Wednesday, May 23, 2018

১১. সাম্রাজ্যবাদী বাসনা


প্রাচীন রোমান শাসকদের কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল। পৃথিবীর অধিকাংশ বড় বড় সাম্রাজ্যের মতোই, রোমানরাও প্রায়ই যুদ্ধকালীন ছোট ছোট লড়াইয়ে একের পর এক পরাজিত হতো, কিন্তু শেষমেষ যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় তারাই ছিনিয়ে আনত। কোন সাম্রাজ্য ছোট-খাট এইসব সাময়িক পরাজয় মেনে নিয়ে মাথা সোজা করে দাঁড়াতে না পারলে বা নতুন উদ্যমে লড়াই শুরু না করতে পারলে সেটা প্রকৃতপক্ষে কোন সাম্রাজ্যই নয়। সর্বদা হার-জিতে অভ্যস্ত এই রোমানরাও খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি উত্তর আইবেরিয়া (Iberia) থেকে আসা একটি সংবাদে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল। একটি পুঁচকে, নগণ্য পাহাড়ি শহর নুমানশিয়া (Numantia), সাগরবেষ্টিত আদিবাসী সেল্টরা (Celt) ছাড়া আর কেউ যেখানে থাকে না, তারা নাকি বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের বশ্যতা অস্বীকার করেছে! মেসিডোনিয়ান এবং সেলুসিড সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করে, গ্রিসের বিখ্যাত নগররাষ্ট্রগুলোকে নিজের আয়ত্তে এনে আর কার্থেজ নগরীকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে রোম তখন ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের সমস্ত ভূভাগের একচ্ছত্র অধিপতি। আর অন্যদিকে স্বাধীনতার তীব্র আাকাঙ্ক্ষা আর এবড়ো-থেবড়ো পাহাড়ী জমি ছাড়া নুমানশিয়ানদের সম্বল বলতে আর কিছুই নেই। তারপরও তারা হাজার হাজার সৈন্যের রোমান বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে যায় নি বা তাদের কাছে নতি স্বীকার করেনি।
১৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমানদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। তাদের উচ্চতম রাষ্ট্রীয় পরিষদ নুমানশিয়ানদের শায়েস্তা করার জন্য সিপিও এমিলিনাসকে (Scipio Aemilianus) মনোনীত করলেন । সিপিও ছিলেন রোমের সামরিক বাহিনীর প্রধান এবং তার নেতৃত্বেই রোমানরা কার্থেজ নগরকে গুড়িয়ে দিয়েছিল। এই কাজের জন্য নিয়োগ করা হল ত্রিশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী। সিপিও নুমানশিয়ানদের লড়াকু মনোভাব এবং সমরকৌশলকে সম্মান করতেন, তাই নিজেদের সৈন্যদের অযথা প্রাণহানি এড়ানোর জন্য তিনি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থেকে নিজেদের বিরত রাখলেন। এর পরিবর্তে তিনি নিলেন এক অভিনব রণকৌশল। তিনি নুমানশিয়ার চারপাশে বৃত্তাকার দুর্গ নির্মাণ করে নুমানশিয়া শহরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললেন এবং বাইরের দুনিয়ার সাথে নুমানশিয়ার যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। ক্ষুধাই রোমানদের প্রধান অস্ত্র হিসেবে কাজ করল। একবছরের একটু বেশি সময় পর নুমানশিয়ানের খাবারের যোগান নি:শেষ হয়ে এল। নুমানশিয়ানরা যখন বুঝতে পারল তাদের বাঁচার আর কোন আশা নেই, তারা নিজেরাই তাদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল এবং রোমান ঐতিহাসিকদের মতে, নুমানশিয়ানদের বেশিরভাগই নিজেদেরকে রোমানদের দাস হওয়া থেকে বাঁচাতে আত্মহত্যা করেছিল।
পরবর্তীকালে, নুমানশিয়া স্প্যানিশদের কাছে স্বাধীনতা এবং মনোবলের প্রতীক হয়ে ওঠে। ডন কুইক্সোট উপন্যাসের লেখক মিগুয়েল ডি সারভানতেস ‘নুমানশিয়া অবরোধ’ (The siege of Numantia) নামে একটি ট্র্যাজেডি লেখেন। এই ট্র্যাজেডির ইতি ঘটে নুমানশিয়া নগর ধ্বংসের ঘটনার মধ্য দিয়ে, কিন্তু তার সাথে যুক্ত হয় স্পেনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশাবাদ। নুমানশিয়ার স্বাধীনতাকামী লড়াকু সৈন্যদের জন্য কবি রচনা করেন বিজয়গাথা, নুমানশিয়া অবরোধের চিত্র শিল্পীর তুলির আঁচড়ে রাজকীয় মহিমায় ফুটে ওঠে ক্যানভাসে। ১৮৮২ সালে নুমানশিয়ার ধ্বংসাবশেষকে জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভের মর্যাদা দেয়া হয় এবং তা হয়ে ওঠে দেশপ্রেমিক স্প্যানিশদের জন্য এক তীর্থক্ষেত্র। ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকের বিখ্যাত স্প্যানিশ কমিকগুলোর মূল চরিত্র সুপারম্যান বা স্পাইডারম্যান ছিল না, ছিল এল হাবাতো (El Jabato), এক কাল্পনিক আইবেরিয়ান, যিনি রোমানদের দমন পীড়নের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। সেকালের নুমানশিয়ানরা আজ স্পেনের বীরত্ব আর দেশপ্রেমের প্রতীক আর তরুণ স্প্যানিশদের অনুকরণীয় আদর্শের নাম।
এতকিছুর পরেও, স্পেনের মানুষজন স্প্যানিশ ভাষাতেই নুমানশিয়ানদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। এটি একটা রোমান ভাষা এবং এই ভাষার উৎপত্তি হয়েছে সমরনায়ক সিপিও এর ল্যাটিন ভাষা থেকে। নুমানশিয়ানরা নিজেরা কথা বলত এক ধরনের সেল্টিক ভাষায় যা আজ বিলুপ্ত এবং মৃত। সারভানতেস তার ‘নুমানশিয়া অবরোধ’ ট্রাজেডি লিখেছেন ল্যাটিন লিপিতে এবং নাটকটিতে গ্রিস ও রোমের শিল্পভাষার ছাপ স্পষ্ট। নুমানশিয়ায় কোন নাট্যশালা ছিল না। নুমানশিয়ানদের বীরত্বে মুগ্ধ স্প্যানিশ দেশপ্রেমিকরাও রোমান ক্যাথলিক চার্চের অন্ধ অনুসারী। খেয়াল করার বিষয় হল, ‘রোমান ক্যাথলিক চার্চ’ বলতে এমন ক্যাথলিক চার্চ বোঝানো হচ্ছে যার নেতারা এখনও রোমেই থাকেন এবং যাদের ঈশ্বর চান তাকে ল্যাটিন নামে ডাকা হোক। একই ভাবে, আধুনিক স্পেনের আইন-কানুন উদ্ভূত হয়েছে রোমানদের আইন-কানুন থেকে, স্প্যানিশ রাজনীতির ভিত্তি হল রোমান রাজনীতি, তাদের খাবার দাবার এবং স্থাপত্যবিদ্যা যতটা না আইবেরিয়ায় সেল্টদের কাছে ঋণী, তার চেয়ে অনেক বেশি ঋণী রোমান সাম্রাজ্যের কাছে। নুমানশিয়ার ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই। এমনকি নুমানশিয়ানদের এই ইতিহাসটুকুও জানা গেছে রোমান ঐতিহাসিকদের লেখা থেকেই। স্বাভাবিকভাবেই, এই ইতিহাস লেখা হয়েছে রোমান পাঠকদের রুচির জন্য উপযোগী করে এবং এতে নুমানশিয়ানদের কাহিনীতে রঙ চড়িয়ে তাদের স্বাধীনতাকামী বর্বর হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নুমানশিয়ানদের সাথে রোমের বিজয় এতটাই সর্বগ্রাসী ছিল যে, তারা পরাজিত শক্তির ইতিহাসও নিজের মত করে তৈরি করে নিতে পেরেছে।
এ ধরনের গল্প পাঠকপ্রিয়তা পায় না। আমরা সাধারণত দুর্বলের জয় দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু, ইতিহাস ন্যায়বিচারের ধার ধারে না। অতীতের অধিকাংশ সংস্কৃতিই কখনও না কখনও কোনও না কোনও নির্দয় সাম্রাজ্যের শিকারে পরিণত হয়েছে এবং হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে। সাম্রাজ্যের নিজের পতনও অবশ্যম্ভাবী কিন্তু একটি সাম্রাজ্য তার অস্তিত্বের স্থায়ী ছাপ রেখে যায় পরবর্তী সময়ের কাছে। আজকের একবিংশ শতকের প্রায় সব মানুষ কোন না কোন সাম্রাজ্যের উত্তরসূরী।
কাকে বলে সাম্রাজ্য?
সাম্রাজ্য হল এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামো যার দুটো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। প্রথমত, সাম্রাজ্যের খেতাব পাবার জন্য আপনাকে এমন কিছু মানুষকে শাসন করতে হবে যাদের সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক পরিচয় আলাদা। প্রশ্ন হতে পারে, এরকম কত ধরনের ভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক পরিচয়ের মানুষ শাসন করলে তাকে সাম্রাজ্য বলা যাবে? দুই বা তিন রকম ভিন্নতা সাম্রাজ্যের জন্য যথেষ্ট নয়। আবার বিশ বা ত্রিশ ধরনের ভিন্নতা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার পরিমাণ হওয়া উচিত এই দুইয়ের মাঝামাঝি কোন সংখ্যা।
দ্বিতীয়ত, সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানা নির্দিষ্ট নয় এবং তা যত খুশি বিস্তৃত হতে পারে। একটি সাম্রাজ্য নতুন নতুন জাতি এবং রাজ্যকে তাদের অধীনে আনতে পারে নিজের মূল কাঠামো বা জাতিসত্তার পরিবর্তন না ঘটিয়েই। আজকের ব্রিটিশ রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানাটা নির্দিষ্ট। এই ভৌগোলিক সীমানাটা এতটুকু বাড়াতে চাইলেও সেটা ব্রিটিশ রাষ্ট্রকাঠামো বা জাতিসত্তার কোন মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব হবে না। অথচ, একশ বছর আগেও পৃথিবীর যে কোন স্থানই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হতে পারত।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ভৌগলিক সীমারেখার নমনীয়তা সাম্রাজ্যকে শুধু একটা নতুন আঙ্গিক দেয় তা নয়, বরং এ দুটি বৈশিষ্ট্যই ইতিহাসে সাম্রাজ্যের মূল ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দেয়। এই দু’টো বৈশিষ্ট্যের কারণে সাম্রাজ্য বিভিন্ন জাতি-বর্ণ-আবহাওয়া-জলবায়ুর মানুষকে একই রাজনৈতিক ছাতার নিচে আনতে পারে এবং পৃথিবীর বৃহৎ থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ক্রমাগত: একত্রিত করার প্রক্রিয়ার সূচনা করে।
এখানে যে ব্যাপারটা গুরুত্বের সাথে বলা দরকার তা হল, একটি সাম্রাজ্যের পরিচয় কেবল তার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং নমনীয় ভৌগোলিক সীমানা দ্বারাই নির্ধারিত হয়ে থাকে। উৎপত্তিস্থল, শাসন কাঠামো, ভৌগোলিক বিস্তৃতি বা জনসংখ্যা সাম্রাজ্যের পরিচয় নির্ধারণ করে না। একটা সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়ের জন্য সামরিক অভিযানও অপরিহার্য নয়। এথেন্স সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল একটি স্বেচ্ছাসেবক দল হিসেবে, হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যের উৎপত্তি হয়েছিল বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে, বিয়ের মাধ্যমে অনেকগুলো পরিবারকে জোড়া দিয়েই তৈরি হয়েছিল এই সাম্রাজ্যের ভিত। সাম্রাজ্যের জন্য একজন সম্রাটের শাসন থাকারও বাধ্যবাধকতা নেই। এ পর্যন্ত মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসন পদ্ধতি ছিল গণতান্ত্রিক। অন্যান্য গণতান্ত্রিক (বা নিদেনপক্ষে প্রজাতান্ত্রিক) সাম্রাজ্যগুলোর মাঝে আছে আধুনিক ওলন্দাজ, ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং আমেরিকার সাম্রাজ্য এবং প্রাক-আধুনিক যুগের নভগোর‌্যাড, রোম, কার্থেজ এবং এথেন্স।
সাম্রাজ্যের জন্য আয়তন বা জনসংখ্যাও তেমন কোন জরুরি বিষয় নয়। খুব ছোট আয়তনের সাম্রাজ্যের অস্তিত্বও ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায়। এথেন্স সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে আয়তন ও জনসংখ্যায় এথেন্স ছিল আজকের গ্রিসের তুলনায় অনেক ছোট। আজকের দিনের মেক্সিকোর থেকে অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল অনেক কম। তা সত্ত্বেও এথেন্স এবং অ্যাজটেক ছিল সাম্রাজ্য, কিন্তু আজকের গ্রীস বা মেক্সিকো সাম্রাজ্য নয়। কারণ, এথেন্স এবং অ্যাজটেক শাসন করত কয়েক ডজন থেকে শুরু করে কয়েকশ ভিন্ন রাজনৈতিক কাঠামোকে, একালের গ্রিস বা মেক্সিকো যেটা করে না। এথেন্স কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল একশরও বেশি স্বাধীন নগররাষ্ট্রের উপর, অন্যদিকে অ্যাজটেক, তার খাজনার দলিল অনুযায়ী, শাসন করেছিল তিনশ একাত্তরটি ভিন্ন গোত্রের মানুষকে।১
এত সব ভিন্ন গোত্র, দল এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মানুষকে কী করে একালে একটি অাধুনিক রাষ্ট্রের সীমানার ভেতর আনা সম্ভব হলো? এটা সম্ভব হয়েছে কারণ অতীতকালে পৃথিবীতে যে ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক পরিচয়ের মানুষের বসবাস ছিল, তাদের প্রত্যেকের দলের সদস্য সংখ্যা ছিল অল্প এবং তাদের অধিকৃত ভূমির পরিমাণও ছিল আজকের দিনের মানুষের তুলনায় কম। ভূমধ্যসাগর এবং জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী যে ভূমি নিয়ে আজ মূলত দুজন মানুষের অহংকারের লড়াই চলছে, সে সময় এই ভূমিতেই ঠাঁই হত কয়েক ডজন জাতি, গোত্র, ছোট রাজ্য এবং নগর রাষ্ট্রের।
মানুষের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আকস্মিকভাবে হ্রাস পাওয়ার একটা প্রধান কারণ সাম্রাজ্যের উত্থান। সাম্রাজ্যবাদী শাসনের স্টিমরোলার মানুষের নানারকম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যেকে পিষে ফেলে সবাইকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে সাম্রাজ্যবাদী রীতিনীতির ছাঁচে (উদাহরণস্বরূপ নুমানশিয়ানদের কথা স্মরণ করা যেতে পারে) এবং তৈরি করেছে অনেক বড় আকারের মানব সংগঠন।
সাম্রাজ্য কি তবে শয়তান?
আধুনিককালে রাজনীতিতে নেতিবাচক শব্দগুলির মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলতা বা ফ্যাসিজমের পরই সাম্রাজ্যবাদকে স্থান দেয়া হয়। সমালোচকেরা সাম্রাজ্যবাদের যেসব নেতিবাচক দিকের কথা বলেন সেগুলোকে মোটামুটি দু’টো শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-
প্রথমত, সাম্রাজ্যবাদ একটি অকার্যকর প্রক্রিয়া। সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ায় জয় করা বিপুল জনগোষ্ঠীকে দীর্ঘমেয়াদে সুষ্ঠুভাবে শাসন করা সম্ভবপর হয় না।
দ্বিতীয়ত, যদি সেটা কোনভাবে সম্ভবও হয়, তারপরও সাম্রাজ্যবাদকে বর্জন করা উচিত। কারণ, সাম্রাজ্যবাদ হল ধ্বংস আর শোষণের হাতিয়ার। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিজেদের সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার আছে এবং তাদেরকে কোনোভাবেই অন্যের শাসনের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করা উচিত নয়।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, প্রথম দাবিটি একেবারেই অচল এবং দ্বিতীয়টি নানাবিধ দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ।
বাস্তবতা হল, গত আড়াই হাজার বছর ধরে দুনিয়া জুড়ে সাম্রাজ্য ছিল সবচেয়ে বেশি প্রচলিত রাজনৈতিক সংগঠন। এই আড়াই হাজার বছর ধরে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ কোনো না কোনো সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাস করেছে। সাম্রাজ্যের সরকারব্যবস্থার স্থিতিশীলতার ব্যাপারটিও প্রশ্নাতীত। বেশিরভাগ সাম্রাজ্যই খুব সহজে তার বিদ্রোহীদেরকে দমন করতে পেরেছে। মোটাদাগে বলতে গেলে, বেশিরভাগ সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে প্রধানত বহিঃশত্রুর আক্রমণে অথবা তারা বিভক্ত হয়েছে শাসকদের মতবিরোধের কারণে। অপরদিকে, সাম্রাজ্যের বিজিত জনগণ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের কাছ থেকে তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে এমন নজির তেমন একটা চোখে পড়ে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা শত শত বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। কালক্রমে, তারা হয়ে পড়েছে বিজয়ী সাম্রাজ্যের অংশ, ধীরে ধীরে মুছে গেছে তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আর পরিচয়।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয় কিছু জার্মানিক গোষ্ঠীর (Germanic tribes) হাতে। কিন্তু একথা ভাবলে ভুল হবে যে, এরপর নুমানশিয়া, আরভারনি কিংবা হ্যালভেশিয়ানদের মত অধীনস্থ গোষ্ঠীগুলো রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। এমন গল্প হয়তো পুরাণে পাওয়া যায়। যেমন, ইউনুস নবী (Jonah) অনেকটা সময় মাছের পেটে থাকার পরও অক্ষত অবস্থায় মাছের পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে এমন নজির দেখা যায় না। স্বাভাবিকভাবেই রোমান অধীনস্থ গোষ্ঠীগুলোর কোনটাই আর টিকতে পারেনি। তাদের পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে যারা যারা নিজেদেরকে তাদের সাম্রাজ্য পূর্ববর্তী গোত্র বা দলের সদস্য বলে পরিচয় দিত, কথা বলতো তাদের নিজেদের ভাষায়, উপাসনা করতো তাদের নিজস্ব দেব-দেবীকে এবং প্রচার করতো নিজেদের গোত্রের বীরত্বগাথা, আজ তাদের চিন্তা, ভাষা, আরাধনা সবই রোমানদের মত, যদিও রোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটেছে অনেককাল আগেই।
অনেকক্ষেত্রেই, সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি আর সাম্রাজ্যের অধীন মানুষগুলোর স্বাধীনতা – ব্যাপার দুটো সমার্থক ছিল না। বরং, একটা সাম্রাজ্যের পতনের পরপরই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য সেখানে আরেকটি সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটত। মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। এখানকার বর্তমান রাজনৈতিক বলয় কতগুলো পৃথক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ক্ষমতার ভারসাম্য দ্বারা নির্মিত যাদের প্রত্যেকের স্থায়ী বা অস্থায়ী ভৌগোলিক সীমানা আছে। মধ্যপ্রাচ্যের এরকম রাজনৈতিক অবস্থা বিগত কয়েকটি সহস্রাব্দে দেখা যায়নি। শেষ যেবার মধ্যপ্রাচ্য এরকম রাজনৈতিক অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল সেটা ছিল ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, প্রায় তিন হাজার বছর আগে! খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে নিও-অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের উত্থানের পর থেকে বিংশ শতকের মধ্যভাগে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত সময়টাতে মধ্যপ্রাচ্যকে রিলে রেসের ছড়ির মত এক সাম্রাজ্য থেকে আরেক সাম্রাজ্যের অধীনে যেতে হয়েছে। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সাম্রাজ্য তাদের শাসনের ছড়িটা যখন ছেড়ে দিল, ততদিনে তাদের পূর্ববর্তী স্বাধীন জাতি আরামানস (Aramaeans), এমোনাইটস (Ammonites), ফিনিশিয়ানস (Phoenicians), ফিলিস্তিন (Philistines), মাবাইট (Moabites) এসবের স্বাধীন অস্তিত্ব আর নেই। অনেক কাল আগেই তারা হারিয়ে গেছে কালের অতল গহ্বরে।
একথা সত্য, আজকের দিনের ইহুদি, আর্মেনিয়ান এবং জর্জিয়ানরা কিছু ন্যায়সঙ্গত যুক্তির সাহায্যে দাবি করেন তারা প্রাচীন মধ্য এশিয়ায় বসবাসকারী মানুষজনের বংশধর। এদের দাবিটুকু নিঃসঙ্গ ব্যতিক্রম হবার কারণে তা সাম্রাজ্যের প্রভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর পৃথক সাংস্কৃতিক পরিচয় অবলুপ্তির দাবিটি জোরালো করে তোলে। অনেকক্ষেত্রে ইহুদি, আর্মেনিয়ান এবং জর্জিয়ানদের দাবিকে অতিরঞ্জিতও মনে হয়। কারণ, একথা স্পষ্ট যে, বর্তমান কালের ইহুদিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক চিন্তা-চেতনা গত দুই সহস্রাব্দ ধরে তাদেরকে অধিকার করা সাম্রাজ্য দ্বারা যতটুকু প্রভাবিত, ইহুদিদের প্রাচীন রাজ্য যিহূদিয়ার (Judaea) রীতি-নীতি দ্বারা ততটুকু প্রভাবিত নয়। যদি ইসরাইলের দ্বিতীয় রাজা ডেভিড আজ কোন ঘোর রক্ষণশীল ইহুদি উপাসনালয়েও উপস্থিত হন, তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করবেন সেখানকার লোকজনের পরনে পূর্ব ইউরোপীয় পোশাক, তারা কথা বলছে জার্মানির একটি আঞ্চলিক ভাষায় (Yiddish) এবং ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে তারা একটি ব্যবলিনীয় ধর্মগ্রন্থের (The Talmud) পাঠোদ্ধার নিয়ে বাক-বিতণ্ডা চালিয়ে যাচ্ছে।
সাধারণত একটি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষ হত্যা এবং বিজিতদের উপর নির্মম নির্যাতনের দরকার পড়ে। একটি সাম্রাজ্য গঠনের জন্য প্রচলিত উপকরণগুলি হল – যুদ্ধ, দাসপ্রথা, নির্বাসন এবং গণহত্যা। ৮৩ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা যখন স্কটল্যান্ড আক্রমন করে, তখন তারা স্থানীয় ক্যালেডোনিয়ান গোত্রের (Caledonian) কাছ থেকে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় এবং ফলশ্রুতিতে রোমানরা পুরো দেশটাকে শ্মশানে পরিণত করে। রোমানদের শান্তি প্রস্তাবে ক্যালেডোনিয়ান নেতা ক্যালগাকাস (Calgacus) রোমানদের ‘দুনিয়ার সেরা সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেন এবং বলেন “লুণ্ঠন, গণহত্যা আর ডাকাতিকে তারা সাম্রাজ্যপ্রতিষ্ঠা নামে অভিহিত করে আর একটি জনপদকে শ্মশানে পরিণত করার নাম দেয় ‘শান্তিস্থাপন’”।২
এসবের মানে এই নয় যে, সাম্রাজ্যের উত্থান মানুষের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেনি। সাম্রাজ্যকে ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করে তার সকল উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করা হলে মানবজাতির অধিকাংশ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেই অস্বীকার করতে হয়। সাম্রাজ্যের উঁচু পদে থাকা লোকজন রাজ্য অধিকারের ফলে অর্জিত মুনাফা কেবল সামরিক বাহিনী এবং দুর্গ নির্মাণেই ব্যয় করতেন না, তার একটি অংশের বরাদ্দ হত দর্শন, শিল্প, আইন এবং সেবামূলক কাজে। মানুষের সাংস্কৃতিক অগ্রগতির একটি বড় অংশ তাদের অস্তিত্বের জন্য বিজিত জনগণের শোষণের ফলে পাওয়া সম্পদের কাছে ঋণী। রোমান সাম্রাজ্যের অগ্রগতি এবং অর্জিত মুনাফাই নিশ্চিত করেছিল সিসেরো (Cicero), সেনেকা (Seneca) এবং সেইন্ট অগাস্টিনের (St Augustine) মত মানুষদের চিন্তাভাবনা এবং লেখালেখির জন্য প্রয়োজনীয় অবসর এবং আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা। মুঘলদের ভারত লুঠ করে জমানো টাকা-কড়ি ছাড়া তাজমহল নির্মাণ সম্ভব হত না। হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্য স্ল্যাভিক, হাঙ্গেরিয়ান ও অন্যান্য রোমান ভাষা-ভাষী অঞ্চলগুলো শাসন করে যে মুনাফা পেত, সেখান থেকেই দেয়া হত সুরকার হেইডেন (Haydn) এর পারিশ্রমিক এবং সঙ্গীতগুরু মোজার্টের ভাতা। কোনও ক্যালেডোনিয়ান লেখক ক্যালগাকাস (Calgacus) এর বক্তৃতাকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিপিবদ্ধ করে যাননি। ক্যালগ্যাকাসের বক্তৃতার ব্যাপারে আমরা জানতে পারি রোমান ঐতিহাসিক ট্যাসিটাসের (Tacitus) বয়ান থেকে এবং সম্ভবত, বক্তৃতাটি ট্যাসিটাসের নিজেরই বানানো। বেশিরভাগ ঐতিহাসিক ইদানীং এ ব্যাপারে একমত হন যে, ট্যাসিটাস কেবল ক্যালগ্যাকাসের বক্তৃতাটিই বানাননি, সমরনায়ক ক্যালগাকাসের চরিত্রটিই তার কল্পনাপ্রসূত। তিনি ক্যালগাকাস চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন নিজের দেশ সম্পর্কে তার নিজের এবং উঁচু শ্রেণীর রোমানদের যে ধারণা সেটি তার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেবার জন্য।
এমনকি যদি আমরা ধনীদের সংস্কৃতি এবং উচ্চ মার্গের শিল্পকলা থেকে চোখ ফিরিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনের দিকেও তাকাই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আধুনিককালের মানুষের জীবনযাপন ও সংস্কৃতির মাঝে পাওয়া যাবে সাম্রাজ্যের প্রভাব। আজকের দিনে আমরা প্রায় সবাই কথা বলি নানা সাম্রাজ্যের মূল ভাষায়, যেসব ভাষা আমাদের পূর্বপুরুষদের উপর পেশীশক্তির প্রভাবে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ মানুষ হ্যান (Han) সাম্রাজ্যের ভাষায় কথা বলে, স্বপ্ন দেখে। বংশপরিচয় যাই হোক, আলাস্কার ব্যারো উপদ্বীপ থেকে শুরু করে ম্যাগেলান প্রণালী পর্যন্ত, আমেরিকার দুই মহাদেশের সবাই স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ফরাসি এবং ইংরেজি এই চারটি সাম্রাজ্যভাষার কোনো একটি ব্যবহার করে। আজকের মিশরের অধিবাসীরা আরবী ভাষায় কথা বলে, নিজেদের আরব ভাবতে এবং আরব সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। অথচ এই আরবরাই সপ্তম দশকে মিশর দখল করেছিল এবং তাদের আইনের পরিপন্থী যে কোন মিশরীয় বিদ্রোহকে শক্ত হাতে দমন করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু গোত্রের প্রায় এক কোটি মানুষ আজও তাদের উনিশ শতকের গৌরবময় দিনের স্মৃতিচারণ করে, অথচ তাদের অধিকাংশই সেই সব মানুষের বংশধর, যারা জুলু সাম্রাজ্যবিস্তার রুখতে একদিন প্রাণপণে লড়াই করেছিল।
যা কিছু হচ্ছে, ভালোর জন্যই হচ্ছে
প্রথম যে সাম্রাজ্যের ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে জানা যায় তা হল সম্রাট সারগন এর আক্কাদিয়ান সাম্রাজ্য (সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ২,২৫০ অব্দ)। সারগন মেসোপটেমিয়ার একটি ছোট্ট নগর রাষ্ট্র কিশ (Kish) এর রাজা হিসেবে তার পেশাগত জীবন শুরু করেন। কয়েক দশকের মধ্যে তিনি মেসোপটেমিয়ার অন্যান্য নগর রাষ্ট্র এবং মেসোপটেমিয়ার বাইরের অনেক বড় বড় ভূখণ্ড জয় করেন। সারগন গর্বভরে বলতেন, তিনি সমগ্র পৃথিবী জয় করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তার রাজত্ব ছিল পারস্য উপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অর্থাৎ আজকের ইরাক ও সিরিয়ার বেশিরভাগ অংশ এবং ইরান ও তুরস্কের সামান্য কিছু অংশ জুড়ে ছিল তার সাম্রাজ্যের বিস্তার।
সারগনের মৃত্যুর পর আক্কাদিয়ান সাম্রাজ্য আর বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিন্তু, সারগন রেখে গেছেন এমন কিছু সাম্রাজ্যবাদী দীপশিখা যা রয়ে গেছে আপন মহিমায় ভাস্বর। পরবর্তী ১,৭০০ বছর জুড়ে অ্যাসিরিয়ান, ব্যাবিলনিয়ান এবং হিট্টি রাজাদের জন্য সারগণ ছিলেন অনুকরণীয় আদর্শ, তারাও গর্বভরে বলতেন, তারা সমগ্র পৃথিবী জয় করেছেন। এরপর, খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দে, পারস্যের সাইরাস দি গ্রেট এর চেয়েও বড় দম্ভোক্তি নিয়ে হাজির হলেন ইতিহাসের মঞ্চে।
Screen Shot 2017-07-10 at 2.30.52 PM.png
ম্যাপ ৪। আক্কাদিয়ান ও পারস্য সাম্রাজ্য
অ্যাসিরিয়ার রাজা কিন্তু সবসময় নিজেকে অ্যাসিরিয়ার রাজাই মনে করতেন। এমনকি যখন তিনি নিজেকে পুরো পৃথিবীর শাসক দাবি করেন, তখনও একটা ব্যাপার সবার কাছে স্পষ্ট ছিল যে, এসব কিছুই করা হচ্ছে অ্যাসিরিয়ার গৌরব বৃদ্ধির জন্য এবং সে কারণে রাজ্য দখল করা, জয় করা এসব নিয়ে অ্যাসিরীয়দের মাঝে কোন অনুশোচনা ছিল না। অন্যদিকে সাইরাস পুরো পৃথিবী শাসন করার দাবি করেই ক্ষান্ত হলেন না, বরং বিজিতদের তিনি বললেন, এসব কিছুই তিনি করছেন সব মানুষের জন্য। পারসিয়ানরা বলল- ‘আমরা তোমাদের কল্যাণের জন্যই তোমাদেরকে অধিকার করছি’। সাইরাস চাইতেন বিজিত লোকেরা তাকে ভালবাসুক এবং পারসিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ হবার জন্য তারা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করুক। পরাজিত রাজ্যের মানুষদের অনুমোদন পাওয়ার জন্য সাইরাসের সৃষ্টিশীল উদ্যোগের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল তার একটি আদেশ। এই আদেশে তিনি বলেন, নির্বাসিত ইহুদিরা চাইলে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে এসে সেখানে তাদের উপাসনালয় নির্মাণ করতে পারবে। এমনকি তিনি নির্বাসিতদের অর্থনৈতিক সহযোগিতারও আশ্বাস দেন। সাইরাস নিজেকে ইহুদিদের অধিকার করা একজন পারসিয়ান রাজা হিসেবে ভাবেননি- বরং তিনি নিজেকে ইহুদিদের রাজাও ভাবতেন এবং সে কারণে তাদের ভালোমন্দের দেখভাল করাকে নিজের দায়িত্ব মনে করতেন।
পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কল্যাণের জন্য সমস্ত পৃথিবী অধিকার করার ধারণাটা ছিল চমকপ্রদ। বিবর্তন অন্য সব স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মত মানুষকেও জেনোফোবিক (xenophobic, যারা অন্য দেশের মানুষজনকে অপছন্দ করে বা ভয় পায়) হিসেবে গড়ে তুলেছে। সেপিয়েন্স তার সহজাত জৈবিক প্রবৃত্তি থেকেই সমগ্র মানবজাতিকে সবসময় দুটি ভাগে ভাগ করে – ‘আমরা’ এবং ‘তারা’। ‘আমরা’ হল আপনার এবং আমার মত লোকজন যারা একই ভাষায় কথা বলে এবং একই ধর্ম ও রীতিনীতি অনুসরণ করে। ‘আমরা’ একে অপরের ভালো-মন্দের ভাগ নিতে রাজি, কিন্তু ‘তাদের’ ভালো-মন্দের ভাগ নিতে রাজি নই। ‘আমরা’ সবসময়ই ‘তাদের’ থেকে আলাদা ছিলাম এবং ‘তাদের’ কাছে ‘আমাদের’ কোন ঋণ বা ‘তাদের’ প্রতি ‘আমাদের’ কোন দায়-দায়িত্ব নেই। ‘আমরা’ ‘তাদের’ কাউকে ‘আমাদের’ এলাকায় দেখতে চাই না এবং ভুলবশত ‘তারা’ ‘আমাদের’ এলাকায় ঢুকে পড়লে যা কিছু ঘটবে সেসব নিয়ে ‘আমাদের’ এতটুকু মাথাব্যথা নেই। ‘তারা’ আসলে মানুষের পর্যায়েই পড়ে না। সুদানের ‘ডিনকা’ (Dinka) নামক জনগোষ্ঠীর ভাষায় ‘ডিনকা’ শব্দের অর্থ ‘জনগণ বা মানুষ’। সুতরাং, যারা ‘ডিনকা’ নয়, তারা মানুষই নয়। ডিনকাদের ঘোর শত্রু হল ‘নুয়ের’ (Nuer) জনগোষ্ঠী। নুয়েরদের ভাষায় ‘নুয়ের’ কী অর্থ বহন করে? তাদের ভাষায় ‘নুয়ের’ শব্দের অর্থ ‘আসল মানুষ’। সুদান মরুভূমি থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে আলাস্কা এবং উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়ার বরফঢাকা অঞ্চলে ইউপিকদের (Yupik) বাস। ইউপিকদের ভাষায় ‘ইউপিক’ শব্দের অর্থ কী? যা ভাবছেন ঠিক তাই, এর অর্থও ‘আসল মানুষ’!৩
সাইরাসের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারা জাতি বা গোষ্ঠীগত শ্রেষ্ঠত্বের অহংবোধের বিপরীতে গিয়ে সবাইকে নিয়ে এবং সবার জন্য ভাবার চেষ্টা করে। যদিও তার শাসনব্যবস্থায় প্রায়ই শাসক ও শাসিতের বর্ণগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে সামনে আনা হয়েছে, তা সত্ত্বেও সাইরাসের শাসনব্যবস্থাকে সকল স্থানের, সকল সময়ের মানুষের যৌথ অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা একটি একক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী মানবজাতি হল একটি বৃহৎ পরিবার- এখানে পিতামাতার প্রাধান্য যেমন আছে, তেমনি আছে সন্তানের কল্যাণের জন্য পিতামাতার দায়িত্বের নির্দেশ।
এই নতুন সাম্রাজ্যবাদী আদর্শ সাইরাস এবং পারসিয়ানদের হাত ঘুরে পৌঁছায় সম্রাট অালেকজান্ডার এর কাছে, তার থেকে এ আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে হেলেনীয় রাজা, রোমান সম্রাট, মুসলিম খলিফা ও ভারতীয় রাজবংশগুলোর কাছে এবং কালক্রমে এর প্রতিফলন দেখা যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকান প্রেসিডেন্টদের মাঝে। সাম্রাজ্যবাদের এই পরার্থপর রূপ কেবল যে সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের ন্যায্যতা তুলে ধরে আর সাম্রাজ্যের অধীন মানুষের সামষ্টিক বিদ্রোহের সম্ভাবনা কমায় তাই নয়, এই ধ্যান-ধারণা স্বাধীন ব্যক্তি মানুষকে সাম্রাজ্য বিস্তারের বিপরীতে প্রতিবাদ করতেও নিরুৎসাহিত করে।
মূলত মধ্য আমেরিকা, আন্দিজ পর্বত সংলগ্ন এলাকা এবং চীনে স্বাধীনভাবে পারসিয়ান সাম্রাজ্যবাদী আদর্শের অনুরূপ আরেকটি সাম্রাজ্যবাদী আদর্শের জন্ম হয়। চীনের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী, স্বর্গ (Tian) পৃথিবীর সকল কিছুর প্রকৃত অধিকর্তা। সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি বা পরিবারকে নির্বাচন করেন স্বর্গ এবং স্বর্গই সেই ব্যক্তি বা পরিবারকে শাসনের অনুমতি দেন। এরপর ওই ব্যক্তি বা পরিবার স্বর্গের অধীনস্থ সবকিছুর (Tianxia) আজ্ঞাবহ হয়ে সকল প্রজার কল্যাণের উদ্দেশ্যে রাজ্য শাসন করেন। সুতরাং, এখানেও দেখা যাচ্ছে ক্ষমতার চূড়ান্ত মালিকানার ব্যাপারটি বৈশ্বিক। যদি কোনও শাসক স্বর্গের অনুমতি হারান তবে তার পক্ষে একটি শহরও শাসন করা সম্ভব নয়। যদি কোনও শাসক স্বর্গের এই অনুমোদন বজায় রাখতে চান, তাহলে তাকে অবশ্যই ন্যায়বিচার এবং শান্তি-শৃঙ্খলার আদর্শকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। স্বর্গের এই অনুমোদন একই সাথে একের বেশি প্রার্থীকে দেয়া হবে না, সুতরাং একটি নির্দিষ্ট সময়ে একের বেশি আইনসঙ্গত, সুশৃঙ্খল স্বাধীন রাষ্ট্রের অনুমোদন দেওয়াও সম্ভব নয়।
চিন শি হুয়াংদি (Qín Shǐ Huángdì), একীভূত চীনের প্রথম সম্রাট, গর্বভরে ঘোষণা করেন যে, ‘মহাবিশ্বের ছয় দিকে যা কিছু আছে তার সবকিছু চীনা সাম্রাজ্যের অধীন, … পৃথিবীর যে প্রান্তে মানুষের পায়ের একটি ছাপও পড়েছে সেখানে এমন কোন মানুষ নেই যে এই সাম্রাজ্যের অধীন নয়, … সম্রাটের মহানুভবতা এমনকি গাভী এবং ঘোড়াদের কাছেও সুবিদিত। এমন কেউ নেই যে এই শাসনের ফলে উপকৃত হয়নি। সকলেই সম্রাটের শাসনের ছায়াতলে নিরাপদে এবং শান্তিতে আছে।’৪ চীনাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের মত চীনাদের রাজনৈতিক দর্শনও সাম্রাজ্যবাদী চীনকে ঐক্য এবং ন্যায়বিচারের এক স্বর্ণযুগ মনে করে। আধুনিক পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একটি ন্যায়পরায়ণ পৃথিবী অনেকগুলো পৃথক জাতি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত হওয়া উচিত। প্রাচীন চৈনিক বিশ্বে এই রাজনৈতিক বিভক্তকরণ ছিল অন্ধকার যুগের বিশৃঙ্খলা এবং অবিচারের মূর্ত প্রতীক। চীনের ইতিহাসে এরকম ভাবনা-চিন্তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। চীনে যখনই একটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে, তাদের বিরাজমান রাজনৈতিক ভাবধারা তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে ছোট ছোট তুচ্ছ স্বাধীন রাষ্ট্র বা সরকার বানিয়ে থিতু না হতে, তাদের উৎসাহিত করেছে পুনরায় একীভূত হতে। এবং কোন না কোনভাবে তাদের এই একীভূত হবার প্রয়াস সবসময় সফল হয়েছে।
যখন ‘তারা’ ‘আমাদের’ অন্তর্ভুক্ত হল
সাম্রাজ্য অনেকগুলো ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর পৃথক সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবসান ঘটিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অনুসরণ করা অল্প কিছু সাংস্কৃতিক পরিচিতির উদ্ভবের পেছনে প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন অনেকগুলো স্বাধীন এলাকার চেয়ে একটি সাম্রাজ্যে ধ্যান-ধারণা, মানুষ, পণ্য এবং প্রযুক্তি অনেক দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। কখনও কখনও সাম্রাজ্য নিজেই ধ্যান-ধারণা, প্রতিষ্ঠান, আইন এবং রীতি-নীতি প্রসারের দায়িত্ব নিয়েছে। সাম্রাজ্যের শাসকদের জীবন আরও আয়াসসাধ্য করা এ কাজের একটা প্রধান লক্ষ্য ছিল। প্রত্যেকটি ছোট ছোট এলাকার যদি নিজেদের আইন, নিজেদের লিখন পদ্ধতি, নিজস্ব ভাষা এবং নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা থাকে তাহলে সাম্রাজ্যের শাসকদের পক্ষে সবগুলো এলাকা শাসন করা সত্যিই কঠিন। সুতরাং, বিভিন্ন এলাকার এতসব ভিন্নতাকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় আনা সাম্রাজ্যের জন্য অপরিহার্য ছিল।
সাম্রাজ্যগুলো কেন সবার জন্য একটি সাধারণ আচরণবিধি বা সংস্কৃতির বিস্তার করেছিল তার দ্বিতীয় কারণটি হতে পারে- সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের প্রয়াস। অন্তত: সাইরাস এবং চিন শি হুয়াংদির সময় থেকে, সাম্রাজ্যগুলো জনগণকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, রাস্তা বানানো বা গণহত্যা যাই করা হোক না কেন তা সবার ভালোর জন্যই করা হচ্ছে; একটি উন্নত সংস্কৃতির বিস্তারের জন্য এসব জরুরী এবং তাতে লাভ যত না সাম্রাজ্যের শাসকদের, তার চেয়ে ঢের লাভ বিজিতদের।
কোনও কোনও সময় এই লাভ স্পষ্টভাবে দেখা যেত, যেমন- আইনের যথাযথ প্রয়োগ, নগর পরিকল্পনা, ওজন এবং পরিমাপের মাপকাঠি নির্দিষ্ট করা। আবার কখনও কখনও এই লাভ ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, যেমন- কর প্রদান, সেনাবাহিনীতে যোগদানের বাধ্যবাধকতা এবং সম্রাটের বন্দনা করা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থরা মনে করতেন তারা সাম্রাজ্যের সকল অধিবাসীদের কল্যাণের জন্যই কাজ করছেন। চীনের শাসক শ্রেণী তাদের প্রতিবেশী দেশের প্রজাদের অসভ্য, বর্বর, দুর্ভাগা মনে করত এবং তারা বিশ্বাস করত চীনা সাম্রাজ্যের অবশ্যই উচিত এই মানুষগুলোকে নিজেদের সাম্রাজ্যের অধীনে এনে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। চীনাদের উপর স্বর্গের যে আদেশ আছে তা কেবল দুনিয়াকে জয় করার জন্যই নয়, মানুষকে মানবতার শিক্ষা দেবার জন্যেও। ‘কিছু বর্বর মানুষকে আমরা শান্তি, সুবিচার এবং শিষ্টাচার সমৃদ্ধ জীবনের সন্ধান দিচ্ছি’ – এরকম দাবি করে রোমানরাও তাদের শাসনের ন্যায্যতা প্রমাণের চেষ্টা করত। বন্য জার্মান এবং গল সম্প্রদায়ের মানুষজনকে আইন শিক্ষা দিয়ে, তাদের গণ-গোসলখানায় গোসল করিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে, তাদের দর্শনের শিক্ষা দিয়ে উন্নত করার আগ পর্যন্ত তো তারা অপরিচ্ছন্নতা এবং অজ্ঞতার অন্ধকারেই নিমজ্জিত ছিল – এমনটাই ছিল রোমানদের বিশ্বাস। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মৌর্য সাম্রাজ্য সারা পৃথিবীর অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষকে গৌতম বুদ্ধের মহান শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তোলবার প্রয়াসে ব্রতী হয়েছিল। মুসলিম খলিফারা সম্ভব হলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে, তা না হলে তরবারির শক্তিতে সারা বিশ্বে মহানবীর উপলব্ধি ও বাণী ছড়িয়ে দেবার এক স্বর্গীয় আদেশ পেয়েছিলেন। স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজ সাম্রাজ্য ঘোষণা করেছিল, তারা ইন্দিজ পর্বতে ও আমেরিকায় ধন-সম্পদের সন্ধান করতে আসেনি, এসেছে মানুষকে সত্যিকারের বিশ্বাসের দীক্ষা দিতে, প্রকৃত ধর্মে তাদের ধর্মান্তরিত করতে। স্বাধীনতা ও মুক্ত বাজারের মত মহৎ ধারণার বিস্তার করার জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনও অস্ত যেত না। সোভিয়েতরা ধনতন্ত্র থেকে প্রলেতারিয়েত বা সাধারণ মানুষের হাতে কাল্পনিক ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ইতিহাসের নির্মম পথে যাত্রাকে তাদের অবশ্যকর্তব্য মনে করত। আজকের দিনের অনেক আমেরিকান মনে করেন ক্রুজ মিসাইল নিক্ষেপ করেই হোক আর এফ-১৬ বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করেই হোক, তাদের সরকার বস্তুতপক্ষে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সুফল দেয়ার মহান উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক রূপরেখা শাসক শ্রেণীর নিজেদের তৈরি ছিল না। যেহেতু সবাইকে নিয়ে এবং সবার জন্যই গড়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি, তাই সাম্রাজ্যের অভিজাত সম্প্রদায় একে উগ্রভাবে একটি একক, বদ্ধ সামাজিক নিয়ম-কানুনের গণ্ডিতে আবদ্ধ না রেখে প্রায়শই সাম্রাজ্যের অধীনস্থ জাতি-গোষ্ঠীর চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ এবং ঐতিহ্যকে সাম্রাজ্যের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করতেন। যদিও কিছু কিছু সম্রাট সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক শুদ্ধতা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন এবং তারা নিজেরা যাকে তাদের সংস্কৃতির শিকড় বলে জানতেন, সাম্রাজ্যেও সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলই বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাম্রাজ্যের সভ্যতা ছিল অধীনস্থ জাতি-গোষ্ঠীগুলির সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর মিশেল। রোম সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল গ্রিক আর রোমান সংস্কৃতির সমন্বয়ে; পারসিয়ান, গ্রীক আর আরবদের সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল আব্বাসিড (Abbasid) সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি। সাম্রাজ্যবাদী মোঙ্গলদের সংস্কৃতি ছিল চৈনিক সংস্কৃতির প্রতিলিপি মাত্র। সামাজ্র্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রে কেনিয়ান বংশোদ্ভুত একজন প্রেসিডেন্ট স্বচ্ছন্দে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ দেখতে পারেন যেখানে আরবরা তুর্কিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এমনকি চলচ্চিত্র দেখার সময় তিনি আয়েশে কুড়মুড় করে একটি ইতালিয়ান পিজায় কামড়ও বসাতে পারেন।
সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সময় অধীনস্থ জাতি-গোষ্ঠীগুলোর সাংস্কৃতিক উপাদানের এই মিশেল অন্তর্গত জাতি-গোষ্ঠীগুলিকে এই নতুন সংস্কৃতি আত্মীকরণে সহায়তা করেছে এমনটা ভাবার কারণ নেই। সাম্রাজ্যের সংস্কৃতিতে বিজিত জাতি-গোষ্ঠীদের অনেক সাংস্কৃতিক উপাদান অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে শেষমেশ সাম্রাজ্যের সংস্কৃতির যে সংকর রূপের সৃষ্টি হয়, তা বিজিত জনগোষ্ঠীর নিজেদের সংস্কৃতি থেকে ছিল অনেকটাই ভিন্ন। সুতরাং, বিজিত জাতি-গোষ্ঠীগুলোর কাছে সাম্রাজ্যের নতুন এই সংস্কৃতির আত্মীকরণ ছিল একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মত। একদিকে বহুদিনের অভ্যস্ত রীতি-নীতি ও আচরণগুলো ত্যাগ করা তাদের জন্য সহজ ছিল না, অন্যদিকে সংস্কৃতির নতুন উপাদানগুলোকে বোঝা, শেখা ও আত্মীকরণ করা তাদের জন্য ছিল আরও কঠিন এবং কষ্টসাধ্য। এর চেয়েও খারাপ ব্যাপার হল, বিজিত জাতি-গোষ্ঠী সাম্রাজ্যের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও, সাম্রাজ্যের শাসকদের অনেক অনেক বছর লেগে যেত পরাজিত জাতি-গোষ্ঠীর মানুষজনকে নিজেদের অংশ ভাবতে। ‘তাদের’ কে ‘আমরা’ হিসেবে স্বীকার করতে। বিজিত জাতি-গোষ্ঠীগুলোর জন্য এই মধ্যবর্তী সময়টুকু ছিল ভয়াবহ। কারণ, তারা ততদিনে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে এবং নতুন সাম্রাজ্যে তাদের সমান অধিকার নিয়ে অংশগ্রহণের সুযোগও নেই। আর এইদিকে, সাম্রাজ্যের যে নতুন সংস্কৃতিতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, সেই সংস্কৃতিতে তাদের পরিচয় বর্বর ছাড়া আর কিছু নয়।
নুমানশিয়ানদের পতনের একশ’ বছর পরের একজন স্বচ্ছল আইবেরিয়ানের কথা ধরা যাক। তিনি তার বাবা-মার সাথে নিখুঁত উচ্চারণে তার অতি পরিচিত সেলটিক ভাষাতেই কথা বলেন, কিন্তু, বড়কর্তাদের সাথে কথা বলা এবং ব্যবসাপাতি পরিচালনার জন্য এতদিনে তিনি ল্যাটিন ভাষাটা বেশ ভালমতই আয়ত্ত করেছেন, যদিও উচ্চারণটা এখনও অতটা সড়গড় হয়নি। স্ত্রীর সেলটিক ঘরানার নকশাদার গয়নার প্রতি আকর্ষণকে তিনি কোনোমতে মেনে নেন, কিন্তু তার সহধর্মিণী যে এখনও সেলটিকদের গতানুগতিক রুচির বাইরে বেরোতে পারল না এটা নিয়ে তার মনে খানিকটা আক্ষেপও কাজ করে। আফসোস করেন, রোমান গভর্নরের স্ত্রীর সাদামাটা নকশার গয়নার সৌন্দর্যটা যদি বুঝতেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী! তিনি নিজে রোমানদের মত টিউনিক (আজানুলম্বিত, ঢিলা, খাটো আস্তিনযুক্ত বা আস্তিনহীন এক ধরনের পোশাক) পরিধান করেন, গবাদিপশুর ব্যবসায় লাভ হবার দরুণ এবং রোমান বাণিজ্য নীতির সাথে তার ব্যবসার কোন দ্বন্দ্ব না থাকায় রোমানদের বাড়ির আদলে একটি বড়সড় বাড়িও নির্মাণ করেছেন। এমনকি তিনি অনায়াসে আবৃত্তি করতে পারেন বিখ্যাত কবি ভার্জিল (Virgil) এর জর্জিকস (Georgics) কবিতার তৃতীয় খণ্ডের পংক্তিমালা। কিন্তু, এতকিছুর পরেও রোমানরা তাকে একজন আধা-বর্বর হিসেবেই গণ্য করে। চরম হতাশা নিয়ে তিনি লক্ষ্য করেন, সরকারী পদস্থদের সাথে সাক্ষাতের কোন সুযোগ তিনি পাচ্ছেন না, পাচ্ছেন না অ্যাম্ফিথিয়েটারের সুবিধাজনক কোন আসন।
ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে অনেক শিক্ষিত ভারতীয়দের অবস্থাও ছিল একইরকম। তাদের ব্রিটিশ প্রভুরাও তাদের সাথে একই রকম আচরণ করতেন। এ ব্যাপারে ইংরেজি ভাষায় বিশেষভাবে পারদর্শী একজন উচ্চাভিলাষী ভারতীয়’র একটি গল্প বলা যেতে পারে। তিনি পশ্চিমা নাচের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, দৈনন্দিন জীবনে ছুরি এবং কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়ার অভ্যাসও করেছিলেন। এসব সাহেবী আদবকেতা শেখার পর তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে ব্যারিস্টারী ডিগ্রী অর্জন করেন। স্যুট-টাই পরা কেতাদুরস্ত এই তরুণ আইনজীবী কাল চামড়ার মানুষজনের জন্য নির্ধারিত ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীতে ভ্রমণ করার বদলে প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। শুধুমাত্র এই কারণে তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিটিশ উপনিবেশে একটি ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। লোকটির নাম ছিল ‘মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী’।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরাজিতদের সাংস্কৃতিক অভিযোজন এবং শাসকদের আত্মীকরণের এই প্রক্রিয়াটি একসময় বিজিত এবং শাসকশ্রেণীর মধ্যকার বিভেদের দেয়াল সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। সেক্ষেত্রে বিজিতরা নিজেদেরকে সাম্রাজ্যের অংশ ভাবতেন এবং শাসকশ্রেণীও বিজিতদেরকে নিজেদের সমান মনে করতেন। শাসক এবং শাসিত দুইপক্ষই ‘তাদের’কে ‘আমাদের’ মত ভাবতে শুরু করেন। অনেক শতকের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের পর রোমান সাম্রাজ্যের সকল অধিবাসীকেই রোমান নাগরিকত্ব দেয়া হয়। রোমান বংশোদ্ভুত নন এমন অনেকেই রোমান সৈন্যবাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় পরিষদে নিয়োগ লাভ করেন। ৪৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ক্লডিয়াস বেশ কিছু সংখ্যক গ্যালিক (ফরাসি) সম্প্রদায়ের মানুষকে রাষ্ট্রীয় পরিষদে নিয়োগ দেন এবং বলেন ‘তারা তাদের আচার-আচরণ, সংস্কৃতি এবং বিবাহ বন্ধনের দ্বারা আজ আমাদের একজন হয়ে উঠেছে’। সংসদের অনেক সভ্য জাতিগতভাবে এককালের শত্রুদেরকে রােমান রাজনীতির একদম কেন্দ্রবিন্দুতে সুযোগ করে দেওয়ার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। উত্তরে ক্লডিয়াস তাদের একটি অপ্রিয় সত্য কথা স্মরণ করিয়ে দেন। সেটি হল- সাংসদদের বেশিরভাগেরই পূর্বপুরুষ ছিল ইতালিয়ান আদিবাসী যারা এককালে রোমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল এবং পরে তাদেরকে রোমের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। রোমান সম্রাট সবাইকে এটাও স্মরণ করিয়ে দেন, তার নিজের পূর্বপুরুষও ছিলেন ইতালির স্যাবাইন (Sabine) গোত্রভুক্ত।৫
দুইশত খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে রোমান সাম্রাজ্য শাসন করেন আইবেরিয়ায় জন্ম নেয়া বেশ কিছু সম্রাট, যাদের ধমনীতে কোনও না কোনও ভাবে বইছে সেই সংগ্রামী আইবেরিয়ানদের রক্ত। ট্রাজান (Trajan), হ্যাডরিয়ান (Hadrian), অ্যান্টোনিয়াস পিয়াস (Antoninius Pius), মার্কাস অরিলিয়াস (Marcus Aurelius) – এদের শাসনামলকে সাধারণভাবে রোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে ধরা হয়। এরপর থেকে ঘুচে গেছে সবার পৃথক জাতিগত পরিচয়। সম্রাট সেপটিমিয়াস সেভেরাস (Septimius Severus) (১৯৩-২১১) ছিলেন লিবিয়ার পিউনিক পরিবারের সদস্য। ইলাগাবালুস (Elagabalus) (২১৮-২২) ছিলেন একজন সিরিয়ান। সম্রাট ফিলিপের (২৪৪-২৪৯) আরেক নাম ছিল ‘আরবের ফিলিপ’। সাম্রাজ্যের পরবর্তী প্রজন্মগুলো রোমান সাম্রাজ্যের সংস্কৃতিকে এতটাই গভীরভাবে গ্রহণ করেন যে, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের হাজার বছর পরেও, তারা রোমান সাম্রাজ্যের ভাষায়ই কথা বলতে থাকলেন, বিশ্বাস অটুট রাখলেন খ্রিস্টধর্মের ঈশ্বরের প্রতি যে ধর্ম রোমান সাম্রাজ্য পেয়েছিল লেভানটাইন (Levantine) অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে এবং মানতে থাকল রোমান সাম্রাজ্যের সকল আইন-কানুন।
আরব সাম্রাজ্যের ঘটনাও অনেকটা এরকম। সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যখন এই সাম্রাজ্যের পত্তন হয়, তখন সাম্রাজ্যের আরব-মুসলিম শাসক এবং অধিকৃত মিশরীয়, সিরীয়, ইরানি এবং বারবার জাতি যারা আরব বা মুসলিম কোনটাই ছিল না, তাদের মাঝে বৈষম্যের একটি স্পষ্ট ভেদরেখা ছিল। অধীনস্থ অনেক জাতিই পরে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করে, আরবি ভাষাকে গ্রহণ করে এবং অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সাম্রাজ্যের মিশ্র সংস্কৃতিতে। আরবের প্রাচীন শাসকশ্রেণী নতুন জাতে ওঠা এসব অধিকৃতদের শত্রুতার চোখে দেখত, তাদের ভেতর কাজ করত একান্ত নিজস্ব পরিচিতি এবং সামাজিক মর্যাদা হারিয়ে ফেলার ভয়। অন্যদিকে, হতবুদ্ধি ধর্মান্তরিতরা এরপর সাম্রাজ্যে এবং ইসলামের দুনিয়ায় তাদের সমান অধিকারের দাবী করতে শুরু করে। শেষমেষ তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়। মিশরীয়, সিরীয় এবং মেসোপটেমিয়ানরা ক্রমাগত: ‘আরব’ নামে পরিচিতি পেতে থাকে। আরবরা, সে প্রাচীন আরব বংশদ্ভুত আরবই হোক আর নতুন রূপান্তরিত আরবই হোক, ক্রমাগত: অনারব মুসলিমদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে, বিশেষত ইরানি, তুর্কি এবং বারবার জাতির দ্বারা। আরব সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় সাফল্য হল, এই সাম্রাজ্যের সংস্কৃতিকে অনেক অনারব মানুষ অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করেছে। প্রকৃত আরব সাম্রাজ্যের পতন এবং প্রকৃত আরবদের আধিপত্য চলে গেলেও এরাই এই সংস্কৃতির রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নয়ন এবং প্রসারে কাজ করে চলেছে।
চীনাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প ছিল আরও অনেক বেশি সফল। একসময় বর্বর হিসেবে অভিহিত, জগাখিচুড়ি পাকানো বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ধীরে ধীরে সফলভাবে চীনা সাম্রাজ্যের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ‘হান চাইনিজ’ (এই নামটি এসেছে হান সামাজ্র্যের নাম থেকে যার স্থায়িত্ব ছিল ২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ) নামে পরিচিতি লাভ করে। চীন সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় সফলতা হল এটি এখনও বহাল তবিয়তে জীবিত, যদিও বাইরে থেকে দেখলে তিব্বত এবং শিনজিয়াং কে ঘেরা একটা ভৌগোলিক সীমানা ছাড়া সাম্রাজ্যের আর কোন বৈশিষ্ট্যই চোখে পড়ে না। চীনে নব্বই শতাংশের বেশি মানুজনকে তারা নিজেরা এবং বাইরের লোকজন এখনও ‘হান’ নামে জানে।
একই পদ্ধতিতে আমরা দুনিয়াজুড়ে গত কয়েক দশক ধরে চলা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার (decolonisation) প্রক্রিয়াটিও ব্যাখ্যা করতে পারি। অাধুনিককালে ইউরোপীয়রা উন্নত পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রচারের নামে প্রায় পুরো দুনিয়াটাকেই জয় করে ফেলেছে। তারা এ কাজে এতটাই সফল যে, কোটি কোটি মানুষ একে একে নিজেদের জীবনে এই সংস্কৃতির অনেক উপাদান গ্রহণ করছে। ভারতীয়, আফ্রিকান, আরব, চাইনিজ এবং মাওরিরা এখন ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি বা স্প্যানিশ ভাষা শেখে। তারা এখন ‘মানবাধিকার’ এবং ‘ব্যক্তি-স্বাধীনতা’র ধারণায় বিশ্বাস করে এবং ‘স্বাধীনতা’, ‘পুঁজিবাদ’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘নারীবাদ’ এবং ‘জাতীয়তাবাদের’ মত পশ্চিমা ধ্যান-ধারণাগুলো তারা গ্রহণ করতে শুরু করেছে।
সাম্রাজ্যের চক্র
ধাপ
রোম
ইসলাম
ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ
প্রথমে একদল মানুষ একটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেরোমানরা তৈরি করল রোমান সাম্রাজ্য।আরবরা তৈরি করল আরব খিলাফত।ইউরোপীয়রা তৈরি করল ইউরোপীয় সাম্রাজ্য।
সেই সাম্রাজ্যজুড়ে একটা সাধারণ সংস্কৃতি গড়ে ওঠেগ্রেকো-রোমান সংস্কৃতি।আরব-মুসলিম সংস্কৃতি।পশ্চিমা সংস্কৃতি।
সাম্রাজ্যের প্রজারা ধীরে ধীরে সেই সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেজনগণ ল্যাটিন, রোমান আইনকানুন, রোমান রাজনৈতিক ধারণাগুলো গ্রহণ করল।জনগণ আরবি ভাষা, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল।জনগণ ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা এবং সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকার ইত্যাদি ধারণা গ্রহণ করল।
এরপর এই নতুন সাম্রাজ্যবাদী মূল্যবোধে দীক্ষিত জনগণ শাসকগোষ্ঠীর সমান অধিকার পেতে সচেষ্ট হয়ইলিরিয়ান, গল এবং পিউনিকরা রোমান মূল্যবোধের ভিত্তিতে রোমানদের সমান অধিকার দাবি করল।মিশরীয়, ইরানি এবং বারবাররা ইসলামি ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আরবদের সমান অধিকার দাবি করল।ভারতীয়, চীনা ও আফ্রিকানরা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি পশ্চিমা মূল্যবোধের ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের সমান অধিকার দাবি করল ।
বিশ শতকে, বিভিন্ন আঞ্চলিক গোষ্ঠী, যারা পশ্চিমা মূল্যবোধগুলোকে গ্রহণ করেছিল, তারা সেইসব মূল্যবোধের দোহাই দিয়েই তাদের ইউরোপীয় শাসকদের কাছে সমতার দাবি তোলে। ব্যক্তি-স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মত পশ্চিমা ধ্যান-ধারণাগুলোই জন্ম দেয় পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে অনেক উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের। যেভাবে মিশরীয়, ইরানি এবং তুর্কিরা আরবের প্রকৃত বিজয়ীদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ গ্রহণ ও পরিমার্জন করেছিল, ঠিক একই ভাবে আজকের দিনের ভারতীয়, আফ্রিকান এবং চাইনিজরাও তাদের পূর্ববর্তী পশ্চিমা শাসকদের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির উপাদানগুলোকে গ্রহণ করে সেগুলোকে নিজেদের প্রয়োজন এবং ঐতিহ্যের উপযোগী করে পরিমার্জন করে নিচ্ছে।
ইতিহাসের নায়ক, ইতিহাসের খলনায়ক
ইতিহাসকে ভালো আর খারাপ এই দুইটি সুস্পষ্ট আলাদা ভাগে ভাগ করে ফেলার প্রবণতা প্রায়শই দেখা যায়। এই ভাগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্য আর তার শাসকরা পড়েন মন্দের খাতায়। এটা সত্য, বেশিরভাগ সাম্রাজ্যের জন্ম হয়েছে নির্দয় রক্তপাতের মাধ্যমে, আর সাম্রাজ্য টিকে থাকে যুদ্ধ আর বঞ্চনার স্তম্ভের উপর ভর করে। কিন্তু, একথাও সত্য যে, আজকের দিনের সংস্কৃতি, সভ্যতা, রীতিনীতির অধিকাংশই এসেছে সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তুপের ছাই থেকে। সুতরাং, সাম্রাজ্যকে পুরোপুরি খারাপের তালিকায় ফেলা হলে, নিজেদের আজকের পরিচয়, রীতি, আইনকে আমরা কোন তালিকায় ফেলব?
বেশ কিছু রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং মতবাদ সাম্রাজ্যবাদ থেকে সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ছেঁকে নিয়ে একটি বিশুদ্ধ, নতুন সভ্যতার কথা বলতে চায়, যেখানে খারাপ কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। এই ধরনের তত্ত্বগুলো হয় একেবারেই অপরিপক্ব নতুবা নতুন মোড়কে মোড়া উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং গোঁড়ামির ভিন্ন একটি রূপ মাত্র। আপনি হয়ত এরকম দাবি করতে চাইবেন, মানুষের গ্রন্থিত ইতিহাসের শুরুতে উদ্ভুত অগণিত সংস্কৃতির কিছু উপাদান বিশুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ এবং পুরোপুরি অবিকৃত। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সংস্কৃতিই এরকম কোন দাবি করে না, বিশেষত বর্তমান পৃথিবীতে টিকে থাকা কোন সংস্কৃতিই এরকম কোন দাবি করতে পারে না। মানুষের সকল সংস্কৃতি কোনও না কোনও সাম্রাজ্য এবং সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার সাথে সম্পর্কিত, কোন প্রাতিষ্ঠানিক বা রাজনৈতিক ছুরি-কাঁচি সাম্রাজ্যকে কেটে আলাদা করে তার সংস্কৃতিকে নিতে পারে না, তার অনেক আগেই সে সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটে।
উদাহরণ হিসেবে আজকের স্বাধীন ভারত এবং ব্রিটিজ রাজের মধ্যকার অম্ল-মধুর সম্পর্কের কথাই ধরুণ। ব্রিটিশরা ভারত অধিকার করার সময় লাখ লাখ ভারতীয় নিহত হয়, তাদের উপেক্ষা ও অত্যাচারের শিকার হয় কোটি কোটি ভারতীয়। এত কিছুর পরেও অনেক ভারতীয়ই নতুন স্বাদের লোভে ‘ব্যক্তি-স্বাধীনতা’ এবং ‘মানবাধিকারের’ মত পশ্চিমা ধারণার চাটনী গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশরা যখন তাদের ‘সমঅধিকার’ বা ‘স্বাধীনতা’ দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে।
এতকিছুর পরেও, অাধুনিক ভারত রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশের অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে, নিপীড়ন করেছে, আহত করেছে কিন্তু তারাই আবার ভারতের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগণিত রাজ্য, মতবাদ এবং গোত্রকে একত্রিত করে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে, তাদের মাঝে তৈরি করেছে অভিন্ন জাতীয়তাবাদের ধারণা এবং জন্ম দিয়েছে একটি দেশের যা কম-বেশি একটি রাজনৈতিক অস্তিত্ব হিসেবে কাজ করতে পারে। ব্রিটিশরাই তৈরি করে দিয়েছে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার ভিত্তি, তৈরি করেছে এর প্রশাসনিক কাঠামো এবং দেশজুড়ে নির্মাণ করেছে রেলপথ যা ভারতীয় অর্থনীতিকে একীভূতকরণের জন্য ছিল অপরিহার্য। ইংরেজি এখনও এই উপমহাদেশের প্রধান ভাষা, কোনও রাজ্যের জনগণের মাতৃভাষা হিন্দি, তামিল, মালায়ালাম যাই হোক না কেন একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম হিসেবে তারা ব্যবহার করে ইংরেজি ভাষা। ভারতীয়রা ক্রিকেটের অন্ধ ভক্ত আর চা তাদের সবচেয়ে প্রচলিত পানীয়, এই খেলা এবং চা এই দুটোই তারা পেয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছ থেকে। ব্রিটিশরাই উনিশ শতকের মধ্যভাগে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ভারতে চায়ের চাষ শুরু করে। এর আগে পর্যন্ত ভারতে চায়ের চাষ হত না। অহংকারী ব্রিটিশ সাহেবরা চা পানের অভ্যাস পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে দেয়।
image040.jpg
২৮. মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী স্টেশন। বোম্বে ভিক্টোরিয়া স্টেশন নামে এর যাত্রা শুরু হয়। ব্রিটিশরা উনিশ শতকের ব্রিটেনে জনপ্রিয় নিও-গথিক স্থাপত্যশৈলীতে এটি নির্মাণ করে। একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার শহর এবং স্টেশনের নাম পরিবর্তন করেছে কিন্তু এত সুন্দর একটি স্থাপনা ভাঙবার কোনও আগ্রহ তার মাঝে দেখা যায় নি, যদিও এটির নির্মাতা ছিল অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকবর্গ
বর্তমানে ভারতীয়দের মাঝে একটি ভোট করা হলে কতজন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে পাওয়া গণতন্ত্র, ইংরেজি, রেলওয়ে, আইন ব্যবস্থা, ক্রিকেট এবং চা তাদের জীবন থেকে বর্জন করতে রাজি হবেন? এবং যদি তারা এসব বর্জন করতে রাজিও হন, এই ভোট দেওয়াটাই কি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে তাদের ঋণের পরিমাণকে তুলে ধরবে না?
image041.jpg
২৯. তাজমহল। বিশুদ্ধ ভারতীয় সংস্কৃতির একটি উদারহণ নাকি মুসলিম সাম্রাজ্যের সংস্কৃতিতে প্রভাবিত একটি স্থাপত্য?
যদি আমরা একটি নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যের পূর্ববর্তী বিশুদ্ধ সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের জন্য সেই সাম্রাজ্যের সকল সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে বর্জনও করি, শেষমেশ আমরা কী সংরক্ষণ করব? সম্ভবত, এই সাম্রাজ্যের পূর্ববর্তী কোনও সাম্রাজ্যের সংস্কৃতিকে যা স্বাভাবিকভাবেই হবে এই সাম্রাজ্যের সংস্কৃতির থেকেও অনেক বেশি নির্মম। যারা ব্রিটিশ রাজকে ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গহানির জন্য দায়ী করত, তারা দিল্লীর মসনদ দখল করা মুঘল সম্রাট এবং তার সাম্রাজ্যের রেখে যাওয়া সংস্কৃতিকেই বিশুদ্ধ ভারতীয় সংস্কৃতি বলে মনে করত। এবং কেউ মুসলিম সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকেও বিশুদ্ধ ভারতীয় সংস্কৃতিকে রক্ষার চিন্তা করলে, তিনি সম্ভবত তার আগের গুপ্ত সাম্রাজ্য, কুশান সাম্রাজ্য এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের সংস্কৃতিকে বিশুদ্ধ ভারতীয় সংস্কৃতি ভেবে থাকবেন। যদি একজন উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী ব্রিটিশদের নির্মিত সব দালানকোঠা ধ্বংসও করে ফেলেন, ভারতের মুসলিম শাসকদের সময় তৈরি হওয়া স্থাপনাগুলোর ব্যাপারে তিনি কী সিদ্ধান্ত নেবেন? ভেঙে ফেলবেন তাজমহল?
সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের এই বিব্রতকর প্রশ্নের সমাধান কী তা কারোরই জানা নেই। যে পথেই আমরা এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি, প্রথমে আমাদের এটা মেনে নিতে হবে যে এটা একটা জটিল গোলকধাঁধা এবং এখানে কাউকে ঢালাওভাবে নায়ক, কাউকে খলনায়ক বানানোর সুযোগ নেই। আর যদি আমরা সেটা করি, তাহলে আমাদেরকে একথা স্বীকার করে নিতে হবে যে, ইতিহাসের পরিক্রমায় আমরা এতদিন মূলত খলনায়কদের দেখানো পথ ধরেই হেঁটেছি।
নতুন বৈশ্বিক সাম্রাজ্য
প্রায় ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে বেশিরভাগ মানুষ কোনও না কোনও সাম্রাজ্যে বসবাস করে আসছে। যতদূর মনে হয়, ভবিষ্যতের মানুষও তাই করবে, সাম্রাজ্যের অধীনেই হবে তার বসবাস। তবে, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে সাম্রাজ্য হবে বৈশ্বিক সাম্রাজ্য। প্রকট হয়ে উঠবে গোটা দুনিয়াকে শাসন করা একটি একক সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্যবাদী দর্শন।
একবিংশ শতাব্দী যত এগিয়ে যাচ্ছে, জাতীয়তাবাদ তত বেশি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, একটি বিশেষ জাতির মানুষ নয়, দুনিয়ার সকল মানুষ পৃথিবীর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের উৎস এবং মানুষের অধিকার রক্ষা এবং সকল মানুষের ইচ্ছাকে মর্যাদা দেয়াই হওয়া উচিত রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু, দুনিয়াজুড়ে দুইশটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র এই চিন্তার পক্ষে সুবিধার চেয়ে বিপত্তিই বেশি তৈরি করে। যেহেতু সুইডিশ, ইন্দোনেশিয়ান, নাইজেরিয়ান সবাই একইরকম সমান অধিকার চায়, সুতরাং তাদের সে অধিকার রক্ষার জন্য একটি একক সাধারণ সরকার গঠনই কি সহজ সমাধান নয়?
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ার মত বিশ্বজনীন সমস্যাগুলোর উদ্ভব ধীরে ধীরে বহুসংখ্যক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ফিকে করে দিচ্ছে। কোন সার্বভৌম রাষ্ট্রই এককভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতার মত সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে পারবে না। চাইনিজরা স্বর্গ থেকে মানব জাতির সমস্যা সমাধানের জন্য ‘স্বর্গীয় অনুমোদন’ পেয়েছিল। আধুনিকালের মানুষ মানুষকে ওজন স্তরের ছিদ্র মেরামত এবং গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ এর মত স্বর্গীয় সমস্যাগুলোকে সমাধানের জন্য ‘স্বর্গীয় অনুমোদন’ দেবে। বৈশ্বিক এই সাম্রাজ্যের সনাক্তকারী রঙ হতে পারে সবুজ।
২০১৪ সালে এসেও পৃথিবী রাজনৈতিকভাবে অনেক ভাগে বিভক্ত, কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো খুব দ্রুত তাদের স্বাধীনতা হারাচ্ছে। কোনও রাষ্ট্রই তাদের ইচ্ছামত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তৈরি করতে পারছে না, ইচ্ছে হলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছে না যুদ্ধে, এমনকি সবাইকে অগ্রাহ্য করে খেয়াল খুশি মত কোন অভ্যন্তরীণ রীতি নীতিও তৈরি করতে পারছে না। রাষ্ট্রগুলো ক্রমশ ঝুঁকছে বিশ্ববাজারের কৌশলের প্রতি, উদার হচ্ছে বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠান এবং এনজিওগুলোর ব্যাপারে। সাহায্য নিচ্ছে বিশ্বের জনমত এবং আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার। রাষ্ট্রকে বাধ্য হয়েই তার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, পরিবেশ বিষয়ক পরিকল্পনা এবং ন্যায়বিচারের জন্য বৈশ্বিক মানদণ্ড মেনে চলতে হচ্ছে। কমছে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা আর মতামতের প্রতি একাত্মতা; পুঁজি, শ্রম আর তথ্যের অফুরন্ত স্রোত পালটে দিচ্ছে পৃথিবী, গড়ে তুলছে নতুন বিশ্ব।
বৈশ্বিক সাম্রাজ্যের যে রূপ আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, কোন বিশেষ রাষ্ট্র বা জাতিগোষ্ঠী সেই সাম্রাজ্যের শাসক নয়। অনেকটা রোমান সাম্রাজ্যের মত, একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং সাধারণ স্বার্থ বাস্তবায়নের জন্য সেই বৈশ্বিক সাম্রাজ্য শাসন করে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উচ্চপদস্থ কিছু মানুষ। দুনিয়াজুড়ে অনেক অনেক উদ্যোক্তা, প্রকৌশলী, বিশেষজ্ঞ, পণ্ডিত, আইনজীবী, ব্যবস্থাপককে প্রতিনিয়ত এই নতুন সাম্রাজ্যের অংশ হবার জন্য আহ্বান করা হচ্ছে। তারা কি নতুন সাম্রাজ্যের এই ডাকে সাড়া দেবে নাকি নিজ নিজ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে – এই সিদ্ধান্ত তাদের হাতে। মানুষ ক্রমাগত দলে দলে এই সাম্রাজ্যের ডাকেই সাড়া দিচ্ছে।

No comments:

Post a Comment