বা বলিতে পারে কিভাবে?
পক্ষান্তরে, যদি ফেরেস্তারা আঞ্চলিক ভাষায়ই প্রশ্ন করেন, তাহা হইলে ভিন্ন ভিন্ন ৩৬২৪ টি ভাষাভাষী ফেরেস্তা আবশ্যক। বাস্তবিক কি তাহাই?
ধর্মীয় বিবরণ মতে, পরলৌকিক ঘটনাবলীর প্রায় সমস্তই মানুষের পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার বাহিরে। কিন্তু ‘গোর আজাব’ – এই ঘটনাটি যদিও পরলোকের অন্তর্ভূক্ত, তথাপি উহার অবস্হান ইহলোকে অর্থাৎ এই পৃথিবীতেই। বিশেষত উহা মানুষের অবস্হান হইতে বেশী দূরেও নয়। বড় বড় শহরের গোরস্হানগুলি ছাড়া গ্রামাঞ্চলের কবরগুলি প্রায়ই থাকে বাসস্হানের কাছাকাছি এবং উহার গভীরতাও বেশী নয়, মাত্র ফুট তিনেকের মত। ওখানে বসিয়া ফেরেস্হা ও পুনর্জীবিত ব্যক্তির মধ্যে যে সকল কথাবার্তা, মারধোর, কান্নাকাটি ইত্যাদি কাহিনী হয়, অতি নিকটবর্তী মানুষও তাহা আদৌ শুনিতে পায় না কেন?
দেখা যাইতেছে যে, হত্যা সম্পর্কিত মামলাদিতে কোন কোন ক্ষেত্রে মৃতকে কবর দেওয়ার তিন-চারদিন বা সপ্তাহকাল পরে কবর হইতে তুলিয়া নেওয়া হয় এবং উহা অভিজ্ঞ ডাক্তারগণ পরীক্ষা করিয়া থাকেন। কিন্তু যত বড় দুর্দান্ত ব্যক্তির লাশই হউক না কেন, কোন ডাক্তার উহার গায়ে গুর্জের আঘাতের দাগ বা আগুনে পোড়ার চিহ্ন পান নাই। অধিকন্তু খুব লক্ষ্য করিয়া দেখা গিয়েছে যে, মুর্দাকে যেইভাবে কবরে রাখা হয়েছিল, সেইভাবেই আছে, একচুলও নড়চড় হয় নাই। বিশেষত কবরের নিম্নদিকে ৭০ গজ গর্ত বা কোন পার্শ্বে (দোজখের সঙ্গে) সুড়ঙ্গ নাই। ইহার কারণ কি? গোর আজাবের কাহিনীগুলি কি বাস্তব, না অলীক?
এ কথা সত্য যে, কোন মানুষকে বধ করার চেয়ে প্রহার করা সহজ এবং সবল ব্যক্তির চাইতে দূর্বল ব্যক্তি বধ করা সহজ। রেল, জাহাজ, বিমান ইত্যাদির আকস্মিক দুর্ঘটনায় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এক মুহূর্তে শত শত সুস্হ ও সবল মানুষ বধ করেন আজ্রাইল ফেরেস্তা একা। আর রুগ্ন, দুর্বল ও অনাহারক্লিষ্ট মাত্র একজন মানুষকে শুধু প্রহার করিবার জন্য দুইজন ফেরেস্তা কেন? পক্ষান্তরে শুধুমাত্র মৃতকে প্রশ্ন করিবার জন্য দুইজন ফেরেস্তার আবশ্যিকতা কিছু আছে কি?
জেব্রাইল, মেকাইল, এস্রাফিল ইত্যাদি নামগুলি উহাদের ব্যক্তিগত নাম (Proper Noun) । কিন্তু কেরামন, কাতেবিন, মনকির ও নকির – এই নামগুলি উহাদের ব্যক্তিগত নাম নয়, সম্প্রদায় বা শ্রেণীগত নাম (Common Noun) । বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ জীবিত আছে।* তাহা হইলে সমস্ত মানুষের কাঁধে কেরামন আছে ৩০০ কোটি এবং কাতেবীন ৩০০ কোটি, জানিনা মনকির ও
নকির ফেরেস্তাদ্বয়ের সংখ্যাও ঐরূপ কিনা। সে যাহা হউক, উহাদের ব্যক্তিগত কোন নাম আছে কি? না থাকিলে উহাদের কোন বিশেষ ফেরেস্তাকে আল্লাহ তলব দেন কি প্রকারে?
১০. দূরত্বহীন যাতায়াত কি সম্ভব?
শোনা যায় যে, স্বর্গীয় দূত জেব্রাইল আল্লাহর আদেশ মত নবীদের নিকট অহি (বাণী) লইয়া আসিতেন এবং তাহা নাজেল (অর্পণ) করিয়া চলিয়া যাইতেন। আসা ও যাওয়া – এই শব্দ দুইটি গতিবাচক এবং গতির আদি ও অন্তের মধ্যে দূরত্ব থাকিতে বাধ্য। আল্লাহতালা নিশ্চয়ই নবীদের হইতে দূরে ছিলেন না। তবে কি জেব্রাইলের আসা ও যাওয়া দূরত্বহীন? আর দূরত্ব থাকিলে তাহার পরিমাণ কত (মাইল)?
১১. মেয়ারাজ কি সত্য, না স্বপ্ন?
শোনা যায় যে, হজরত মোহাম্মদ (দ.) রাত্রিকালে আল্লাহর প্রেরিত বোরাক নামক এক আশ্চর্য জানোয়ারে আরোহণ করিয়া আকাশভ্রমণে গিয়াছিলেন। ঐ ভ্রমণকে মেয়ারাজ বলা হয়। তিনি নাকি কোটি কোটি বৎসরের পথ অতিক্রম করিয়া আরশে পৌঁছিয়া আল্লাহর সহিত কথোপকথন করিয়াছিলেন এবং আল্লাহ তাঁহাকে ইসলামের দুইটি মহারত্ন নামাজ ও রোজা উপহার দিয়াছিলেন। ঐ রাত্রে তিনি বেহেস্ত-দোজখাদিও পরিদর্শন করিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন। ইহাতে নাকি তাঁহার সময় লাগিয়াছিল কয়েক মিনিট মাত্র।
কথিত হয় যে, মেয়ারাজ গমনে হজরত (দ.)-এর বাহন ছিল – প্রথম পর্বে বোরাক ও দ্বিতীয় পর্বে রফরফ। উহারা এরূপ দুইটি বিশেষ জানোয়ার, যাহার দ্বিতীয়টি জগতে নাই। বোরাক – পশু, পাখী ও মানব এই তিন জাতীয় প্রাণীর মিশ্ররুপের জানোয়ার। অর্থাৎ তাহার ঘোড়ার দেহ, পাখীর মত পাখা এবং রমণীসদৃশ মুখমন্ডল। বোরাক কোন দেশ হইতে আসিয়াছিল, ভ্রমণান্তে কোথায় গেল, বর্তমানে কোথায়ও আছে, না মারা গিয়াছে, থাকিলে – উহার দ্বারা এখন কি কাজ করান হয়, তাহার কোন হদিস নাই। বিশেষত একমাত্র শবে মেয়ারাজ ছাড়া জগতে আর কোথাও ঐ নামটিরই অস্তিত্ব নাই। জানোয়ারটি কি বাস্তব না স্বপ্নিক?
হাজার হাজার বৎসরের পুরাতন স্হাপত্যশিল্পের নিদর্শন পৃথিবীতে অনেক আছে। খৃ.পূ. তিন হাজার বৎসরেরও অধিককাল পূর্বে নির্মিত মিশরের পিরামিডসমুহ আজও অক্ষত দেহে দাঁড়াইয়া আছে। হজরতের মেয়ারাজ গমন খুব বেশীদিনে কথা নয়, মাত্র খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা। ঘটনাটি বাস্তব হইলে – যে সকল দৃশ্য তিনি মহাশূণ্যে স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন (আরশ ও বেহেস্ত-দোজখাদি), তাহা আজও সেখানে বর্তমান থাকা উচিত। কিন্তু আছে কি? থাকিলে তাহা আকাশ-বিজ্ঞানীদের দূরবীনে ধরা পড়ে না কেন?
মেয়ারাজ সম্বন্ধে পর্যালোচনা করিতে হইলে প্রথম জানা আবশ্যক যে, হজরত (দ.) –এর মেয়ারাজ গমন কি পার্থিব না আধ্যাত্মিক; অর্থাৎ দৈহিক না মানসিক। যদি বলা হয় যে, উহা দৈহিক, তবে প্রশ্ন আসে – উহা সম্ভব হইল কিভাবে?
* মূল পান্ডুলিপির রচনাকাল ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ।
আকাশবিজ্ঞানীদের মতে – সূর্য ও গ্রহ-উপগ্রহরা যে পরিমাণ স্হান জুড়িয়া আছে, তাহার নাম সৌরজগত, সূর্য ও কোটি কোটি নক্ষত্র মিলিয়া যে পরিমাণ স্হান জুড়িয়া আছে তাহান নাম নক্ষত্রজগত বা নীহারিকা এবং কোটি কোটি নক্ষত্রজগত বা নীহারিকা মিলিয়া যে স্হান দখল করিয়া আছে, তাহার নাম নীহারিকাজগত।
বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, বিশ্বের যাবতীয় গতিশীল পদার্থের মধ্যে বিদ্যুৎ ও আলোর গতি সর্বাধিক। উহার সমতুল্য গতিবিশিষ্ট আর জগতে নাই। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৮৬ হাজার মাইল। আলো এই বেগে চলিয়া এক বৎসরে যতটুকু পথ অতিক্রম করিতে পারে, বিজ্ঞানীগণ তাহাকে বলেন এক আলোক বৎসর।
বিশ্বের দরবারে আমাদের এই পৃথিবী খুবই নগণ্য এবং সৌরজগতটিও নেহায়েত ছোট জায়গা। তথাপি এই সৌরজগতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তে আলোক পৌঁছিতে সময় লাগে প্রায় ১১ ঘন্টা। অনুরূপভাবে, নক্ষত্রজগতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তের দূরত্ব প্রায় ৪০০০ কোটি আলোক বৎসর।১১ এই যে বিশাল স্হান, ইহাই আধুনিক বিজ্ঞানীদের পরিচিত দৃশ্যমান বিশ্ব। এই বিশ্বের ভিতরে বিজ্ঞানীরা বেহেস্ত, দোজখ বা আরশের সন্ধান পান নাই। হয়ত থাকিতে পারে ইহার বহির্ভাগে, অনন্ত দূরে। হজরত (দ.)-এর মেয়ারাজ গমন যদি বাস্তব হয়, অর্থাৎ তিনি যদি সশরীরে একটি বাস্তব জানোয়ারে আরোহণ করিয়া সেই অনন্তদূরে যাইয়া থাকেন, তবে কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে আলোচ্য দূরত্ব অতিক্রম করা কিভাবে সম্ভব হইল? বোরাকে গতি সেকেন্ড কত মাইল ছিল?
বোরাকের নাকি পাখাও ছিল। তাই মনে হয় যে, সেও আকাশে (শূণ্যে) উড়িয়া গিয়াছিল। শূণ্যে উড়িতে হইলে বায়ু আবশ্যক। যেখানে বায়ু নাই, সেখানে কোন পাখী বা ব্যোমযান চলিতে পারে না। বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, প্রায় ১২০ মাইলের উপরে বায়ুর অস্তিত্ব নাই।১২ তাই তাঁহারা সেখানে কোনরুপে বিমান চালাইতে পারেন না, চালাইয়া থাকেন রকেট। বায়ুহীন মহাশূণ্যে বোরাক উড়িয়াছিল কিভাবে?
নানা বিষয় পর্যালোচন করিলে মনে হয় যে, হজরত (দ.)-এর মেয়ারাজ গমন (আকাশভ্রমণ) সশরীরে বা বাস্তবে সম্ভব নহে। তবে কি উহা আধ্যাত্মিক বা স্বপ্ন?
এ কথায় প্রায় সকল ধর্মই একমত যে, ‘সৃষ্টিকর্তা সর্বত্র বিরাজিত’। তাহাই যদি হয়, তবে তাঁহার সান্নিধ্যলাভের জন্য দূরে যাইতে হইবে কেন? আল্লাহতালা ঐ সময় কি হজরত (দ.)-এর অন্তরে বা তাঁহার গৃহে, মক্কা শহরে অথবা পৃথিবীতেই ছিলেন না?
পবিত্র কোরানে আল্লাহ বলিয়াছেন – “তোমরা যেখানে থাক, তিনি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন।” (সুরা হাদিদ – ৪) । মেয়ারাজ সত্য হইলে এই আয়াতের সহিত তাহার কোন সঙ্গতি থাকে কি?
১২. কতগুলি খাদ্য হারাম হইল কেন?
বিভিন্ন ধর্মমতে কোন কোন খাদ্য নিষিদ্ধ এবং কোন কোন দ্রব্য স্বাস্হ্য রক্ষার প্রতিকূল বলিয়া স্বাস্হ্যবিজ্ঞানমতেও ভক্ষণ নিষিদ্ধ। যে সকল দ্রব্য ভক্ষণে স্বাস্হ্যহানি ঘটিতে পারে, তাহা নিষিদ্ধ হইলে বুঝা যায় যে, কেন উহা নিষিদ্ধ হইল। কিন্তু যে খাদ্য ভক্ষণে স্বাস্হ্যহানির আশঙ্কা নাই, এমন খাদ্য নিষিদ্ধ (হারাম) হইল কেন?
১৩. এক নেকী কতটুকু?
স্হান, কাল, বস্তু ও বিভিন্ন শক্তি পরিমাপের বিভিন্ন মাপকাটি বা বাটখারা আছে। যথা – স্হান বা দূরত্বের মাপকাটি গজ, ফুট, ইঞ্চি, মিটার ইত্যাদি; সময় পরিমাপের ইউনিট ঘন্টা, মিনিট ইত্যাদি; ওজন পরিমাপের মণ, সের; বস্তু পরিমাপে গন্ডা, কাহন; তাপ পরিমাপে ডিগ্রি; আলো পরিমাপে ক্যান্ডেল পাওয়ার; বিদ্যুৎ পরিমাপে ভোল্ট, অ্যাম্পিয়ার ইত্যাদির ব্যবহার হয়। অর্থাৎ কোন কিছু পরিমাপ করিতে হইলেই একটি ইউনিট বা একক থাকা আবশ্যক। অন্যথায় পরিমাপ করাই অসম্ভব।
কোন কোন ধর্মপ্রচারক বলিয়া থাকেন যে, অমুক কাজে ‘দশ নেকী’ বা অমুক কাজে ‘সত্তর নেকী’ পাওয়া যাইবে। এ স্হলে ‘এক নেকী’-এর পরিমাণ কতটুকু এবং পরিমাপের মাপকাটি কি?
১৪. পাপের কি ওজন আছে?
মানুষের মনের সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, ঘৃণা, স্নেহ, হিংসা, দ্বেষ, অহঙ্কার ইত্যাদি কোন পদার্থ নহে, ইহারা মনের বিভিন্ন বৃত্তি মাত্র। ব্যক্তিভেদে এসবের তারতম্য লক্ষিত হয়। কাজেই বলিতে হয় যে, ইহাদেরও পরিমাণ আছে। কিন্তু পরিমাপক যন্ত্র নাই। কারণ ইহারা পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না।
যাহা কিছু পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতার বাহিরে, সেই সমস্ত তৌলযন্ত্র বা নিক্তি দ্বারা মাপিবার চেষ্টা বৃথা।
মনুষ্যকৃত ‘ন্যায়’ ও ‘অন্যায়’ আছে এবং ইহারও তারতম্য আছে। কাজেই ইহারও পরিমাণ আছে। কিন্তু উহা পরিমাপ করিবার মত কোন যন্ত্র অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই।
‘অন্যায়’-এর পরিমাপক কোন যন্ত্র না থাকিলেও বিচারপতিগণ অন্যায়ের পরিমাণ নির্ধারণকরত অন্যায়কারীকে যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান করিয়া থাকেন। এ ক্ষেত্রে বিচারকগণ নান প্রকার সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণপূর্বক অন্যায়ের পরিমাণ নির্ধারণ করেন, কোনরূপ যন্ত্র ব্যবহার না বা করিতে পারেন না।
কঠিন ও তরল পদার্থ ওজন করিবার জন্য নানা প্রকার তৌলযন্ত্র ও বাটখারা আছে। বর্তমান যুগে তৌলযন্ত্রের অভাবনীয় উন্নতি হইয়াছে। লন্ডন শহরের বৃটিশ ব্যাঙ্কে একটি তৌলযন্ত্র আছে। যদ্বারা (?? আমার বইয়ে পরিষ্কার নয়) নাকি একবারে একশত আশি মণ সোনা, রুপা বা অনুরূপ অন্যান্য দ্রব্যাদি ওজনে উহার কাঁটা দশ ইঞ্চি হেলিয়া পড়ে। তৌলযন্ত্রের এরূপ উন্নতি হইলেও – তাপ, আলো, কাল, দুরত্ব, বিদ্যুৎ ইত্যাদি উহা দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। যেহেতু ইহারা পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। পূর্বেই বলিয়াছি যে, যাহা কিছু পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতার বাহিরে, তাহা তৌলযন্ত্র বা নিক্তি মাপিবার চেষ্টা বৃথা।
‘অন্যায়’-এর নামান্তর পাপ বা অন্যায় হইতেই পাপের উৎপত্তি। সে যাহা হউক, কোনরূপ তৌলযন্ত্র বা নিক্তি ব্যবহার করিয়া পাপের পরিমাণ ঠিক করা যা কিরূপে?
১৫. ইসলামের সাথে পৌত্তলিকতার সাদৃশ্য কেন?
আমরা শুনিয়া থাকি যে, সুসংস্কৃত ইসলামে কুসংস্কারের স্হান নাই। বিশেষত নিরাকার-উপাসক হইতে সাকার-উপাসকগণই অত্যধিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। যদিও বেদ বিশেষভাবে পুতুল-পূজা শিক্ষা দেয় নাই, তথাপি পরবর্তীকালে পুরাণের শিক্ষার ফলে বৈদিক ধর্ম ঘোর পৌত্তলিকতায় পূর্ণ হইয়াছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বৈদিক বা পৌত্তলিক ধর্মের সহিত ইসলাম ধর্মের অনেক সাদৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়, যাহার ভাষা ও রূপগত পার্থক্য থাকিলেও ভাবগত পার্থক্য নাই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় বাদ দিলেও নিম্নলিখিত বিষয়সমূহে উভয়ত সাদৃশ্য দেখা যায়। যথা –
১. ঈশ্বর এক – একমেবাদ্বিতীয়ম (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)।
২. বিশ্ব-জীবের আত্মাসমূহ এক সময়ের সৃষ্টি।
৩, মরণান্তে পরকাল এবং ইহকালের কর্মফল পরকালে ভোগ।
৪. পরকালের দুইটি বিভাগ – স্বর্গ ও নরক (বেহেস্ত-দোজখ)।
৫. স্বর্গ সাত ভাগে এবং নরক সাত ভাগে বিভক্ত। (কেহ কেহ বলেন যে, ইহা ভিন্ন আর একটি স্বর্গ আছে, উহা বাদশাহ শাদ্দাদের তৈয়ারী।)
৬. স্বর্গ বাগানময় এবং নরক অগ্নিময়।
৭. স্বর্গ উর্ধদিকে অবস্হিত।
৮. পুণ্যবানদের স্বর্গপ্রাপ্তি এবং পাপীদের নরকবাস।
৯. যমদূত (আজ্রাইর ফেরেস্তা) কর্তৃক মানুষের জীবন হরণ।
১০. ভগবানের স্হায়ী আবাস ‘সিংহাসন’ (আরশ) ।
১১. স্তব-স্তুতিতে ভগবান সন্তুষ্ট।
১২. মন্ত্র (কেরাত) দ্বারা উপাসনা করা।
১৩. মানুষ জাতির আদি পিতা একজন মানুষ – মনু (আদম) ।
১৪. নরবলি হইতে পশুবলির প্রথা প্রচলন।
১৫. বলিদানে পুণ্যলাভ (কোরবানি) ।
১৬. ঈশ্বরের নাম উপবাসে পুণ্যলাভ (রোজা) ।
১৭. তীর্থভ্রমণে পাপের ক্ষয় – কাশী-গয়া (মক্কা-মদিনা) ।
১৮. ঈশ্বরের দূত আছে (ফেরেস্তা) ।
১৯. জানু পাতিয়া উপাসনায় বসা।
২০. সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত (সেজদা) ।
২১. করজোড়ে প্রার্থনা (মোনাজাত) ।
২২. নিত্যউপাসনার নির্দিষ্ট স্হান – মন্দির (মসজিদ) ।
২৩. মালা জপ (তসবিহ্ পাঠ) ।
২৪. নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনা করা – ত্রিসন্ধা (পাঁচ ওয়াক্ত) ।
২৫. ধর্মগ্রন্হপাঠে পুণ্যলাভ।
২৬. কার্যারম্ভে ঈশ্বরের নামোচ্চরণ – নারায়ণং নমস্কৃত্যং নরঞ্চৈব নরোত্তমম (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম) ।
২৭. গুরুর নিকট দীক্ষা (তাওয়াজ্জ) ।
২৮. স্বর্গে গণিকা আছে – গন্ধর্ব, কিন্নরী, অপ্সরা (হুর-গেলমান) ।
২৯. উপাসনার পুর্বে অঙ্গ ধৌত রা (অজু) ।
৩০. দিগনির্ণয়পূর্বক উপাসনায় বসা বা দাঁড়ান।
৩১. পাপ-পুণ্য পরিমাপে তৌলযন্ত্র ব্যবহার (মিজান) ।
৩২. স্বর্গস্বামীদের নদী পার হওয়া – বৈতরণী (পুলছিরাত) ইত্যাদি।
ঐ সমস্ত ছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিধি-নিষেধেও অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়। যথা – মিথ্যা বলিবে না, চুরি করিবে না, মাতা-পিতার সেবা করিবে ইত্যাদি।
উপরোক্ত যে সকল বিষয়ে উভয়ত সাদৃশ্য দেখা যায়, সে সকল বিষয়ে চিন্তা করিলে ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, হয়ত ইসলাম হইতে বিষয়গুলি পৌত্তলিকগণ গ্রহণ করিয়াছেন, নচেৎ পৌত্তলিকদের নিকট হইতে ইসলাম উহা গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু ইহা নিশ্চিত যে, পূর্ববর্তীগণের নিকট হইতে পরবর্তীগণ গ্রহণ করিয়াছে। পরবর্তী কাহারা?
১৬। আরবের বৈশিষ্ট্য কি?
ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক গঠন ভেদে বিভিন্ন দেশের মাটি, জল, বায়ু ও তাপের পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য হেতু-উষ্ণমণ্ডল নাতিশীতোষ্ণ মন্ডল ও হিমমন্ডলের জীবজন্তু ও গাছপালার আকৃতি ও প্রকৃতিতে বিশেষ পার্থক্য লক্ষিত হয়। এই জন্য-পর্বত, মরুভূমি, সমভূমি ও প্রকৃতিতে ও মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহের বাসিন্দাদের আকৃতি ও প্রকৃতি একরূপ হয় না। এমন কি একই ফলের দুইটি বীজ দুই দেশে রোপিত হইলে উভয় দেশের উৎপন্ন ফলের স্বাদ এক রকম হয় না। কিন্তু ইহা যে প্রকৃতির নিয়ম মতই হইতেছে, তাহা বেশ বুঝা যায়। ইহাও বুঝা যায় যে, কেন সাহারা মরু অঞ্চলে আদৌ বৃষ্টি না হইয়া আসামের চেরা পূঞ্জিতে এত অধিক বৃষ্টিপাত হয়।
পণ্ডিতগণ বলিয়া থাকেন যে, কোন দেশের উপর বৃষ্টিবর্ষণ নির্ভর করে তথাকার পর্বত ও সমুদ্রের অবস্থানের উপর। কিন্তু কোন দেশের উপর খোদাতা’লার “রহমত বর্ষণ” নির্ভর করে কিসের উপর? সকল দেশের উপর কি আল্লাহতা’লার রহমত সমান মাপে বর্ষিত হইয়া থাকে? যদি তাহাই হয়, তবে লক্ষাধিক পয়গম্বর প্রায় সবই আরব দেশেই জন্মিলেন কেন? সে যুগের আরব দেশের আবহাওয়া, উচ্চতা, মাটির উপাদান, ভৌগোলিক অবস্থান ও পাহাড় পর্বত ইত্যাদির অনুরূপ কি কোন দেশই পৃথিবীতে ছিল না?
হয়ত কেহ বলিতে পারেন যে, পয়গম্বরী জিনিষটা প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection) নহে। সাধারণতঃ কোন দেশ যখন অন্যায়, অত্যাচার, কদাচার, নীতিগর্হিত কাজ ইত্যাদি ঈশ্বরবিরোধিতার পাপে ভরপুর হইয়া উঠিত, তখন সেই সকল দেশের পাপ পঙ্ক দূর করিয়া ইহা পরকালের শান্তি স্থাপনের জন্য আল্লাহতা’লা ঐ দেশে এক একজন লোককে পয়গম্বরী প্রদান করিতেন।
উপরোক্ত মত সত্য হইলে- যে সকল দেশে একেশ্বরবাদের পরিবর্তে বহু দেব-দেবীর উপাসনা প্রচলিত ছিল এবং যে সকল দেশের আচার, ব্যবহার, চালচলন ও খাদ্যাদি নিতান্ত জঘন্য আকারে ছিল, সেই সকল পাপপূর্ণ দেশে কোন পয়গম্বর না হওয়ার কারণ কি? বিশেষতঃ চিরপৌত্তলিকতার দেশ ভারতবর্ষে একজন নবীও জন্মিলেন না কেন? ভারতের গুণাগার বান্দাদের জন্য কি আল্লাহর দরদ কম?
প্রসঙ্গত এখানে আর একটি বিষয় আলোচনা করা যাইতে পারে। শোনা যায় যে নবীদের সংখ্যা নাকি এক লক্ষ, চব্বিশ হাজার। উহাদের মধ্যে এক লক্ষ, তেইশ হাজার নয় শত আটানব্বইজন নবীই জন্মিয়াছিলেন হজরত ইসা নবী জন্মিবার আগে; অর্থাৎ ৪০০৪ বৎসরের মধ্যে (বাইবেলে বিবরণ মতে হজরত আদশ হইতে হজরত ঈসার জন্ম পর্যন্ত সময় ৪০০৪ বৎসর) (১৩)। তাহা হইলে ওদেশে ঐ সময়ে প্রতি বৎসর গড়ে নবী জন্মিয়াছিলেন প্রায় ৩১ জন! আর উহা অসম্ভবও নহে কেননা নবীদের বিবরণে জানা যায় যে হয়ত কোন নবীর বাবা, দাদা এবং পুত্র-পৌত্রাদিও নবী ছিলেন। আবার কখনও ভাইয়ে ভাইয়ে এবং শ্বশুর-জামাতাও নবীত্ব পাইয়াছিলেন। কিন্তু হজরত ঈসা নবী জন্মিবার পর নবীদের জন্মহার কমিয়া ৫৭০ বৎসরে জন্মিলেন মাত্র একজন, অতঃপর কেয়ামত পর্যন্ত নাকি একেবারেই বন্ধ।
নবীদের আবির্ভাব হ্রাস বা বন্ধ হওয়ার কারণ সম্বন্ধে চিন্তা করিলে এইরূপ মনে হয় যে, হয়ত পাপীর সংখ্যা বা পাপের পরিমাণ আগের চেয়ে হ্রাস পাইয়াছে, নতুবা এ যুগের পাপীদের উপর বীতস্পৃহ হইয়া আল্লাহ তাঁর হেদায়েত বন্ধ করিয়াছেন; অথবা-সভ্যতা ও জ্ঞান বৃদ্ধি হেতু “বাস্তববাদ” এর আবির্ভাবের ফলে “ভাববাদ” এর অবসান ও ভাববাদীর তিরোধান ঘটিয়াছে। ইহার মধ্যে -এ যুগে কোন নবী না হওয়ার আসল কারণ কোনটি?
হিন্দুগণ বলিয়া থাকেন যে, পৃথিবী যখন নানারূপ পাপভারে ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিত, তখন পৃথিবীর পাপভার লাঘব কবিরার জন্য স্বর্গবাসী দেবগণ সময় সময় মর্তে অবতীর্ণ হইতেন। এইভাবে একা বিষ্ণুই-মৎস্য, কুর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রামচন্দ্র, বুদ্ধ ও কল্কি; এই দশরূপে ধরায় অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। ইহারা হিন্দুদের মতে-পথভ্রষ্ঠ মানবের পথ প্রদর্শক ঐশ্বরিক বাণী বাহক। মুসলমানদের যেমন “পয়গম্বর” তেমন হিন্দুদের মতে দেবগণের এক একটি ‘অবতরণ’। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অবতার সমূহের একটিও ভারতবর্ষের বাহিরে-চীনে বা জাপানে হয় নাই।
উপরোক্ত বিবরণগুলি কি শাস্ত্রকারদের দেশপ্রেমের নিদর্শনস্বরূপ স্বদেশের মহত্বকীর্তন, না বহির্জগত সম্বন্ধে অজ্ঞতা?
১৭। “বার”-এর মহত্ত্ব কি?
রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি এই নাম কয়টি-পণ্ডিত, মূর্খ, যুবক, বৃদ্ধ সকলেরই মুখস্ত। কিন্তু একই রূপের দিনগুলির মাসে ৩০টি অথবা বৎসরে ৩৬৫ টি নাম না হইয়া মাত্র ৭টি নাম কেন হইল এবং কোথা হইতে এই নামগুলি আসিল, তাহা অনেকেই ভাবেন না।
রবি, সোম ইত্যাদি সবগুলিই গ্রহাদির নাম। মানব সভ্যতার মধ্যযুগে, জ্যোতির্বিদ্যার শৈশবে, সভ্য মানব সমাজের কাজের সুবিধার জন্য সম্ভবতঃ কোন জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত অসংখ্য ও অনন্ত দিনগুলির ৭টি নামকরণ করিয়া থাকিবেন।
গরু, ঘোড়া বা মানুষের স্বকীয় রূপে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। কাজেই উহাদের রূপ দেখিয়া চেনা যায়। কিন্তু কাক বা কোকিল সনাক্ত করা সহজ নয় যেহেতু উহারা সবই-এক-রঙ্গা। স্বাদ, গন্ধ বা বর্ণে সাদৃশ্যযুক্ত পদার্থ অনেক আছে। তাই ডাক্তার বা কবিরাজগণ ঔষধের শিশি বা মোড়কের গায়ে লেবেল আঁটিয়া দেন। বারের সাতটি নামও যেন এক-রঙ্গা দিনের গায়ে সাতটি লেবেল।
সে যুগের জ্যোতিষীগণ জ্যোতিষ্কদের শ্রেণীবিভাগ, বোধ হয় এইরূপ করিয়াছিলেন যে, যে সকল জ্যোতিষ্ক অচল তাহারা ‘নক্ষত্র’ এবং যেগুলি সচল তাহারা “গ্রহ”। তাই রবি ও সোম অর্থাৎ সূর্য ও চন্দ্রকে তাহারা গ্রহ বলিয়া গণনা করিতেন। কাজেই রবি ও সোম “সাতবার” এর তালিকাভুক্ত হইয়াছে। বাস্তবিক পক্ষে চন্দ্র ও সূর্য গ্রহ নহে। পক্ষান্তরে আমাদের এই পৃথিবীটা গ্রহ হইলেও ইহার কোন নাম সাতবারের তালিকায় নাই, মাটি-পাথরের তৈয়ারী নিরালোক পৃথিবীটাও যে একটি গ্রহ, তাহা বোধ হয় সে যুগের জ্যোতিষীগণ জানিতেনই না, জানিলে ধরা বা মেদিনী ইত্যাদি একটি নাম সাতবারের সহিত যোগ হইয়া সাতবারের স্থলে “আটবার” হইত।
সে যাহা হউক-রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি, এই নামগুলি কেন এইরূপ সাজানো হইয়াছে, তার কোন হেতু খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। সাধারণতঃ ঐ নামগুলিকে চারি প্রকার সাজান যাইতে পারে। প্রথমতঃ (সহজদৃষ্ট) আয়তন অনুযায়ী। অর্থাৎ বৃহত্তম হইতে ক্ষুদ্রতম এবং ক্ষুদ্রতম হইতে বৃহত্তমকে গণনা করা, দ্বিতীয়তঃ-দূরত্ব অনুযায়ী। সৌরজগতের কেন্দ্রের নিকটতম হইতে দূরতম এবং দূরতম হইতে নিকটতমকে গণনা করা। কিন্তু প্রচলিত সাতবারের নামগুলি কোন নিয়মের ভিত্তিতেই সাজানো নাই। এখন দেখা যাক যে, উক্ত চারটি নিয়মের ভিত্তিতে এ নামগুলি সাজাইলে “সাতবার” কি রূপে দাঁড়ায়।
ক) বৃহত্তম হইতে ক্ষুদ্রতম (সহজদৃষ্ট)
রবি, সোম, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি ও বুধ।
খ) ক্ষুদ্রতম হইতে বৃহত্তম।
বুধ, শনি, বৃহস্পতি, মঙ্গল, শুক্র, সোম ও রবি।
গ) নিকটতম হইতে দূরতম।
রবি, বুধ, শুক্র, সোম, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি।
ঘ) দূরততম হইতে নিকটতম।
শনি, বৃহস্পতি, মঙ্গল, সোম, শুক্র, বুধ ও রবি।
এতদ্ব্যতীত অধুনা ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো ও ভালকান নামে আরও চারটি গ্রহ আবিষ্কৃত হইয়াছে। পূর্বের আবিষ্কৃত গ্রহগুলির নাম যদি দিন বা “বার” এর নাম বলিয়া লোক সমাজে চলিতে পারে, তবে নব আবিষ্কৃত গ্রহদের নামের দোষ কি? ন্যায় বিচারে ইহাদের নামও সাতবারের সহিত যোগ হইয়া “এগারবার” হওয়া উচিত নয় কি? (প্লুটো ও ভালকানকে আর গ্রহ ধরা হয় না) ধর্ম প্রচারকদের নিকট শোনা যায় যে, প্রত্যেক “বার” এর গুণাগুণ ভিন্ন এবং কোন কোন বার ভগবানের নিকট খুবই প্রিয়। বার বিশেষে স্বর্গের দ্বার খোলা এবং নরকের দ্বার বন্ধ থাকে। কতিপয় ধর্মে বিশেষ সাপ্তাহিক উপাসনাও প্রচলিত আছে। যথা-ইহুদী ধর্মে শনিবার, খৃষ্টান ধর্মে রবিবার এবং ইসলাম ধর্মে শুক্রবার। এই সকল উপাসনায় নাকি পূণ্যও খুব বেশী।
সাতবারের নামগুলি মানুষেরই দেওয়া এবং উহা মানুষের কল্পনার সৃষ্টি। ঐ নামগুলি গ্রহ-উপগ্রহের নাম না হইয়া পশু-পাখীর নামও হইতে পারিত। বর্তমান যুগে দূর হইয়াছে নিকট এবং পর হইতেছে বন্ধু। দূর-দূরান্তের অবস্থিত মানুষ এখন অনেক বিষয়ই একাত্মবোধের প্রমাণ দিতেছে। “রাষ্ট্রসঙ্ঘ”-এর বদৌলতে-কোন আন্তর্জাতিক বিধান প্রবর্তন করা এখন আর অসম্ভব নহে। মানব সমাজ যদি একমত হইয়া সাতবারের বিশৃঙ্খল নামগুলিকে শৃক্মখলাবদ্ধ ও নবাবিষ্কৃত গ্রহদের নাম যোগ করিয়া-গ্রহদের আয়তন বা দূরত্ব, যে কোন একটির ভিত্তিতে সাজাইয়া একটি নতুন সংশোধিত বারের তালিকা প্রণয়ন ও প্রবর্তন করেন, তাহা হইলে সাপ্তাহিক উপাসনা চলিবে কোন “বার”-এ? সংশোধিত বারে উপাসনা করিলে ভগবান তাহা মঞ্জুর করিবেন কি?
১৮। চাঁদের ফজিলত কি?
বিজ্ঞানীগণ বলিয়া থাকেন যে, সূর্যের প্রজ্জ্বলিত বাষ্পীয় দেহের ছিন্ন অংশে পৃথিবীর সৃষ্টি এবং পৃথিবীর ঘূর্ণায়মান গতির ফলে কেন্দ্রাপসারণী শক্তির (Centrifugal force) প্রভাবে বিচ্ছিন্ন অংশে চন্দ্র জন্ম হইয়াছে। এই মতে-চন্দ্র, সূর্য এবং পৃথিবীর দেহের মৌলিক উপাদান একই। বিশেষতঃ চন্দ্র জল-বায়ু শূন্য একটি দেশ মাত্র। চন্দ্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করিয়া প্রায় ২৩৭০৮১/২ মাইল দূরে (১৪) থাকিয়া প্রায় সাড়ে উনত্রিশ দিনে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। একবার প্রদক্ষিণের সময়কে এক চান্দ্রমাস বলা হয় এবং বারো চান্দ্রমাস ধরা হয় এক চান্দ্র বৎসর।
বারোবার চন্দ্রের উদয়কে “এক বৎসর” বলিয়া কে প্রথম গণনা করিয়াছিলেন জানিনা; বোধ হয় যে, অতীতকালে কোন জ্যোতিষীই হইবেন। তিনি ইচ্ছা করিলে- আট, দশ বা বিশ-পঁচিশ মাসেও চান্দ্র বৎসর গণনা করিতে পারিতেন। কেননা পৃথিবী তার স্বীয় কক্ষের কোন বিন্দু হইতে যাত্রা করিয়া একবার সূর্য প্রদক্ষিণান্তে পুনঃ কক্ষের সেই বিন্দুতে পৌঁছিতে যে সময়টুকু লয়, তাহাই এক সৌর বৎসর। সৌর বৎসর হইবার একটি স্থির মুহূর্ত বা বিন্দু আছে। কিন্তু চান্দ্র বৎসর শেষ হইবার সেরূপ কোন বাঁধন নাই, উহা কাল্পনিক। তাই চান্দ্রমাস ও বৎসর প্রকৃতির ষড়ঋতুকে তুচ্ছ করিয়া আপন খেয়াল মত চলিয়া যায। সে যাহা হউক, প্রত্যেক মাসের চন্দ্রই যদি পূর্ব চন্দ্রের পুনরোদয় হয়, তবে ভিন্ন ভিন্ন বার উদিত চন্দ্রের ফজিলত (গুণাগুণ) ভিন্ন ভিন্ন হয় কিরূপে? আকাশে চন্দ্র মাত্র একটি এবং তাহার নূতন উদয়ের সংখ্যা হইল অনন্ত, “বারচাঁদ” বলা হয় কেন?
বলা যাইতে পারে যে, চন্দ্র একটি বস্তুপিণ্ড, তার কোন ফজিলত নাই। কিন্তু কোন কোন সময়ের ফজিলত আছে। লোকে চন্দ্রকে দেখিয়া সেই সময়কে চিনিয়া লয় মাত্র।
মানুষ অতীতের কোন ঘটনার স্মৃতিকে-চিত্র, লেখা, আখ্যায়িকা ইত্যাদি রূপে রক্ষা করিতে পারে এবং রঙ্গমঞ্চে তার কতকটা পুনরাভিনয় করাও চলে। কিন্তু “কাল” বা সময়ের পুনরাভিনয় করা যায় কি? অতীতের কোন পূণ্য মুহূর্ত বা পবিত্রদিনকে যে “বার্ষিক পবিত্র দিন” বলিয়া মনে করা হয়, তাহাতে কি কালের পুনরাবৃত্তি হয়, না ঘটনার নামের পুনরোক্তি হয় মাত্র?
হয়ত কেহ বলিবেন যে, অতীতকালের পুনরাগমন না হইলেও অতীত ঘটনা স্মৃতিরক্ষার স্বার্থকতা আছে। তাহা না থাকিলে জগতে শত শত স্মৃতিদিবস উদযাপিত হয় কেন? উত্তরে বলা যাইতে পারে যে, স্মৃতিদিবস উদযাপনের স্বার্থকতা আছে বটে, কিন্তু উহা সৌরবৎসরের হিসাব মতেই আছে, চান্দ্রবৎসরের নহে। কেন, তাহা বলিতেছি।
স্মৃতি বা বিস্মৃতি, মনের ধর্ম। সুতরাং যে কোন “স্মৃতিদিবস” বা বার্ষিক অনুষ্ঠান মানসিক ব্যাপার ভিন্ন আর কিছুই নহে। যে কোন অনুষ্ঠানের আদিম ঘটনাকারী বা তৎসহযোগীদের মনে যে ভাবাবেগ জন্মিয়াছিল, পরবর্তীকালে তদনুবর্তীদের মনে সেইরূপ ভাবের পুনরোদয় করিবার বা করাইবার প্রচেষ্টাই স্মৃতিবার্ষিক অনুষ্ঠান। কিন্তু সেই আদিম ঘটনা ঘটিবার সময়ের ঘটনাকারী বা তৎসহযোগীদের মনোভাবের পর্যায়ে পরবর্তীকালের মানুষের মনকে পৌঁছাইতে হইলে পূর্বরূপ প্রাকৃতিক অবস্থারও আবশ্যক।
জীব প্রকৃতির দাস, মানুষও তাহাই। প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যে বা ঋতু পরিবর্তনে জীবের স্বাস্থ্য ও শারীরিক পরিবর্তন হয়, ফলে মনোরাজ্যেরও পরিবর্তন হয়। তাই প্রতি বৎসর বসন্তে কোকিল গান গায়, বর্ষাকালে ভেক ডাকে, ফুল বাগানে মৌসুমী ফুল ফোটে। ইহা যেন উহাদের বার্ষিক মহোৎসব। যুগ যুগ ধরিয়া উহারা উহাদের মহোৎসব পালন করিয়া আসিতেছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে উহাদের মনে প্রেরণা জায়গা কে? উহাদের ত কোন খাতাপত্র বা লিপিপঞ্জি নাই।
পৃথিবী তাহার স্বীয় কক্ষের যেই যেই অংশে অবস্থান কালে কোকিল গান গায়,গাছে গাছে আম পাকে, ডোবায় ডোবায় ভেক ডাকে – একবার আবর্তনের পর পুনঃ কক্ষের সেই সেই অংশে পৃথিবী পৌঁছিলে, আবার কোকিল গাহিবে, ভেক ডাকিবে; তা ঋতু বা মাসের নাম আমরা যাহাই রাখি না কেন। বসন্ত ঋতুকে শরৎ ও ফাল্গুন মাসকে ভাদ্র বলিলেও কোকিল নির্দিষ্ট সময়েই ডাকিবে। তেমনি আষাঢ় মাসকে পৌষ মাস বলিলেও ভেক ঐ সময়েই ডাকিবে। ফল কথা এই যে কাল বা সময়ের পুনরাগমন না হইলেও সৌর বৎসরে স্বভাবের বা ঋতুর পুনরাগমন হয় এবং তাহাতে জীবের মনোভাবের পুনরাবৃত্তি হয়। চান্দ্র বৎসরে কোন মাসবিশেষের সাথে জীবের মনোরাজ্যের কোন সম্পর্ক আছে কি?
চান্দ্র বৎসর ও সৌর বৎসরে প্রায় ১১১/৪ দিনের পার্থক্য হইয়া পড়ে। অর্থাৎ সৌর বৎসর শেষ হইবার প্রায় ১১ দিন পূর্বে চান্দ্র বৎসর শেষ হইয়া যায়। কাজেই তিন বৎসরে প্রায় একমাস ও ছয় বৎসরে প্রায় দুই মাস পার্থক্য হয়। অর্থাৎ একটি ঋতুই পার হইয়া যায়। উপরোক্ত হিসাবমতে এই বৎসর যে অনুষ্ঠান হইল বসন্তে, আঠার বৎসর পর (চান্দ্র বৎসরের হিসাব মতে) তাহা দাঁড়াইবে হেমন্তে। এই রকম প্রাকৃতিক পরিবর্তনযোগ্য-ঈদ, কোরবানি ইত্যাদি অনুষ্ঠানে চাঁদ নির্ণয়ের সার্থকতা কি?
প্রায় সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিই অনুষ্ঠিত হয় চান্দ্র মাসের হিসাব মোতাবেক। কিন্তু হিন্দুগণ উহা পুরাপুরি মানেন না। পূর্বে বলা হইয়াছে যে, চান্দ্র বৎসর ও সৌরবৎসর প্রায় এগারো দিনের পার্থক্য হইয়া পড়ে। চন্দ্র এগারো দিন করিয়া বাড়িতে বাড়িতে যখন তিন বৎসরে তেত্রিশ দিন বেশী হইয়া পড়ে তখন হিন্দুগণ একটা চান্দ্র মাসকে হিসাব হইতে একেবারে বাদ দিয়া দেন। কাজেই তেত্রিশ দিনের তফাতের পর হঠাৎ চান্দ্রমাস ও প্রচলিত (সৌর) মাসের মধ্যে প্রায় মিল হইয়া পড়ে।
এই রকম বাদ দেওয়া মাসকে “মল-মাস” বলা হয়। এই মাসটিকে হিন্দুরা মাসের মধ্যেই ধরেন না। কোন যাগ-যজ্ঞ, পূজা-হোম বা শুভকার্য হিন্দুরা এই মাসে করেন না।
ইংরেজদের “বড়দিন” ইত্যাদি উৎসব সৌর বৎসরের হিসাব মতেই হইয়া থাকে এবং প্রতি বৎসরেই একটা বাঁধা তারিখে হয়। কিন্তু হিন্দুদের দুর্গাপূজা ইত্যাদি সেইরূপ বাঁধা তারিখে হয় না বটে, তবে “মল-মাস” এর ব্যবস্থার ফলে উহার ব্যবধান এক মাসের বেশী হইতে পারে না। অর্থাৎ চিরকাল একই মাস বা একই ঋতুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিয়া যায়। কিন্তু মুসলিম জাহানের যে কোন ধর্মানুষ্ঠান অবিরাম ঘুরিয়া বেড়ায় এবং ছত্রিশ বৎসরে পুরা সৌর বৎসরটাকে একবার আবর্তন করিয়া পূর্বস্থানে (সময়ে) ফিরিয়া আসে।
আধুনিক কালের প্রায় সব দেশে যাবতীয় পর্ব বা বার্ষিক অনুষ্ঠানাদি সৌর বৎসরের হিসাবানুসারে অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে, চান্দ্র বৎসরের নয়। আমাদের “স্বাধীন বাংলা” রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৭১ খৃঃ ১৬ই ডিসেম্বর মোতাবেক ২৭শে শাওয়াল মাস। ঐ তারিখে জাতীয় মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ করার বাণী শ্রবণে যে উদ্যম-উৎসাহে বঙ্গবাসীদের মন নৃত্য করিয়াছিল, তাহা ডিসেম্বর মাসের তান-মান-লয় যোগেই করিয়াছিল। বৎসরের অপর কোন মাসেই প্রকৃতি বীণা ঐরূপ সুরে বাজিবে না এবং মন নাচিলেও ঐরূপে নাচিবে না। তাই “স্বাধীন বাংলা” রাষ্ট্রের জন্মবার্ষিকী মহোৎসব প্রতি বৎসর ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে হইতেছে। কিন্তু ২৭শে শাওয়াল তারিখে উহা হইবার কোন যুক্তি আছে কি?
১৯। শবেবরাতের ফজিলত কি?
‘শবেবরাত’ বা ভাগ্যের রজনী মুসলমানদের একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান। কথিত হয় যে, ঐ রাত্রে খোদাতা’লার গুণগান করিলে পরবর্তী এক বৎসরের রুজী-রোজগারে বরকত হয় ও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। এক কথায় জীবন যাপন সুখের হয়। এক বিশ্বাসের বশবর্তী হইয়া অনেকেই উহা পালন করিয়া আসিতেছেন। কিন্তু দেখা যাইতেছে যে, এই অনুষ্ঠান যাহারা পালন করেন এবং যাহারা করেন না, তাহাদের মধ্যে খাওয়া-পরা বা সুখ-শান্তিতে কোনই পার্থক্য নাই বরং এমনও দেখা যায় যে, যাহারা করেন না তাঁহারাই অত্যধিক সমৃদ্ধশালী। মুসলিম জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ছিলেন মহামান্য আগা খাঁ। তিনি কি শবেবরাতের নামাজ পড়িতেন?
হিন্দুদের ঐরূপ অনেক অনুষ্ঠান পালন করিতে দেখা যায়। ‘লক্ষ্মীপূজা’ এই জাতীয় একটি অনুষ্ঠান। হিন্দুমতে লক্ষ্মীদেবী সম্পদ বিতরণের মালিক। তাই তাঁহার পূজা করিলে তিনি প্রসন্না হইয়া তাঁর ভক্তকে বেশী পরিমাণ ধনরত্ন দান করেন। এই বিশ্বাসের বশবর্তী হইয়া হিন্দুগণ লক্ষ্মীদেবীর পূজা করিয়া থাকেন। কিন্তু দেখা যাইতেছে যে, চারি আনা পয়সা খরচ করিয়া লক্ষ্মীদেবীর প্রতিমা কিনিতে না পারিয়া কেষ্ট সাধু (লেখকের প্রতিবেসী) ছেলেবেলা হইতেই কলাগাছের লক্ষ্মী সাজাইয়া তাঁর পূজা করিতে আরম্ভ করিল, আর এখন তার পঞ্চাশ বৎসর বয়সেও কলাগাছ ছাড়িয়া প্রতিমা কিনিবার তওফিক হইল না। অথচ আমেরিকার ফোর্ড সাহেব (Henry Ford) লক্ষ্মীপূজা না করিয়াও সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী হইলেন।
হিন্দুধর্মের আর একটি অনুষ্ঠান সরস্বতী পূজা। তিনি নাকি মানুষের বিদ্যাদাত্রী। তাঁর পূজা করিলে তিনি সদয় হইয়া তাঁর ভক্তকে অসীম বিদ্যা দান করেন। অথচ দেখা যাইতেছে যে, সাত বৎসর পর্যন্ত সরস্বতী দেবীর পূজা দিয়াও গোপাল চাঁদ (লেখকের প্রতিবাসী) বর্ণমালা আয়ত্ব করিতে পারিল না, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরস্বতী পূজা না দিয়াও কবি সম্রাট হইলেন।
‘শবেবরাত’ ঐ শ্রেণীর একটি অনুষ্ঠান নয় কি?
২০। কসুফ ও খসুফ কি?
খুব বেশী দিনের কথা নয়। কলম্বাস সাহেব সদলবলে আমেরিকা পৌঁছিলে একদা তাহাদের খাদ্যের অভাব হয়। তাঁহারা ভাবিলেন – মহাবিপদের কথা। অজানা অচেনা দেশ, কোথায় কি খাদ্য পাওয়া যায় না যায়, তার ঠিক নাই। কলম্বাস সাহেব মনে মনে এক ফন্দি আঁটিলেন। ঐদিন ছিল সূর্যগ্রহণ। তিনি জানিতেন, অসভ্যরা সূর্যগ্রহণকে অতিশয় ভয় করে। কেননা তাহারা মনে করে যে, সূর্য হঠাৎ নিভিয়া গেলে তাপ এবং আলোর অভাবে তাহারা শীত ও অন্ধকারে মরিয়া যাইবে। কলম্বাস সাহেব আমেরিকার কয়েকজন আদিম (অসভ্য) অধিবাসীকে ডাকিয়া ইশারায় বুঝাইয়া বলিলেন, “আমরা দেবতার বংশধর! আমাদের খাদ্যের অভাব হইয়াছে, তোমরা আমাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করিয়া দাও; নচেৎ সূর্যকে নিভাইয়া দিব। তাহা হইলে তোমরা শীত ও অন্ধকারে না খাইয়া মরিবে।” প্রথমতঃ অসভ্যরা উহা গ্রাহ্য করিল না। কিন্তু কিছু সময় পর যখন দেখিল যে, সত্যই সূর্য নিভিতে আরম্ভ করিয়াছে তখন উহারা নানারকম খাদ্য আনিয়া দিতে লাগিল এবং বিচিত্র ভঙ্গিতে কলম্বাসের স্তবস্তুতি করিয়া ইশারায় বলিতে লাগিল – তোমরা সূর্যকে মুক্ত করিয়া দাও, আমাদিগকে বাঁচাও, আমরা আজীবন তোমাদের অনুগত। কলম্বাস সাহেব দেখিলেন যে, তাহাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইয়াছে, তখন তিনি অসভ্যদের ইশারায় জানাইলেন-তোমরা শান্ত হও, আমরা অচিরেই সূর্যকে মুক্ত করিয়া দিতেছি। কিছুক্ষণ বাদে যখন সূর্য মুক্ত হইল, অসভ্যরা ভাবিল-তাইত! শ্বেতাঙ্গরা সত্যই দেবতার বংশধর। ইহাদের নিয়মিত ভোগ দিয়া স্তবস্তুতি করিতে হইবে। সেইদিন হইতে কলম্বাস সাহেব যতদিন আমেরিকায় ছিলেন, তার মধ্যে আর কখনও তাঁহার খাদ্যের অভাব হয় নাই।
এতদ্দেশের লোকও অতি প্রাচীনকাল হইতে চন্দ্র ও সূর্য-গ্রহণকে অমঙ্গলসূচক বলিয়া ভয় করিত এবং এখনও অনেকে করে। তাই হিন্দুদের মধ্যে গ্রহণের সময় মন্ত্রপাঠ, শঙ্খ ও ঘণ্টাবাদন, উলুধ্বনি, কুম্ভমেলায় যাওয়া ও গঙ্গাস্নানের রেওয়াজ আছে এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের ভিতরেও চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের সময় “কসুফ” ও “খসুফ” নামক নামাজ পড়ার নিয়ম আছে।
যাঁহার গ্রহণের সময় স্তবস্তুতি করার প্রচলন করিয়া গিয়াছেন বোধ হয় যে তাঁহাদের দুইটি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথম উদ্দেশ্য হইল, চাঁদ-সূর্যকে গ্রহণমুক্ত করিয়া বিপদকালে তাহাদের সাহায্য করা; দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হইল, চাঁদ-সূর্যকে গ্রহণমুক্ত করিয়া পরোক্ষভাবে নিজেদের মঙ্গল করা। তাঁহারা হয়ত ভাবিতেন- গ্রহণের সময় চাঁদ-সূর্যের খুব কষ্ট হয়। কেননা সাপে ব্যাঙ ধরিয়া যেরূপ ধীরে ধীরে গিলিতে থাকে রাহু ও কেতু আসিয়া সেইরূপ চাঁদ-সূর্যকে গিলিতে থাকে এবং উহাদের কষ্ট হয়। গ্রহণ দীর্ঘস্থায়ী হইলে বেচারারা হয়ত মরিয়াও যাইতে পারে। সুতরাং উহাদের আশু মুক্তির জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা ভিন্ন তাঁহাদের হাতে আর কোন উপায় ছিল না। তাই অতীতকালের মহানুভব ব্যক্তিগণ চাঁদ-সূর্যের মঙ্গল নিজেদের মঙ্গল ও বিশ্ববাসীর কামনায় নানাবিধ স্তবস্তুতির প্রবর্তন ও প্রচলন করিয়া গিয়াছেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ বলেন যে মহাকাশে সূর্যকে কেন্দ্র করিয়া এক গোলাকার কক্ষপথে পৃথিবী ভ্রমণ করিতেছে এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করিয়া এক গোলাকার কক্ষপথে চন্দ্র ভ্রমণ করিতেছে। এই ঘূর্ণণে সময় সময় চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবী এক সরল রেখায় দাঁড়ায়। ঐ সময় অমাবস্যা তিথি হইলে, সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে চন্দ্র দাঁড়াইয়া সূর্যকে আড়াল করিয়া ফেলে, ইহাকে আমরা “সূর্য গ্রহণ” বলি এবং ঐ অবস্থায় পূর্ণিমা তিথি হইলে, চন্দ্র ও সূর্যের মাঝখানে পৃথিবী দাঁড়ায়। ইহাতে পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রে পতিত হওয়ার ফলে আমরা “চন্দ্রগ্রহণ” দেখি। আসলে চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণ – চন্দ্র ও পৃথিবীর ছায়া মাত্র। রাহু, কেতু বা অন্য কিছু নয়। সূর্য হইতে পৃথিবী ও পৃথিবী হইতে চন্দ্রের দূরত্ব এবং উহাদের ব্যাস ও গতিবেগ জানা থাকিলে, কোন গ্রহণ কখন হইবে এবং কত সময় স্থায়ী হইবে, তাহা অঙ্ক কষিয়া বলা যায়। বলা বাহুল্য যে, কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ উহা বলিতেছেন, তাহা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হইতেছে এক মিনিটও এদিক-ওদিক হইতেছে না।
একবার ১৯৬৫ সাল ২০০০ সাল হইতে দীর্ঘ ৩৬ বৎসরের চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের একটি তালিকা প্রকাশ করিয়াছিলেন আকাশ-বিজ্ঞানীগণ। এযাবৎ (১৯৮২) তাহার মধ্যে ১৮ বৎসরের গ্রহণ সমূহ যথা নির্ধারিত সময়ই ঘটিয়া গিয়াছে এবং আগামী বৎসরগুলিতেও তার কোন ব্যত্যয় হইবে না, তাহা নিঃসন্দেহেই বলা চলে। গ্রহণগুলি অলৌকিক বা ঐশ্বরিক কোন ঘটনা নহে, উহা সম্পূর্ণ লৌকিক ও পার্থিব ঘটনা। চাক্ষুষ প্রমাণের জন্য আগামী ১৯৮৩ হইতে ২০০০ সালের শুধু সূর্যগ্রহণের একটি তালিকা নিম্নে প্রদান করা হইল। বাহুল্যবোধে চন্দ্রগ্রহণের তালিকা দেওয় হইল না এবং পৃথিবীর সকল অঞ্চলে “একই সময় গ্রহণ দৃষ্ট হয় না” বলিয়া সময় দেওয়া হইল না।
সাল তারিখ
১৯৮৩ ১১ জুন
১৯৮৪ ৩০ মে ও ২২ নভেম্বর
১৯৮৫ ১২ নভেম্বর
১৯৮৬ ৩ অক্টোবর
১৯৮৭ ২৯ মে
১৯৮৮ ১৮ মার্চ
১৯৮৯ –
১৯৯০ ২২ জুলাই
১৯৯১ ১১ জুলাই
১৯৯২ ৩০ জুন
১৯৯৩ –
১৯৯৪ ৩ নভেম্বর
১৯৯৫ ২৪ অক্টোবর
১৯৯৬ –
১৯৯৭ ৯ মার্চ
১৯৯৮ ২৬ ফেব্রুয়ারী
১৯৯৯ ১১ আগস্ট
২০০০ পূর্ণ গ্রহণ হইবে না।
এমতাবস্থায় চন্দ্র বা সূর্য গ্রহণের সময় “কসুফ” বা “খসুফ” নামায অথবা অন্য কোনরূপ স্তবস্তুতি করার উপকারিতা কিছু আছে কি?
২১। জীব হত্যায় পুণ্য কি?
কোন ধর্ম বলে, “জীবহত্যা মহাপাপ”। আবার কোন ধর্ম বলে,“জীবহত্যায় পুণ্য হয়”। জীবহত্যায় পাপ বা পুণ্য যাহাই হউক না কেন, জীবহত্যা আমরা অহরহই করিতেছি। তার কারণ¬ জগতে জীবের খাদ্যই জীব। নির্জীব পদার্থ যথা-সোনা, রূপা, লোহা, তামা বা মাটি-পাথর খাইয়া কোন জীব বাঁচে না। পশু-পাখী যেমন জীব, লাউ বা কুমড়া, কলা-কচুও তেমন জীব। উদ্ভিদগণ মৃত্তিকা হইতে যে রস আহরণ করে, তাহাতেও জৈব পদার্থ বিদ্যমান থাকে। কেঁচো মৃত্তিকা ভক্ষণ করিলেও উহার দ্বারা সে জৈবিক পদার্থ-ই আহরণ করে এবং মৃত্তিকা মল রূপে ত্যাগ করে।
জীব-হত্যা ব্যাপারে কতগুলি উদ্ভট ব্যবস্থা আছে। যথা-ভগবানের নামে জীব হত্যা করিলে পুণ্য হয়, অখাদ্য জীব হত্যা করিলে পাপ হয়, শত্রু শ্রেণীর জীব হত্যা করিলে পাপ নাই এবং খাদ্য জীব হত্যা করিলে পাপ-পুণ্য কিছুই নাই ইত্যাদি।
সে যাহা হউক, ভগবানের নামে জীব হত্যা করিলে পুণ্য হইবে কেন? কালীর নামে পাঁঠা বলি দিয়া উহা যজমান ও পুরোহিত ঠাকুরই খায়। কালীদেবী পায় কি? পদপ্রান্তে জীবহত্যা দেখিয়া পায় শুধু দুঃখ আর পাঁঠার অভিশাপ। কেননা কালীদেবীর ভক্তগণ যাহাই মনে করুন, পাঁঠায় কামনা করে কালীদেবীর মৃত্যু। যেহেতু কালীদেবী মরিলেই সে বাঁচিত।
জীবমাত্রেই বলির পাত্র নহে। আবার ধর্মে ধর্মে বলির জীব পার্থক্য অনেক। মুসলমানদের কোরবানির (বলির) পশু-গরু, বকরী, উট, দুম্বা ইত্যাদি। কিন্তু হিন্দুদের বলির পাত্র-ছাগল, ভেড়া, হরিণ, মহিষ, শূকর, গণ্ডার, শশক, গোসাপ এবং কাছিম।
ইসলামের বিধান মতে “কোরবানি” একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান। শোনা যায় যে, হজরত ইব্রাহিম (আঃ) স্বপ্নাদেশ মতে তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করিয়া খোদাতা’লার প্রিয়-পাত্র হইয়াছিলেন। তাই মুসলমানগণ গরু, ছাগল, উট, দুম্বা ইত্যাদি কোরবানি দিয়া খোদাতা’লার প্রিয়-পাত্র হ’ন।
কোরবানি প্রথার মূল উৎস সন্ধান করিলে মনে কয়েকটি প্রশ্ন উদয় হয়। প্রশ্ন হুলি এমন-
ক) হজরত ইব্রাহিমের “স্বপ্নাদেশ” তাঁর মনের ভগবদ্ভক্তির প্রবণতার ফল হইতে পারে না কি?
খ) খোদাতা’লা নাকি স্বপ্নে বলিয়াছিলেন-“হে ইব্রাহিম, তুমি তোমার প্রিয় বস্তু কোরবানি কর।” এই “প্রিয়বস্তু” কথাটির অর্থে হজরত ইব্রাহিম তাঁর পুত্র ইসমাইলকে বুঝিয়াছিলেন এবং তাই তাহাকে কোরবানি করিয়াছিলেন। হজরত ইব্রাহিমের প্রিয়বস্তু তাঁর “পুত্র” ইসমাইল না হইয়া তার “প্রাণ” হইতে পারে না কি?
শোনা যায় যে, একদা আল্লাহতা’লা হজরত মুসার নিকট দুইটি চক্ষু চাহিয়াছিলেন। হজরত মুসা অনেক কোসেস করিয়াও কাহারোও কাছে চক্ষুর খোঁজ না পাইয়া পরের দিন (তুর পর্বতে গিয়া) আল্লাহর কাছে বলিলেন, সমস্ত দেশ খোঁজ করিলাম, কিন্তু কোন ব্যক্তিই আমাকে চক্ষু দিতে রাজী হইল না। তখন নাকি আল্লাহ বলিয়াছিলেন, হে মুসা! তুমি সমস্ত দেশ খোঁজ করিয়াছ সত্য, কিন্তু তুমি তোমার নিজ দেহটি খোঁজ করিয়াছ কি? তোমার নিজের দুইটি চক্ষু থাকিতে অপরের চক্ষু চাহিতে গিয়াছ কেন? হজরত মুসা নিরুত্তর হইলেন।
ইহাতে দেখা যাইতেছে যে নবীগণও কোন কোন সময় আল্লাহর বাণীর উদ্দেশ্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করিতে না পারিয়া ভ্রমে পতিত হইতেন। হজরত ইব্রাহিম বহির্জগতে তাঁর “প্রিয়বস্তুর” খোঁজ করিয়া তাঁর পুত্রকে পাইয়াছেন সত্য, কিন্তু তিনি তাঁর অন্তর্জগত খোঁজ করিলে কি পাইতেন?
গ) “কোরবানি” এই কথাটির অর্থ “বলিদান” না হইয়া “উৎসর্গ” হইতে পারে কিনা। ঈসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্তান উৎসর্গের নিয়ম আছে। কোন সন্তানকে তার পিতা-মাতা মহাপ্রভুর নামে উৎসর্গ করিতে পারেন। ঐরূপ উৎসর্গ করা সন্তানের কর্তব্য হয় – সর্বস্বত্যাগী হইয়া আজীবন ধর্মকর্ম ও মন্দির-মসজিদের সেবা করা। এই প্রথাটি ইহুদী জাতির মধ্যেও দেখা যায়। হজরত ঈসার মাতা বিবি মরিয়ম জেরুজালেম মন্দিরে উৎসর্গ করা একজন সেবিকা ছিলেন। সমস্ত নবীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন হজরত ইব্রাহিমের বংশধর। হজরত ইসমাইল, হজরত ইসহাক, হজরত ইয়াকুব, হজরত ইউসুফ, হজরত মুসা, হজরত ঈসা এবং হজরত মোহাম্মদ (সঃ) পর্যন্ত সকলেই। ইসমাইল ও ইসহাক পুত্র, হজরত ইয়াকুব পৌত্র এবং হজরত ইউসুফ ছিলেন প্রপৌত্র। অন্যান্য নবীদের মধ্যেও সকলেই ছিলেন হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর পূর্ববর্তী এবং হজরত ইব্রাহিমের অনুসারী। ছেলেদের খাৎনা (ত্বকচ্ছেদ) করার প্রথাটি হজরত ইব্রাহিম প্রবর্তন করিয়াছিলেন এবং তাহা অন্যান্য নবীগণও পালন করিয়া গিয়াছেন। বিশেষতঃ ইহুদী ও খৃষ্টিয়ানগণ উহা এখনও পালন করেন। কিন্তু স্বগোত্রীয় ও অনুসারী হইয়াও উহারা “কোরবানি” প্রথাটি পালন করেন নাই। কিন্তু হজরত ইব্রাহিমের আবির্ভাবের প্রায় আড়াই হাজার বৎসর পর উহা প্রবর্তন হইল কেন?
ঘ) যাঁহারা স্বপ্নতত্ত্ব আলোচনা করেন, তাঁহারা জানেন যে, স্বপ্নদ্রষ্টা স্বপ্নে যাহা কিছু দেখে, তার মধ্যে অধিকাংশই থাকে “রূপক”। হজরত ইব্রাহিমের স্বপ্নের কোরবানির দৃশ্যটা “রূপক” হইতে পারে কিনা?
উপরোক্ত বিষয়সমূহ পর্যালোচনা করিলে মনে হয় যে, কোরবানি প্রথার ভিত্তিমূলক সুদৃঢ় নয়। একটি স্বপ্নের ভিত্তি করিয়া প্রতি বৎসর লক্ষ লক্ষ পশুর জীবন নষ্ট হইতেছে। উপন্যাসকে ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করিলে যেরূপ ভুল করা হয়, স্বপ্নের রূপককে বাস্তব বলিয়া গ্রহণ করিলে সেইরূপ ভুল হইতে পারে না কি?
সে যাহা হউক, হজরত ইব্রাহিম যে একজন খাঁটি খোদাভক্ত ছিলেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তিনি যদি স্বপ্নাদেশের প্রিয়বস্তু বলিতে তাঁর নিজ প্রাণকে বুঝিতেন, বোধ হয় যে, তাহাও তিনি দান করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। আল্লাহর প্রেমে তিনি এত অধিক আত্মভোলা হইয়াছিলেন যে, তখন তাঁর কাছে স্ত্রী, পুত্র ও ধনরত্নাদির কোনই মূল্য ছিল না। তাই তিনি অম্লানবদনে তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইলের গলে ছুরি চালাইয়াছিলেন। হজরত ইব্রাহিমের সন্তান-বাৎসল্য যতই গভীর হউক আর না হউক, উহাদের মধ্যে একটি সম্পর্ক ছিল, তাহা ‘পিতা ও পুত্র’। আজকাল যে সকল ব্যক্তি পশু কোরবানি করেন, তাহাদের সঙ্গে ঐ পশুর সম্পর্ক কি?
কোরবানির পশুর সঙ্গে কোরবানি দাতার সম্পর্ক শুধু টাকার। তাহাও অনেক ক্ষেত্রে সুদ, ঘুষ, চোরাবাজারী, লোক ঠকানো ইত্যাদি নানা প্রকার অসুদপায়ে অর্জিত। কাজেই কোরবানি দাতা মনে করেন – ‘যত্র আয় তত্র ব্যয়’, মাঝখানে লাভ হয় কোরবানি করার যশ।
দেখা যায় যে, কেহ কেহ কোরবানি দুই-তিন দিন পূর্বেই কন্যা-জামাতা ও আত্মীয়-বন্ধুদের দাওয়াত করেন এবং কোরবানির দিন সকাল হইতে আটা-ময়দা ও চাউলের গুঁড়া তৈয়ারে ব্যস্ত থাকেন। কোরবানির পশুর মাংস দিয়া মাংস-রুটির এক মহাভোজ হয়। হজরত ইব্রাহিম যখন ইসমাইলকে কোরবানি করিতে লইয়া গিয়াছিলেন, তখন কি বিবি হাজেরাকে তিনি আটার রুটি তৈয়ার করিতে বলিয়া গিয়াছিলেন?
কোরবানির পশুর জবেহ হইতে আরম্ভ করিয়া – মাংস কাটা, বখরা ভাগ ইত্যাদি ও খাওয়া- দাওয়া পর্যন্ত চলিতে থাকে যত রকম হাসি-তামাসা, গল্প-গুজব ও পান-সিগারেটের ধুম। হজরত ইব্রাহিমের কোরবানির সাথে ইহার পরিবেশগত কোন সামঞ্জস্য আছে কি?
হজরত ইব্রাহিমের কোরবানির মূল বস্তু ছিল তাঁর “প্রাণ” কোরবানি করা। কেননা ইসমাইল তাঁর প্রাণ সমতুল্যই ছিলেন। বিশেষতঃ তাঁর ঔরসজাত বলিয়া তিনি তাঁর প্রাণের অংশীদারও ছিলেন (ছিয়াশী বৎসর বয়স্ক সুবৃদ্ধ ইব্রাহিমের একই মাত্র সন্তান ইসমাইল)। তাই ইসমাইলকে কোরবানি করার মানে হজরত ইব্রাহিমের প্রাণকে কোরবানি করা। আর আজকাল যে কোরবানি করা হয়, তাহাতে কোরবানির পশুর সাথে কোরবানি দাতার কোনরূপ স্নেহ বা মায়ার বন্ধন থাকে কি?
হজরত ইব্রাহিম আল্লাহর নির্দেশ মানিয়া শুধু কোরবানিই করেন নাই, আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে চলিতে যাইয়া তিনি নাকি ভীষণ অগ্নিকুণ্ডেও পতিত হইয়াছিলেন। হজরত ইব্রাহিমের পদাঙ্ক অনুসরণ বা তাঁর কৃতকর্মের অনুকরণ করাই যদি তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ্য হয়, তবে তিনি যেই তারিখে অগ্নিকুণ্ডে পতিত হইয়াছিলেন, সেই তারিখে তাঁহারা অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দেন না কেন?
হজরত ইব্রাহিম তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রিয় বস্তুই কোরবানি করিয়াছিলেন। বর্তমান কোরবানি দাতাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রিয় বস্তু কি দশ-বিশ টাকা মূল্যের একটি পশু?
হজরত ইব্রাহিমের খোদাভক্তি উত্তরাধিকার সূত্রে ইসমাইল পাইয়াছিলেন। তাই সে নিজেকে কোরবানি করার বাণী শ্রবণে মহানন্দে তাহাতে সম্মতি দিয়াছিলেন এবং পিতার ছুরিকার নীচে স্বেচ্ছায় শয়ন করিয়াছিলেন। আর বর্তমান কোরবানি প্রথায় পশুর কোন সম্মতি থাকে কি? একাধিক লোকে যখন একটি পশুকে চাপিয়া ধরিয়া জবেহ করেন, তখন সে দৃশ্যটা বীভৎস বা জঘন্য নয় কি?
মনে করা যাক যে, মানুষের চেয়ে বেশী শক্তিশালী এক অসুর জাতি পৃথিবীতে আবির্ভাব হইয়া, তাহারা পুণ্যার্থে মহেশ্বর নামক এক দেবতার নামে জোরপূর্বক মানুষ বলি দিতে আরম্ভ করিল। তখন অসুরের খাঁড়ার (ছুরির) নীচে থাকিয়া মানুষ কি কামনা করিবে? ‘মহেশ্বরবাদ ধ্বংস হউক, অসুর জাতি ধ্বংস হউক, অন্ধ-বিশ্বাস দূর হউক’ ইহাই বলিবে না কি?
হজরত ইব্রাহিম দ্বিধাহীন চিত্তেই ইসমাইলের গলে ছুরি চালাইয়াছিলেন। কিন্তু বলির শেষে দেখিলেন যে কোরবানি হইয়াছে একটি দুম্বা, ইসমাইল তাঁর পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন। ঐ সময় দুম্বা কোরবানি না হইয়া প্রকৃত পক্ষে যদি ইসমাইলই কোরবানি হইতেন তবে তাঁহার অনুকরণে মুসলিম জাহানে আজ কয়টি কোরবানি হইত?
হজরত ইব্রাহিমের কোরবানি দেওয়া হইল বটে, কিন্তু ইসমাইল কোরবানি হইলেন না এবং যে দুম্বাটি কোরবানি হইল, তাঁর কেনা নয় এবং পালেরও নয়। অধিকন্তু উহা কোথা হইতে কিভাবে আসিল, তাহাও তিনি জানিলেন না। ঘটনাটি আজগুবি নয় কি?
কোরবানি প্রথায় দেখা যায় যে, কোরবানির পশুর হয় “আত্মত্যাগ এবং কোরবানি দাতার হয় সামান্য স্বার্থত্যাগ”। দাতা যে মূল্যে পশুটি খরিদ করেন, তাহাও সম্পূর্ণ ত্যাগ নহে। কেননা মাংসাকারে তার অধিকাংশই গৃহে প্রত্যার্বতন করে সামান্যই হয় দান। এই সামান্য স্বার্থ ত্যাগের বিনিময়ে যদি দাতার স্বর্গলাভ হইতে পারে, তবে কোরবানির পশুর স্বর্গলাভ হইবে কিনা? যদি না হয়, তবে ঐ সকল পশুর আত্মত্যাগের সার্থকতা কি? আর যদি হয়, তবে সকল পশুর হইবে কিনা; অর্থাৎ অসদুপায়ে অর্জিত (হারাম) অর্থে দেওয়া কোরবানির পশুর স্বর্গ লাভ হইবে কিনা? যদি না হয়, তবে ঐ সকল পশুর অপরাধ কি?
বাইবেল তথা তৌরাত পুণ্যার্থে বাহুল্যরূপে গোহত্যার বিবরণ পাওয়া যায়। হজরত ইব্রাহিম ঐ মতের প্রবর্তক বা সমর্থক ছিলেন এবং হজরত মোহাম্মদ (সঃ) ঐ মত সমর্থন করিয়া গিয়াছেন। অতি প্রাচীনকাল হইতেই মানুষ গোপালন করিয়া আসিতেছে – দুগ্ধপ্রাপ্তির ও কৃষিকাজের জন্য। কিন্তু মরুময় আরবদেশে কৃষিকাজ “নাই” বলিলেই চলে। সুতরাং ওদেশে দুগ্ধবতী গাভী কাজে লাগিলেও বলদগুলি কোন কাজেই লাগে না। তাই আরব দেশের লোকে পূণ্যার্থেই হউক আর ভোজার্থেই হউক,বাহুল্যরূপেই গোহত্যা করিতেন। কাজেই ঐ দেশীয় ধর্মশাস্ত্রগুলিতেও গোহত্যার ব্যবস্থা দেখা যায়। পক্ষান্তরে, ভারতবর্ষ চিরকালই কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে গোজাতি মানুষের পরম উপকারী পশু। কৃষিকাজের সহায়ক বলিয়া আর্যগণ “গোহত্যা” অন্যায় মনে করিতেন। তাই তাহাদের ধর্মশাস্ত্রেও “গোহত্যা মহাপাপ” বলিয়া উল্লেখ আছে। আর্যগণ মনে করিতেন গাভী আমাদিগকে দুগ্ধ দান করে, সুতরাং সে মাতৃ-সমতুল্যা এবং বলদ কৃষিকাজের সহায়ক হইয়া আমাদিগকে প্রতিপালন করে, তাই সে পিতৃ-সমতুল্য, কাজেই উহারা আমাদের সম্মানের ও পূজার পাত্র। অধিকন্তু হিন্দুগণ ছাগ ভক্ষণ করে, অথচ দুগ্ধদাতৃ বলিয়া ছাগী ভক্ষণ করে না। কিন্তু “দুগ্ধদাতৃ” বলিয়া কোন পশুর প্রতি মুসলমানদের কৃতজ্ঞতা নাই।
কৃষি প্রধান দেশগুলিতে আজও ব্যাপক গরুর দ্বারা কৃষিকাজ চলিতেছে। যদিও কচিৎ ট্রাক্টরাদি যান্ত্রিক চাষাবাদের চেষ্টা চলিতেছে, উহা কবে যে গরুর চাহিদা মিটাইবে, তাহা আজও বলা যায় না। সুতরাং কৃষি প্রধান দেশগুলিতে “গোহত্যা” ক্ষতিজনক নয় কি?
২২। পাথর চুম্বন কেন?
যে সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমান পবিত্র মক্কা শহরে হজ্বক্রিয়া সম্পাদন করিতে যায় তাঁহাদের কতগুলি বিশেষ নীতি পালন করিতে হয়। যথা-তওয়াফ (কাবাগৃহ প্রদক্ষিণ), এহরাম বাঁধা, সাফা-মারওয়া দৌড়, কঙ্কর নিক্ষেপ ও “হেজরল (হজরতে?) আসোয়াদ” নামক পাথর চুম্বন ইত্যাদি। শেষোক্ত “হজরতে আসোয়াদ” একখানা কালো রং-এর পাথর। ঐ পাথরখানা নাকি পাহাড়াদির সাধারণ পাথর নয়। শোনা যায় যে, কোন এক সময় ঐ পাথরখানা বেহেস্ত (আকাশ?)হইতে পতিত হইয়াছিল। তাই মক্কার লোকে ঐ পাথরখানাকে যথেষ্ট তাজিম করিতেন। বহুদিন ঐ পাথরখানা উন্মুক্ত জায়গায় পতিত ছিল। অতঃপর পবিত্র কাবাগৃহ মেরামতের সময় ঐ পাথরখানা কাবাগৃহের দেওয়ালের সঙ্গে গাঁথিয়া সযত্নে রক্ষা করা হইয়াছে। হাজীগণকে ঐ পাথরখানা সম্মানের সাথে চুম্বন করিতে হয়।
পিতা-মাতা স্নেহবশে শিশুদের মুখ চুম্বন করে এবং প্রেমাশক্তিবশে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মুখ চুম্বনও করিয়া থাকে। যাহাকে চুম্বন করা হয়, তাহার মমতাবোধ বা সুখানুভূতি থাকা আবশ্যক। যাহার মমতাবোধ বা সুখানুভূতি নাই, তাহাকে চুম্বন করার কোন মূল্য থাকিতে পারে না। “হযরতে আসোয়াদ” চেতনাবিহীন একখণ্ড নিরেট পাথর মাত্র। উহাকে চুম্বন করিবার উপকারিতা কি? উহাকে চুম্বন করিলে তাহাতে আল্লাহতায়ালা খুশি হন কেন? নির্জীব ও অচেতন একখানা কালো পাথরকে এতাধিক সম্মান প্রদর্শনের কারণ উহা বেহেস্তী পাথর। তাই নয় কি?
একদা হজরত ওমর (রাঃ) কাবার হযরতে আসোয়াদ পাথরকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছিলেন
“হে কালো পাথর, রসুলুল্লাহ (দঃ) যদি তোমাকে চুম্বন না করিতেন, তবে আমি তোমাকে চুম্বন
তো করিতামই না, বরং কাবাগৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া তোমাকে দূরে নিক্ষেপ করিতাম।”(১৫)
জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সুদূর অতীতকালে কোন নক্ষত্রের আকর্ষণের ফলে সূর্যের জ্বলন্ত বাষ্পীয় দেহের খানিকটা ছিন্ন হইয়া দূরান্তে গিয়া কুণ্ডলী পাকাইতে পাকাইতে পৃথিবীর জন্ম হয়। প্রথমতঃ উহা জ্বলন্ত বাষ্পাকারে ছিল। ক্রমে শীতল হইয়া তরল অবস্থা প্রাপ্ত হয়। কালক্রমে আরও শীতল হইয়া পৃথিবীর বহির্ভাগ কঠিন হইতে থাকে। কিন্তু অভ্যন্তরভাগ তরল অবস্থায়ই থাকে। পৃথিবীর বহিরাবরণ শীতল ও কঠিন হইয়া সঙ্কুচিত হইবার ফলে ভূ-গর্ভস্থ তরল পদার্থের উপর যে পরিমাণ চাপ পড়িতে থাকে, অভ্যন্তরভাগের তরল পদার্থ তাপ ত্যাগ করিয়া ঐ পরিমাণ সঙ্কুচিত হইতে না পারিয়া সময় সময় পৃথিবীর বহিরাবরণ ভেদ করিয়া ফোয়ারার আকারে ঊর্ধ্বে উঠিতে থাকে। এইরূপ তরল পদার্থের উদ্‌গীরণ সময় সময় এত অধিক শক্তিসম্পূর্ণ হইত যে, উহা পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির বাহিরে চলিয়া যাইত এবং মহাকাশের শীতলস্পর্শে শীতল হইয়া কঠিন পাথরের আকার প্রাপ্ত হইত ও মহাকাশে ইতস্তত ভাসিয়া বেড়াইত। কালক্রমে পৃথিবী আরও শীতল ও কঠিন হইয়া প্রাণীবাসের যোগ্য হইয়াছে এবং মহাকাশে ঐ ভাসমান পাথরগুলি আজও ভাসিয়া বেড়াইতেছে। উহারা মহাকাশে ভাসিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে কোন কোন সময় পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের সীমার ভিতরে আসিয়া পড়ে এবং পৃথিবীর আকর্ষণের ফলে ভূপতিত হইতে থাকে। ভূপতিত হইবার সময় বায়ুর ঘর্ষণে উহারা প্রথমতঃ উত্তপ্ত হয়, পরে জ্বলিয়া উঠে। ঐ সকল পাথরকে “উল্কাপিণ্ড” বলে। কিন্তু সাধারণ লোকে বলে “তারা খসা”(১৬)। উল্কাপিণ্ডগুলি ওজনে দুই-তিন ছটাক হইতে বিশ-পঁচিশ মণ বা ততোধিক ভারি হইয়া থাকে। যে সকল উল্কাপিণ্ড আকারে ছোট, তাহারা জ্বলিয়া মধ্যপথে নিঃশেষ হইয়া ভষ্মে পরিণত হয় এবং যেগুলি আকারে বড়, তাহারা জ্বালিয়া নিঃশেষ হইতে পারে নাই, আধাপোড়া অবস্থায় সশব্দে ভূপতিত হয়। দহনের ফলে সাধারণত উহাদের রং হয় কালো।
ঐ রকম উল্কাপিণ্ড লোকালয়ে পতিত হইলে লোকে উহা সংগ্রহ করিয়া সযত্নে রক্ষা করে। ঐ রূপ সংগৃহীত অনেক আধপোড়া উল্কাপিণ্ড বড় বড় মিউজিয়মে বিশেষত কলিকাতা মিউজিয়মেও রক্ষিত আছে। পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে যে, উল্কার দেহ ও পৃথিবীর মাটি-পাথর একই উপাদানে গঠিত। সুতরাং বুঝা যাইতেছে যে, উল্কাপিণ্ডগুলি পৃথিবীর অংশ বিশেষ এবং সুদূর অতীতকালে উহারা পৃথিবীতেই ছিল।
“হেজরল (হজরতে?) আসোয়াদ” পাথরখানা ঐরকম একখণ্ড উল্কাপিণ্ড নয় কি?
লেখকঃ আরজ আলী মাতুব্বর

No comments:

Post a Comment